বকর, আমরা ক্ষমা প্রার্থী... by মোমিন মেহেদী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। এই বিদ্যাপীঠে জীবন দিতে হয়েছে অনেককেই। অনেককেই চলে যেতে হয়েছে সময়ের অনেক আগেই। সেই অনেকের একজন আবু বকর সিদ্দিক; যাকে জীবনের টানাপড়েন আর কষ্টময় অন্ধকার থেকে মুক্তির জন্য প্রতিনিয়ত ছুটতে দেখেছি। সেই সময়সচেতন মেধাবী বন্ধুটিকে চলে যেতে দেখে যতটা না কষ্ট পেয়েছি, ততটাই ক্ষিপ্ত হয়েছি সরকার আর সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ওপর।


এ ছাত্রলীগ সেই ছাত্রলীগ, যে ছাত্রলীগ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে গড়া। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে ছাত্রলীগ চলে এসেছে অনেক দূর। এতটুকু বুঝতে পারি যে, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ প্রায় সব কমিটির পদ বিক্রি হচ্ছে টাকার কাছে। ৬৪ বছরের ইতিহাসকে কলুষিত করে পদ বিক্রি করছে আমাদের আলোকিত সমাজ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে নেতৃত্বে আসা অনেক নেতাই। আর এমন নেতাদের কারণেই আমরা হারাচ্ছি আবু বকর, ফারুক, জুবায়েরসহ অসংখ্য মেধাবীকে।
একটু ফিরে তাকালে দেখা যায়, সংবাদপত্র আবু বকর সিদ্দিকের মৃত্যুর পর খবর প্রকাশ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক জানিয়েছেন, আবু বকরের মৃত্যুর জন্য দায়ীদের অবশ্যই খুঁজে বের করা হবে। তিনি বলেন, 'যে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে সে কমিটি নিরপেক্ষভাবেই তদন্ত করবে এবং নিরপেক্ষতা বজায় রেখেই যে তারা তদন্ত করবে সেটা নিশ্চিত হয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।' সেই কথাগুলোর বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা এগিয়ে চলেছি অনাগত অন্ধকারের দিকেই। পরিত্রাণ প্রয়োজন এই অন্ধকার থেকে। আর তাই জেগে ওঠার এই আহ্বান। বন্ধু বকর চলে যাওয়ার পর, অনেকেই অনেকভাবে ব্যবহার করেছে তাকে। কেউ বলেছে, 'আবু বকর আমাদের বিপ্লবের অহঙ্কার।' কেউ বলেছে, 'আল্লাহর আইন নিয়ে আবু বকরের এই শাহাদাতবরণ আমাদের পথকে আরও শক্তিশালী করেছে।' আবার কেউ কেউ বলেছে, 'জাতীয়তাবাদের স্বপ্নে বিভোর আবু বকর আমাদের সচেতন করেছে।' আরও অনেক কথাই উঠে এসেছে এই মৃত্যুর ঘটনার মধ্য দিয়ে। কিন্তু সত্যিকারার্থে যে বিষয়টি আমাদের আলোড়িত করেছে তা হলো_ আবু বকর ব্যবহৃত হয়েছে মৃত্যুর পরও। এমন ব্যবহার রোধ করতে অবশ্যই ছাত্রশিবিরকে রুখতে হবে। যদি এ কাজে ব্যর্থ হই আমরা তাহলে স্লান হয়ে যাবে চেতনা। বন্ধু বকর চলে যাওয়ার পর কলামিস্ট আতাউস সামাদ লিখেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মলের কাছাকাছি তেমাথার সড়কদ্বীপে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ শিক্ষক, ছাত্র, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম লিখে রাখা হয়েছে স্মৃতির দেয়ালে। তারা সবাই দেশকে হানাদারমুক্ত করার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। সেখান থেকে একটু এগোলে মুহসীন হলের গেটের পাশে শহীদ রউফুন বসুনিয়ার আবক্ষ মূর্তি আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রউফুন বসুনিয়া আশির দশকে স্বৈরশাসনের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার আন্দোলনের সময় আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। টিএসসি চত্বরের উত্তর পাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের সীমানা ঘেঁষে আছে ডাক্তার শামসুল হক মিলনের স্মারক স্থাপত্য। তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে চিকিৎসকদের সংগঠিত করছিলেন। এবার স্যার এফ রহমান হলের গেটে বা সামনেই দৃশ্যমান কোনো এক জায়গায় নিহত মেধাবী ছাত্র আবু বকর সিদ্দিকের একটি প্রস্তরমূর্তি স্থাপন করা হোক। মূর্তিটিতে তার পরিচিতির নিচে লেখা হোক, সে ছিল এমন এক মেধাবী জীবন-সংগ্রামী, যার সেবা দেশ নিতে পারল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু বকর ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের দুই হল নেতার সিট-বাণিজ্যের সংঘাতে গুরুতর আহত হয় এবং ৩ ফেব্রুয়ারি চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। আবু বকর মেধার জোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল, তাই কোনো 'ভর্তি-বণিক' ছাত্রনেতাকে তার টাকা দিতে হয়নি। মেধাবী ও যোগ্য হিসেবেই সে হলে জায়গা পেয়েছিল। সে কোনো দল করত না। পড়াশোনা নিয়ে থাকত এবং পরীক্ষায় ভালো ফল করত। সে তার পড়াশোনার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছিল। সে ছুটিতে গ্রামের বাড়ি গেলে অন্যের জমিতে কৃষকের কাজ করে কিছু আয় করে পরিবারের হাতে দিয়ে আসত। নিহত হওয়ার কয়েক দিন আগে সে তার মাকে চিঠি লিখেছিল যে, তার পড়া প্রায় শেষ। শিগগিরই ভালো চাকরি পাবে, আর তখন পরিবারের ওপর দারিদ্র্যের কশাঘাত অনেক কমবে। আবু বকরের লড়াই ছিল অভাব-অনটন থেকে মুক্তির সংগ্রাম। বকরের মতো যাতে আর কেউ ঝরে না যায়, সেদিকে দৃষ্টি রেখে সবাইকে সচেতনতার আলোয় আলোকিত করতে প্রতিনিয়ত অনুভূত হচ্ছে বন্ধু বকরের হত্যাকারীদের বিচার বাস্তবায়ন ও ভাস্কর্য স্থাপনের তাগিদ।
য় ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.