নিত্যজাতম্‌-জিনের বাদশা সমাচার by মহসীন হাবিব

গভীর রাতে মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে অন্য প্রান্ত থেকে অপরিচিত, অস্বাভাবিক এক কণ্ঠে শোনা যায়, 'আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহি ওয়া সাল্লাম।' আরবিতে আরো কিছু বাক্য এবং পরে আসল কথা বাংলায়, 'আপনার ওপর রাসুলে আকরাম হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিশেষ রহমত বর্ষিত হয়েছে।'


এরপর একদিকে লোভ এবং অন্যদিকে ভয় দেখিয়ে নির্দেশ পালন করতে অনুরোধ-আদেশ। ফোনকারীর পরিচয়, তিনি জিনের বাদশা। ফোন করছেন কোকাপ শহর (বহুকাল ধরে আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে ধারণা আছে যে জিনের দেশের রাজধানীর নাম কোকাপ) থেকে।
ধর্মপ্রাণ ও সহজ-সরল মানুষ এ মোবাইল ফোন পেয়েই ভড়কে যান। একদিকে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা, অন্যদিকে সেই বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত ১০ গুণ ফিরে পাওয়ার লোভ থেকে নিজেকে নির্লিপ্ত রাখা বড়ই কঠিন কাজ। বাংলাদেশে সমাজের সর্বস্তরে এ ভয় ও লোভ বিরাজমান। স্নাতক পাস আমার এক আত্মীয় গভীর রাতে হঠাৎ এমন একটি ফোন পেয়ে ভড়কে গেলেন। বুঝতে পারলেন, ওপাশ থেকে জিনের বাদশা তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন। ওপাশের ওই জিনের বাদশাও বুঝতে দেরি করলেন না যে আসল 'বিশ্বাসী' পাওয়া গেছে। একাধিকবার ফোন করে যুবককে পুরোপুরি ওলটপালট করে দিলেন। বগুড়ার এই যুবক নগদ সাড়ে চার লাখ টাকা এবং মাত্র দুই মাস আগে বিয়ে করা স্ত্রীর সব গয়না জড়ো করে দিনাজপুরের একটি পুকুরপাড়ে একটি স্থানে জিনের বাদশার কথামতো রেখে এলেন। ১০ দিন পার হয়ে যাওয়ার পরও যখন জিনের বাদশার কাছ থেকে কোনো রিটার্ন পাওয়া গেল না, তখন সংবিৎ ফিরে পেলেন সেই যুবক। এখন অনেকটাই তাঁর মাথাখারাপ অবস্থা।
কাকের পিঠে ময়ূরপুচ্ছ জুড়ে দিলে যা হয়, বাংলাদেশের এখন সেই অবস্থা। উন্নত বিশ্ব ও বর্তমান চীনে আধুনিক প্রযুক্তি বা নতুন নতুন যত ডিভাইস তৈরি হচ্ছে, তা রাতারাতি পেঁৗছে যাচ্ছে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জেও। কিন্তু সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের ধারণায় পরিবর্তন আসছে না। বরং ক্ষেত্রবিশেষে দেশের একটি বড় অংশ পেছন ফিরে হাঁটছে। কেন এমনটি হচ্ছে, তা সত্যিই এক বড় রহস্য। জিনের বাদশা কোনো রহস্য নয়। প্রাসঙ্গিক আরো একটি ঘটনা বলার লোভ সংবরণ করা যাচ্ছে না। আমার এক অতি পরিচিতজন ২১ বছর ধরে জার্মানিতে বসবাস করছেন। বাংলাদেশ থেকে স্নাতক পাস করে জার্মানিতে নিজের শিকড় গেড়েছেন। তিনি একটি জটিল রোগের সম্মুখীন হয়েছেন। মোবাইল সেল কানের কাছে ধরে কথা বলতে পারেন না। হঠাৎ করে কানের ঠিক পেছন থেকে মাথা পর্যন্ত এক ধরনের অস্বস্তি ও মৃদু ব্যথা অনুভব করেন। জার্মানির চিকিৎসকরা (আমাদের জানা আছে, চিকিৎসাবিজ্ঞানে জার্মানির অবদান শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে পারে) তাঁকে একাধিকবার পরীক্ষা করে চূড়ান্তভাবে জানিয়েছেন, তাঁর রোগটি মস্তিষ্কপ্রসূত, অর্থাৎ মানসিক। এই ভদ্রলোক নিজের ঠিকানা ভুলে শ্বশুরবাড়ির ঠিকানাকে নিজের করে নিয়েছেন।
ঢাকার ওয়ারীতে অবস্থিত শ্বশুরকুলের আত্মীয়রা তাঁকে পরামর্শ দিয়েছেন জিনের চিকিৎসা নিতে। তিনি তা-ই করলেন। ওয়ারীর একটি আধুনিক সুবিশাল বাড়ির চারতলায় ইমাম সাহেব ঘর অন্ধকার করে জিন ডেকে আনলেন। জিন তাঁর চিকিৎসা করার সময় এক-দুই মিনিটের জন্য লাহোর, করাচি, জেদ্দা_এসব শহর ভ্রমণ করলেন। ঘণ্টাধিককাল চিকিৎসার পর জার্মানিপ্রবাসী ভদ্রলোক অবাক হয়ে সবাইকে জানালেন, জিন ছাড়া এক-দুই মিনিটে সুদূর জেদ্দা, করাচি, লাহোর থেকে ঘুরে আসবে_মানুষের সাধ্য কী! অবশ্য এ চিকিৎসাকাজের জন্য ইমাম সাহেব কোনো টাকা-পয়সা নেননি। শুধু জিন সাহেব ২০ হাজার টাকা ইমাম সাহেবের মাধ্যমে তাঁকে দিতে বলেছেন। জার্মানিপ্রবাসী ভদ্রলোক অবলীলায় টাকা বের করে জিনকে দিলেন। ইমামকেও কিছু পারিশ্রমিক দিতে চাইলেন, কিন্তু অতি সৎ ইমাম সাহেব তা নিলেন না। বড় মজার এই দেশ, এ দেশের মানুষ! উল্লেখ্য, ভদ্রলোকের সে অসুখ প্রশমন করতে না পেরে এখন জার্মান চিকিৎসকরা রীতিমতো গবেষণা শুরু করেছেন, কোন মানসিক কারণে তাঁর এমনটি হচ্ছে, সেটা খুঁজে বের করতে।
গোড়ার কথায় ফিরে আসি। দৈবশক্তিকে আশ্রয় করে সরল ধর্মবিশ্বাসী অথবা অদৃষ্টে বিশ্বাসী মানুষকে প্রতারিত করার ঘটনা কোনো নতুন বিষয় নয়। শত শত বছর ধরে পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ এর শিকার হয়ে আসছে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে। আমরা তিন-চার দশক আগেও দেখেছি, প্রত্যন্ত এলাকায় মাঝেমধ্যেই জিন বা ভূত নির্জন কোনো স্থানে পানিতে চুবিয়ে কাউকে হত্যা করত। লক্ষণীয়, এ হত্যার শিকার হতো বেশির ভাগ সময় ঘরের যুবতী বউ অথবা মেয়ে, কিশোরী ও বালকরা। এ ধরনের ঘটনাকে গ্রামের সাধারণ মানুষ, মাতব্বর ও মুরবি্বরা জিনের কাণ্ড বা ভূতের কাণ্ড বলে মেনে নিতেন। থানা-পুলিশ করার প্রশ্নই আসে না। এখনো গ্রামের কোথাও কদাচিৎ দেখা যায় এমন হত্যাকাণ্ড।
জিন বা ভূতের নামে এ হত্যাকাণ্ড আসলে কী, তা যুক্তিবাদী মাত্রই জানেন। আশা ছিল, মানুষ হয়তো ধম্ম-কম্ম করবে, সেই সঙ্গে যুক্তিকেও আমলে নেবে। দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশে যেন যুক্তি গ্রহণ করার মানুষ দিনে দিনে আরো কমে যাচ্ছে। যে ধারণার চাষ হয়ে আছে, তাতে কিছু আধুনিক প্রতিষ্ঠান না থাকলে ভয়াবহ আকার ধারণ করত এসব জিন-ভূতের কাণ্ড।
তার পরও সম্প্রতি আমরা দেখতে পাচ্ছি ডিজিটাল জিনের বাদশা। যে বাদশা চায়নিজ মোবাইলের বিশেষ ডিভাইস বোঝে। বাজার সয়লাব হয়ে গেছে এক ধরনের মোবাইলে, যাতে অপশন রয়েছে গলার আওয়াজ নানা ধরনের করে ফেলার। এমনকি তাতে ধাতব বা অস্বাভাবিক কণ্ঠ তৈরি করা যায়। কথা বলতে থাকলে ওপাশ থেকে কেউ ইহজনমে ধরতে পারবে না, কে কথা বলছে। অবশ্য এরই মধ্যে বেরসিক পুলিশের কানে পেঁৗছে গেছে এই জিনের বাদশাদের কারসাজির খবর। পুলিশ মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে জিনের বাদশা ধরার চেষ্টাও করছে। তবে পুলিশ প্রশাসন এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে অনুরোধ, অনেক ক্ষতি হয়ে যাওয়ার আগেই মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে সর্বস্বান্তকারী এই প্রতারকদের অথবা এই চক্রকে খুঁজে বের করুন। আপনারা অবশ্যই পারবেন। বেশ কিছুকাল ধরে দেখে আসছি, যে আসামিকে আপনারা খুঁজে বের করতে চান, তাকে রাতারাতি ধরে ফেলেছেন।
কিন্তু প্রশ্ন অন্যত্র। মানুষকে সচেতন করার দায়িত্ব কার? মানুষের অজ্ঞতা দূর করার দায়িত্ব কার? কার দায়িত্ব ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে তোলা, অন্ধকারে বসবাসকারী নাগরিককে আলোর পথ দেখানো? লক্ষণীয়, যে দুজন মানুষের উদাহরণ দিয়েছি, তাঁরা শুধু অক্ষরজ্ঞানসম্পন্নই নন, সমাজের শিক্ষিত শ্রেণীর প্রতিনিধি। তাহলে কিসের অভাবে এসব মানুষের মধ্যে অজ্ঞতা?
অভাবটা আমাদের কাছে অজ্ঞাত নয়। দিকনির্দেশনা না দিয়ে উল্টো মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে রাজনীতিবিদরা যদি কোনো জনপদে রাজনৈতিক ফায়দা গ্রহণ করে, তাহলে সে জনপদ অজ্ঞতা ঘাড়ে নিয়ে চলতে বাধ্য। এই অপরাজনীতির প্রভাব পড়ে শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, এমনকি সংবিধানেও।
আজ বাংলাদেশের পরিস্থিতি দেখে নজরুলের সেই কবিতা আওড়াতে ইচ্ছা করে_
বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে
আমরা তখনও পিছে,
বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজছি
হাদিস ও কোরান চষে।
বাহিরের দিকে যত মরিয়াছি
ভেতরের দিকে তত
গুনতিতে মোরা বাড়িয়া চলেছি
গরু ছাগলের মত।
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.