সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা-সরকারপ্রধান হওয়ার স্বপ্ন ছিল ইশরাকের by কামরুল হাসান

সরকারপ্রধান হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন ব্যবসায়ী ইশরাক আহমেদ। বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা ও বেসামরিক ব্যক্তির সমন্বয়ে নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার ছক তৈরি হয়েছিল। কীভাবে সেই রাষ্ট্র পরিচালিত হবে, তার রূপরেখাও প্রস্তুত করেন তাঁরা।


সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া লে. কর্নেল (অব.) এহসান ইউসুফ ও মেজর (অব.) এ কে এম জাকির হোসেন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব তথ্য জানান। গ্রেপ্তারের পর ৯ জানুয়ারি এই দুই কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর হাকিম শাহরিয়ার মাহমুদ আদনান ও কেশব রায় চৌধুরীর আদালতে জবানবন্দি দেন। আদালত সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জানতে চাইলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, তাঁরা এ ব্যাপারে কিছু জানেন না।
জবানবন্দি: আদালত সূত্র জানায়, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এহসান ইউসুফ বলেন, ইশরাক আহমেদকে তিনি চিনতেন তাঁর বড় ভাই লে. কর্নেল মেহবুবুরের বন্ধু হিসেবে। ১৯৭১ সালে তাঁরা দুজনই একসঙ্গে যুদ্ধ করেন। ইশরাক ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে পাস করেন। ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে অভ্যুত্থানের পর মেহবুব নিহত হন। এরপর হঠাৎ করে ইশরাক ডেনমার্কে চলে যান। ’৯০ সালের পর ইশরাকের সঙ্গে বছরে তাঁর দু-তিনবার দেখা হতো। ’৯৭ সালে স্টাফ কলেজ করার সময় এহসান জানতে পারেন, ইশরাক মহাখালী ডিওএইচএস এলাকায় বাসা নিয়েছেন। ওই বাসায় আলাপকালে ইশরাক তাঁকে বলেন, ১৯৯৬-এর অভ্যুত্থান তিনি ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন।
এহসান জবানবন্দিতে আরও বলেন, অবসরে যাওয়ার পর ২০০৯ সালে ইশরাক তাঁকে বাসায় ডেকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানে চাকরির প্রস্তাব দেন। ওই সময় বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে সেনাবাহিনীর ভেতরের অবস্থা সম্পর্কে ইশরাক জানতে চান। ইশরাক বিডিআর হত্যাকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁকে যোগাযোগ করে দিতে বলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি মেজর (অব.) জাকির এবং লে. কর্নেল (অব.) শামসের কাছে নিয়ে যান। তবে শামস তাঁকে ইশরাকের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা দিয়ে বলেন, ইশরাক সাহেব ষাটের দশকের সেনা কর্মকর্তাদের মতো ক্ষমতা দখলের চিন্তা করেন, যা বর্তমানে অচল।
এহসান আদালতে বলেন, ২০১১ সালে ইশরাক তাঁর কাছে জানতে চান, মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে কি না। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে ইশরাত তাঁকে একটি বই দিয়ে সেটি একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলকে দিতে বলেন। ওই ব্রিগেডিয়ারের সঙ্গে তাঁর আগে থেকে যোগাযোগ ছিল বলে জানান।
জবানবন্দিতে এহসান বলেন, ইশরাক তাঁকে বলেন, ইংল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোস্তাক আহম্মেদের সংগঠনের মাধ্যমে সেখানে একটি সেমিনার করা হবে। সেমিনারের মাধ্যমে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর সেনাবাহিনীতে যে ক্ষোভ এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে যে ঘটনা ঘটতে পারে, সে বিষয়টি পশ্চিমা বিশ্বকে জানানো হবে। তিনি বলতেন, ভবিষ্যতের জন্য চীন এ অঞ্চলের জন্য একটি ফ্যাক্টর। চীনা নেতাদের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ আছে। তিনি বলেন, ইশরাকের অনুরোধে গত বছরের জুলাই বা আগস্ট মাসে তিনি মেজর জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যান। মেজর জিয়া তখন আর্মি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটে (এমআইএসটি) পড়াশোনা করছিলেন। ইশরাক তাঁকে ধারণা দেন, মেজর জিয়া নেতৃত্ব দিতে পারবেন। তিনি মেজর জাকিরের কথাও বলেন।
এহসান হাকিমের কাছে বলেন, গত রমজান মাসের কোনো এক শুক্রবার বিকেলে তিনি মেজর জিয়াকে রিকশায় করে গুলশান শ্যুটিং ক্লাব থেকে ইশরাক সাহেবের বাসায় নিয়ে যান। জাকির আগেই ওই বাসায় গিয়ে হাজির হন। অভ্যুত্থানের পর সরকার কেমন হবে, তা নিয়ে সেখানে আলোচনা হয়। এ সময় কয়েকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা, আমলা, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম আলোচনা করা হয়।
সামরিক পরিকল্পনা: এহসান জবানবন্দিতে বলেন, ওই বৈঠকে মেজর জাকির জানান, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক অভিযান চালাতে তাঁরা প্রায় রওনা হয়েছিলেন। ইশরাক ধারণা করেছিলেন, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর কোনো অভ্যুত্থান হলে সবাই মনে করবে, সেটা এ হত্যাকাণ্ডের কারণেই হয়েছে। তিনি একটি সামরিক পরিকল্পনাও দেখান। এতে দেখা যায়, বিভিন্ন সেনানিবাস থেকে একটি ব্রিগেড আসবে। তারা ঢাকা সেনানিবাস, বঙ্গভবন ও গণভবন ঘেরাও করবে। প্রধানমন্ত্রীকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হবে। ৩৪ বেঙ্গল থেকে অনেক সেনাসদস্য সদর দপ্তরে অবস্থান করবেন। এরপর রাষ্ট্রপতি সরকার বাতিল করে ওই ব্রিগেডের প্রধানকে নতুন সেনাপ্রধান ঘোষণা করবেন। চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) করা হবে একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলকে। আর ব্যবসায়ী ইশরাক হবেন সরকারপ্রধান। ইশরাককে সরকারপ্রধান করার পেছনে কারণ ছিল, তিনি মুক্তিযোদ্ধা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হবে একজন মেজর জেনারেলকে।
এহসান আদালতে বলেন, ইশরাক সাহেবের ধারণা ছিল, ২০১১ সালে প্যারেড হবে না। তাই শীতকালীন মহড়ার আগেই সবকিছু করতে হবে। ইশরাক তাঁকে বলেন, একজন ব্রিগেডিয়ারের সঙ্গে তাঁর নিউইয়র্কে কথা হয়েছে।
কার কী দায়িত্ব: এহসান জবানবন্দিতে বলেন, এর দু-এক দিন পর ইশরাকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে উনি আলোচনা প্রসঙ্গে কিছু জেনারেলের নাম উল্লেখ করে বলেন, এঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নতুন সরকারে ইশরাকের অবস্থান কী হবে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কী হবে? সংবিধানে বিসমিল্লাহ এবং আল্লাহর ওপর আস্থা পুনঃস্থাপন করা, নারী অধিকার নীতি রহিত করা, হিজাব-ব্যবস্থা প্রবর্তন করা, ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা, শরিয়াহ আইনের প্রবর্তন, জাকাত ফান্ড গঠন, সিনেমা ও টিভিতে অশ্লীলতা বন্ধ করা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে শিক্ষামন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি সর্বোচ্চ কমিটি করা ইত্যাদি নিয়ে তাঁদের মধ্যে কথা হয়।
দ্বিতীয় বৈঠক: আদালত সূত্র জানায়, এহসান বলেন, এর কিছুদিন পর ঢাকায় ইশরাকের বাড়িতে তাঁদের দ্বিতীয় বৈঠক হয়। বৈঠকে ইশরাক বলেন, লন্ডনে তাঁদের সেমিনার সফল হয়েছে। ওই বৈঠকে ছোট ছোট দল কীভাবে অপারেশন করবে, সে পরিকল্পনা করা হয়। বৈঠকে সেনা কর্মকর্তাদের কাকে কী দায়িত্ব দেওয়া হবে, তা ঠিক করা হয়। কে কোথায় থাকবে, কার কী দায়িত্ব হবে, কীভাবে কে কাজ করবে, অস্ত্র ও গোলাবারুদ কোত্থেকে আনা হবে, কেউ মতের বাইরে গেলে তাকে কী করা হবে—এসব ঠিক করা হয়।
এহসান জবানবন্দিতে বলেন, ‘ওই বৈঠকে উপস্থিত জিয়া বলেন, অতীতে অভ্যুত্থানকারীদের হয় মরতে হয়েছে, না-হয় চলে যেতে হয়েছে। এখন আমাদের কী হবে।’ জবাবে ইশরাক বলেন, সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা করা হবে। পরিস্থিতি বিদেশিদের সামনে কীভাবে তুলে ধরা হবে, সে সিদ্ধান্তও হয়।
এহসান আরও বলেন, এর কয়েক দিন পর ইশরাকের সঙ্গে টিঅ্যান্ডটি ফোনে যোগাযোগ হয়। তখন তিনি বলেন, ডিজিএফআই তাঁর পিছু নিয়েছে। তিনি অজ্ঞাত স্থানে চলে যাবেন। এহসান বলেন, এরপর তিনি মুরগির খাবার সরবরাহের কথা বলে সাভারে একজন সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
এহসান বলেন, কোরবানির ঈদে ইশরাক দেশে ছিলেন না। কনফারেন্স কলের মাধ্যমে তিনি মেজর জাকিরের বাসায় সবাইকে ঈদের দিন একত্র হতে বলেন। সেখানে মেজর জাকির ও মেজর জিয়া একত্র হলে একজন পদস্থ কর্মকর্তার পিছু হটার ব্যাপারে তাঁরা হতাশা প্রকাশ করেন।
শেষ বৈঠক: এহসান আরও বলেন, ৯ ডিসেম্বর তাঁদের সর্বশেষ বৈঠক হয়। এ বৈঠকে অভ্যুত্থান পরিকল্পনা বাদ দেওয়ার জন্য একজন মেজর প্রস্তাব করেন। এরপর এহসান বগুড়ায় কর্মরত এক মেজরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ওই কর্মকর্তা বিষয়টি ফাঁস করে দেন।
আদালত সূত্র জানায়, মেজর জাকিরের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও একই ধরনের।
এ ধরনের ঘটনায় বেসামরিক আদালতে জবানবন্দি দেওয়া যায় কি না, এ প্রশ্নের জবাবে সাবেক সেনাপ্রধান হারুন-অর-রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, সেনা অপরাধে গ্রেপ্তার হওয়া কোনো ব্যক্তি বেসামরিক আদালতে গিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে পারেন। কিন্তু তিনি পরে যদি সংশ্লিষ্ট আদালতে এসে সেটা অস্বীকার করেন, তাহলে এর কোনো গুরুত্ব থাকবে না।
১৯ জানুয়ারি সেনাসদরের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টার বিষয়টি গত ১৩ ডিসেম্বর কর্মকর্তারা জানতে পারেন। এরপর ১৫ ডিসেম্বর রাতে সেনানিবাসের পাশে মাটিকাটা এলাকার বাসভবন থেকে এহসান ইউসুফকে এবং ৩১ ডিসেম্বর ইন্দিরা রোডে এক আত্মীয়ের বাসা থেকে জাকির হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ওই ঘটনার অনুসন্ধানে ঢাকায় একটি এবং ঢাকার বাইরে পাঁচটি তদন্ত আদালত গঠন করা হয়।
সেনাসদরের সংবাদ সম্মেলনের ১০ দিন আগে এই দুই কর্মকর্তা বেসামরিক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে চাইলে তাঁদের ঢাকা মহানগর আদালতে নেওয়া হয়। সেখানে মহানগর হাকিম শাহরিয়ার মাহমুদ আদনান তাঁর খাসকামরায় এহসান ইউসুফের এবং কেশব রায় চৌধুরী তাঁর খাসকামরায় জাকির হোসেনের জবানবন্দি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় রেকর্ড করেন। জবানবন্দি দেওয়ার আগে দুই কর্মকর্তাকে চিন্তাভাবনা করার জন্য তিন ঘণ্টা করে সময় দেন দুই হাকিম।
অবশ্য ১৯ জানুয়ারি সেনাসদরের সংবাদ সম্মেলনে দুই কর্মকর্তার জবানবন্দির প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাওয়া হয়।

No comments

Powered by Blogger.