ভিন্নমত-এখন শেয়ার যখন সস্তা, তখন কেনার লোক নেই by আবু আহমেদ

শেয়ারবাজার পড়ে পড়ে এখন মূল্যের দিক দিয়ে অনেকটা যৌক্তিক পর্যায়ে রয়েছে। এই অবস্থাটা হলো আগস্টের প্রথম সপ্তাহে। ২০০৯ ও ২০১০ সালে আমাদের শেয়ারবাজারে মূল্যের যে তীব্র ঊর্ধ্বগতি হয়েছিল, সেটা বিনিয়োগকারীদের কাছে ভালো লাগলেও ওই গতি মোটেই সুস্থ ছিল না।
তারপর ২০১০ সালের নভেম্বর থেকে বাজারে কয়েক দফা মহাধস নেমে মার্চ-এপ্রিল ২০১১-তে এসে অনেকটা তলানিতে পেঁৗছে যায়। শেয়ারবাজার নিয়ে অতি উৎসাহ হঠাৎ করে যেন উবে যায়। শুরু হলো বিক্ষোভের মাধ্যমে ক্ষোভের মহাপ্রকাশ। অতি সাধারণ লাখ লাখ বিনিয়োগকারী বিষয়টি টের পাওয়ার আগেই যেন তাদের সর্বনাশটা ঘটে গেল। এটাই হয় যুক্তিহীনভাবে শেয়ারবাজারে যখন মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। যে রেগুলেটর এসইসি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য প্রতিষ্ঠিত, সেই রেগুলেটর তাদের অনেক বিতর্কিত ও গর্হিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে যারা বিভিন্ন কৌশলে শেয়ারবাজারকে লুট করল তাদের পক্ষ নিল। ফল হলো, শেয়ারবাজার থেকে যারা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের পকেট কেটে অনেক অর্থ নিয়েছে, তারা আইন ভঙ্গ করেছে কি না, সেটা আবিষ্কার করা যাচ্ছে না।
এবারের শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলো ঘটেছে হয় রেগুলেটরের অনুমতিতে, না হয় রেগুলেটর চুপ থাকার কারণে। সবই যখন সর্বনাশ হয়ে গেল, তখন বাংলাদেশ সরকার অনিয়ম ও ডাকাতি শনাক্তকরণের জন্য অতি অল্প সময় দিয়ে একটি কমিটি করল। কমিটি অনেক কথা বলল বটে, যেগুলো আগে থেকেই অনেকের কাছে জানা ছিল। কিন্তু সত্য হলো এই যে ডাকাতির ঘটনা শনাক্ত করা হলো, কিন্তু ডাকাত ধরা যাচ্ছে না। বিষয়টি অনেকাংশে অনেকে ভুলে গেছেন। বিনিয়োগকারীরাও চান, ডাকাত ধরবেন কি ধরবেন না সেটা আপনাদের ব্যাপার, কিন্তু আমরা যেন আমাদের হারানো পুঁজির কিছুটা হলেও উদ্ধার করতে পারি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই উদ্ধার কিভাবে হবে? কে আবার বাজারটা টেনে আগের অবস্থা দূরে থাকুক, অন্তত মাঝপথে নেবে? ২০০৯ ও ২০১০ সালে অর্থনীতিতে সুদের হার ছিল সর্বনিম্ন। অনেকে নিম্নহারে ঋণ নিয়ে সেই টাকা শেয়ারবাজারে খাটিয়েছে। সবারই উদ্দেশ্য ছিল অল্প সময়ে লাভ করে বেরিয়ে যাওয়া। বড় অনেকেই বের হতে পেরেছে বটে, তবে বড় রকমের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ব্যাংকের মার্জিন অ্যাকাউন্ট তথা ঋণ হিসাব খুলে যারা শেয়ার কিনেছে। এদের বেশির ভাগের মূল পুঁজি ছিল ১০-২০ লাখ টাকা। ব্যাংক থেকে ১ঃ২ অনুপাতে তারা ঋণ নিয়েছে আরো ২০ থেকে ৪০ লাখ টাকা। শেয়ারবাজারে ধসের সময়ে তারা তাল রাখতে পারেনি। দিশেহারা হয়ে লোকসানে শেয়ার বেচা থেকে বিরত থেকেছে। কিন্তু অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে যে তাদের জন্য আরো বড় লোকসান অপেক্ষা করছে, তা তারা জানত না। আর ফেব্রুয়ারি-মার্চ ২০১১-তে এসে তারা দেখল, তাদের পুঁজি অর্ধেক হয়ে গেছে।
ঋণ বিক্রেতা ব্যাংক বেচে গেছে। বরং সুদ থেকে অনেক আয় করেছে। কিন্তু বাঁচতে পারেনি তাদের লাখ লাখ ক্ষুদ্র মার্জিন অ্যাকাউন্টহোল্ডার। তাদের মধ্যে অনেকে ইতিমধ্যে বাকি পুঁজিটা নিয়ে শেয়ারবাজার ত্যাগ করেছে। কিছু লোক এও প্রতিজ্ঞা করেছে, জীবনে আর শেয়ারবাজারমুখী হবে না। দোষ কাকে দেবে_এদের, না রেগুলেটরকে? এমন একটি ঘটনা ঘটতে পারে বলে অনেকেই আগে থেকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। কিন্তু শোনার লোক ছিল না। কেমন করে শুনবে, তারা তো চোখের সামনেই অন্তত এক বছর পর্যন্ত দেখে আসছে, শেয়ার কিনলেই মাস শেষে দ্বিগুণ মূল্য হচ্ছে। বন্ধু শেয়ারবাজারে অনেক অর্থ কামিয়েছে। তার দেখাদেখি অন্য বন্ধুরাও মা-বাবার কাছ থেকে অর্থ নিয়ে সেই উপার্জনের বাজারে শেয়ার কেনায় ঢুকে পড়ল। মনু মিয়ারাও ঢুকে পড়লেন। পুঁজির উৎস দোকানের মাল কেনার পুঁজি। কারণ মনু মিয়ার দোকানের ওপরেই ব্যাংক, তার ওপর শেয়ার বেচা-কেনার অফিস ব্রোকার হাউস। মনু মিয়ার দোকানে শিক্ষিত খদ্দেররা প্রায়ই শেয়ারের আলাপ করে। তাদের আলাপ শুনতে শুনতে মনু মিয়াও শেয়ার কেনায় প্রলুব্ধ হন। দোকান থেকে নিয়ে শেয়ারবাজারে লগি্ন করলেন ২০ লাখ টাকা। কিন্তু ২০১১ সালের মার্চে যখন বের হন, তাঁর পুঁজি বাকি ছিল ১০ লাখ টাকা। মনু মিয়া অর্ধেক পুঁজি হারিয়ে বুঝতে পারলেন, এই 'ব্যবসা' তাঁর দোকানের অন্যান্য মাল বেচা-কেনার মতো ব্যবসা নয়। এ ক্ষেত্রে যে মালের মূল্য অর্ধেক হয়ে যেতে পারে, তা মনু মিয়া চিন্তাও করতে পারেননি। আসলে শেয়ারবাজার মনু মিয়াদের জন্য নয়। এটা আমাদের দেশে জমি বেচা-কেনার মতো কোনো ব্যবসাও নয়। সত্যিকার অর্থে শেয়ার ব্যবসা বলতে কোনো কিছু নেই, আছে শেয়ারে বিনিয়োগ। কিন্তু সেই বিনিয়োগ থেকে সপ্তাহ-মাসে কোনো লাভ আসবে না। লাভ আসে দীর্ঘ মেয়াদে_এক, দুই, তিন বছরে। এত দিন আমাদের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কি ধৈর্য আছে? আর জানতে হবে শেয়ারের ফান্ডামেটালস (ভঁহফধসবহঃধষং), যেগুলো শেয়ারমূল্যকে ওঠাবে। কিছু না জেনে হঠাৎ করে শেয়ারবাজারে প্রবেশ করলে তো অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু দুঃখ হলো, লাখ লাখ শিক্ষিত অবুঝ লোক শাস্তি পেল, কিন্তু যারা ডাকাতি করল তারা নিরাপদেই রয়ে গেল। এটাই হওয়ার ছিল, হয়েছেও বটে।
অন্য দেশের শেয়ারবাজারেও এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। তবে সেখানে রেগুলেটর অনেক বেশি তৎপর ছিল ঘটনা যাতে না ঘটে সেটা নিবারণ করার জন্য এবং ঘটে গেলে আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে। কিন্তু সেটা এই দেশেই শুধু অনুপস্থিত। আয়েশা আকতার মিউচ্যুয়াল ফান্ডের শেয়ার কিনেছিলেন ১০ টাকার ইস্যু মূল্যের বিপরীতে ৫৫ টাকায়। যখন আয়েশা ভুল বুঝতে পেরেছিলেন, তখন ওই মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মূল্য ২৮ টাকা। কিন্তু তখন ওই ফান্ডের মূল্য বেশি। কারণ ওইটার এনএভি বা সম্পদ ছিল ইউনিটপ্রতি ১৮ টাকা। আয়েশাকে বলা হয়েছিল, মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করা নিরাপদ। তিনি সেই কথা বিশ্বাস করে ফান্ড কিনতে গিয়ে অর্ধেক পুঁজি হারিয়েছেন। দেখা হলে আমি বললাম, ওই ফান্ডের মূল্য তো এনএভি ইউনিটপ্রতি সম্পদের কাছাকাছি হবে, আপনি অতমূল্যে কিনতে গেলেন কেন? আসলে আয়েশাদের কেউ বলেনি যে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মূল্য এনএভি দ্বারা শাসিত হয়। তাঁরা শুধু নিরাপত্তার কথাই শুনেছেন। ১০ মাস পর আয়েশার সঙ্গে দেখা। বললাম, এখন তো মিউচ্যুয়াল ফান্ড অনেক সস্তা। কোনো কোনো ফান্ড ভালো ডিভিডেন্ড বা ইউনিটপ্রতি মুনাফাও ঘোষণা করেছে। এখন মিউচ্যুয়াল ফান্ড কিনছেন না কেন? আয়েশা উত্তরে বললেন, এখন অর্থ ও ইচ্ছা_কোনোটাই নেই। টাকা হারানো নিয়ে তাঁর পরিবারে ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছে। তাঁর কাছে শেয়ারবাজারে লাভের চেয়ে পরিবারের শান্তিই মূল্যবান। আমি তাঁর কথা শুনে ব্যথিত হলাম। অলক্ষ্যে আমার হৃদয় থেকেও একটা দুঃখভরা 'হুঁ' বের হলো।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.