নিবু নিবু গ্যাসের চুলাঃ গৃহিণীরা পেরেশান

কোনো কোনো এলাকায় দিনের বেলা গ্যাসের চুলা একেবারেই জ্বলছে না, কোথাও নিবু নিবু, কোথাও আবার এই গ্যাস এলো— এই চলে গেল! হয়তো রান্না অর্ধেক হয়ে এসেছে এমন সময় চুলার দম বন্ধ। তখন নিরূপায় হয়ে অনেকে গ্যাসের চুলার উপরেই কিংবা বারান্দা বা ছাদে মাটির চুলা বসিয়ে রান্নাবান্না সারছেন লাকড়ি পুড়িয়ে।

কেউ কেউ ব্যবহার করছেন কেরোসিনের চুলা বা সিলিন্ডার গ্যাস—এভাবেই নাকাল হচ্ছেন নগরবাসী। দিনের পর দিন রান্নার কাজে পেরেশানি পোহাতে হচ্ছে গৃহিণীদের। অনেকে হোটেলগুলোয় যাচ্ছেন খেতে কিংবা খাবার কিনে এনে খাচ্ছেন। এই হচ্ছে রাজধানী ঢাকায় গ্যাস সরবরাহের বর্তমান চালচিত্র। সঙ্কট মেটানোর দাবিতে প্রতিদিন শত শত অভিযোগপত্র জমা হচ্ছে তিতাস গ্যাসের অভিযোগকেন্দ্রগুলোতে। কিন্তু কোনো সুরাহা না হওয়ায় মিছিল, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন বিক্ষোভ কর্মসূচির আয়োজনও শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে তিতাস গ্যাসের কার্যালয় ঘেরাও, কর্মকর্তাদের মারধর, গাড়ি ভাংচুর ইত্যাদি অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেছে। সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, জনবিক্ষোভ আরও মারাত্মক দিকে মোড় নিতে পারে। কিন্তু সরকার তথা তিতাস কর্তৃপক্ষ কোনো আশার বাণী শোনাতে পারছে না।
জানা গেছে, বর্তমানে রাজধানীতে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা এক হাজার ৬৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের ওপরে। সরবরাহের পরিমাণ এক হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুটের কিছু বেশি। অর্থাত্ ঘাটতি থেকে যাচ্ছে প্রতিদিন আড়াইশ’ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। এই ঘাটতি পূরণের আশ্বাস আপাতত তিতাস দিতে পারছে না। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ সঙ্কট আরও প্রকট হতে পারে। উল্লেখ্য, প্রতি বছরই শীত মৌসুমে গ্যাসের ব্যবহার বাড়ে এবং ঘাটতি দেখা দেয়। শীতে রান্নার পাশাপাশি পানি গরম করতে বিপুল গ্যাস পোড়ে। এসব হিসাব মাথায় রেখেই গ্যাস সরবরাহের অঙ্ক কর্ষণ উচিত। এবার পৌষের শেষার্ধের প্রথম দিকে গ্যাস বিড়ম্বনা প্রায় তুঙ্গ স্পর্শ করেছে। জানা গেছে ঢাকার চল্লিশটি এলাকায় প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা করে গ্যাস সরবরাহ একেবারেই থাকে না। বেশকিছু এলাকায় গ্যাসের চাপ কম থাকায় চুলা জ্বলে নিবু নিবু। রান্না বা পানি গরম করতে সময় লাগে দ্বিগুণ, তিনগুণ। বর্তমানে ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুর, পলাশি, পূর্বাঞ্চলের অনেক স্থানে গ্যাস সঙ্কট মারাত্মক আকার নিয়েছে। এলাকা বিশেষে নির্ধারিত সময়ে কয়েক ঘণ্টা গ্যাস থাকলেও তার চাপ কম। সবচেয়ে ভোগান্তি পোহান দিনের বেলায় গ্যাস থাকে না এমন সব এলাকার বাসিন্দারা। এছাড়া বিভিন্ন ফ্ল্যাটবাড়ি, নিবিড় আবাসিক অঞ্চলও গ্যাস সঙ্কটে নাজেহাল।
গৃহস্থালির কাজকর্ম তো বটেই, গ্যাস সঙ্কটে রাজধানীর অনেক শিল্পকারখানাও খাবি খাচ্ছে। বন্ধ হয়ে গেছে অনেকটি। একই অবস্থা বিরাজ করছে ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোতেও। এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু সুরাহা হচ্ছে না কিছুই। সম্প্রতি তিতাস সূত্রে জানা গেছে, অব্যাহত গ্যাস সঙ্কটের আপতকালীন সমস্যা মোকাবিলায় সিএনজি স্টেশনগুলো সপ্তাহে অন্তত দু’দিন বন্ধ রাখা, সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে শিল্পকারখানার মতো ক্যাপটিভ বিদ্যুত্ কেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখাসহ আরও কিছু সুপারিশ করা হবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে বিদ্যমান সঙ্কট থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব নয়।
বলা দরকার, গত আগস্ট মাস থেকে সরকার গৃস্থালিতে ব্যবহৃত গ্যাসসহ সব শ্রেণীর গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে। আশা করা গিয়েছিল, এই দাম বাড়ার সঙ্গে সমতা রেখে গ্যাস সরবরাহ বাড়বে, বাড়বে সার্ভিসের মান। কিন্তু তা বাড়েনি। আসলে সমস্যা হচ্ছে, চাহিদার তুলনায় গ্যাসের উত্পাদন কম। এ অবস্থায় উত্পাদন বাড়াতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়া এবং তার বাস্তবায়ন ছাড়া গত্যন্তর নেই। আপাতত গ্যাসের সুষম বণ্টন এবং সার্ভিসের মান বাড়াতে হবে। অভিযোগ আছে গ্যাস বিতরণ ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে, দুর্নীতির মাত্রাও অব্যাহত রয়েছে আগের মতোই। এসব অনিয়ম সমূলে উত্পাটন ছাড়া সীমিত গ্যাসের সর্বোচ্চ সুষ্ঠু ব্যবহার অসম্ভব। পাশাপাশি গ্যাসের অপচয় কমাতে জনসচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ জরুরি। গণমাধ্যমে প্রচারণা ছাড়াও নানাভাবে গ্যাস সাশ্রয়ের ব্যাপারে সবাইকে অবহিতকরণের কাজ জোরদার করলে সঙ্কট মোচনে কম-বেশি সহায়ক ভূমিকা রাখবে। গ্যাসের চুলা ধরিয়ে রাখা, অনাবশ্যকভাবে পানি গরম করা, গ্যাসের আগুনে কাপড় শুকানো সচেতন নাগরিকের কাজ নয়। অনেকে অজ্ঞতাবশত এসব করেন। তাদের জানাতে হবে, গ্যাস কোনো অফুরান জ্বালানি নয়। এভাবে সার্বিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এগুলো করা সম্ভব হলে উদ্ভূত সমস্যার বহর কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। তবে উত্পাদন তথা গ্যাসের যোগান বাড়ানো ছাড়া মৌলিক কোনো সমাধান হবে না।

No comments

Powered by Blogger.