হাওর উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে কবে? by ড. নিয়াজ আহম্মেদ

দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের হাওর অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য সম্প্রতি ২০ বছরমেয়াদি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ মহাজোট সরকারের এক বড় সাফল্য। সিলেট বিভাগ এবং এর আশপাশের জেলার সমন্বয়ে গঠিত হাওর উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় এ মহাপরিকল্পনার দাবি দীর্ঘদিনের। মহাজোট সরকারের তিন বছরের মাথায় এ ধরনের উদ্যোগ এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে।


২০১১-২০১২ অর্থবছর থেকে বাস্তবায়নযোগ্য এ মহাপরিকল্পনায় ১৭টি উন্নয়ন ক্ষেত্রে ১৪৮টি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে ২০৩০-২০৩১ অর্থবছরে। উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে- কৃষি, জীববৈচিত্র্য ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা, মৎস্য, বন, স্বাস্থ্য, বসতি, শিল্প, জীবিকা, খাদ্য-পানীয়, বিদ্যুৎ, পর্যটন, যোগাযোগ ইত্যাদি। সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ আরো ১২টি মন্ত্রণালয় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করবে। ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের বিচারে সিলেটের বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে হাওর। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জসহ আরো কয়েকটি জেলা। সমতল অঞ্চলের তুলনায় এ অঞ্চল একটু ভিন্ন হওয়ায় আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক দিকে রয়েছে হাওরের প্রভাব। হাওর অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সবার কম-বেশি জানা। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় পানি বেষ্টিত থাকায় জীবনধারণ থেকে শুরু করে অন্য অনেক ক্ষেত্রে বিঘ্নের সৃষ্টি হয়। এটি হলো স্বাভাবিক ঘটনা। কখনো কখনো আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের মহাবিপদের দিকে ঠেলে দেয়। বোরো মৌসুমে আকস্মিক বন্যায় দুই বছর আগে সুনামগঞ্জের মানুুষ ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বেঁচে থাকার নূ্যনতম আশা-নিরাশায় পরিণত হয়। মোট কথা, এ অঞ্চলের মানুষ প্রাকৃতিক বিভিন্ন দুর্যোগের সঙ্গে মোকাবিলা করে বেঁচে আছে।
দীর্ঘদিন ধরে অবহেলায় থাকা হাওর অঞ্চলের মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে বর্তমান সরকারের মহাপরিকল্পনা, যার বাস্তবায়ন অচিরেই শুরু হতে যাচ্ছে। আমরা জানি, কৃষি আমাদের দেশের উন্নয়নের একটি বড় ক্ষেত্র। হাওর অঞ্চলের মানুষের কৃষি উন্নয়নের জন্য মহাপরিকল্পনায় ২০টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে- যেখানে আগাম বন্যা প্রতিরোধব্যবস্থা, বন্যা ব্যবস্থাপনা, চাষব্যবস্থা সম্প্রসারণসহ বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে। এ প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে আশা করব, হাওর অঞ্চলের কৃষির ব্যাপক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ সম্ভব হবে। কিন্তু একটি সমস্যা সব সময় থেকে যাচ্ছে, আর তা হলো, পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় বাঁধ সম্প্রসারণের কাজটি। শুকনো মৌসুমে বাঁধ নির্মাণ ও সম্প্রসারণের কাজ করা জরুরি। শক্ত ও মজবুত বাঁধ নির্মাণের ওপর নির্ভর করে ফসল ঘরে তোলার সাফল্য। বিদ্যমান মহাপরিকল্পনায় এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত। হাওর অঞ্চলের মানুষ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা থেকে বরাবরই বঞ্চিত ও অবহেলিত। মহাপরিকল্পনায় শিক্ষা ক্ষেত্রে সাতটি ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ১৬টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ অঞ্চলের মানুষের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত পরিবহন ও যোগাযোগব্যবস্থা। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ভূখণ্ড পানিতে নিমজ্জিত থাকায় ছেলেমেয়েদের পক্ষে বিদ্যালয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। কাজেই যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ছাড়া এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা কঠিন।
পর্যটনে অপার সম্ভাবনার অঞ্চল হিসেবে সিলেট বিভাগকে গণ্য করা হয়। পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের জন্য মহাপরিকল্পনয় ১৩টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা অবশ্যই চাইব, পর্যটন শিল্পের বিকাশ; কিন্তু পরিকল্পনা ও ঝুঁকিপূর্ণ পর্যটন শিল্পের বিকাশ আমাদের জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। বিদ্যমান প্রাকৃতিক এবং সামাজিক পরিবেশ ও প্রতিবেশ ঠিক রেখে আমরা যদি পর্যটন শিল্প গড়তে পারি, সে ক্ষেত্রে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করাও সহজ হবে। মৎস্য সম্পদের উন্নয়নের জন্য মহাপরিকল্পনায় সর্ববৃহৎ ২২টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা অনেকেই জানি, হাওর মৎস্য সম্পদের একটি বড় ভাণ্ডার। মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ ও বৃদ্ধির জন্য মাছের অভয়ারণ্য সৃষ্টি করা সময়ের দাবি। এটি করতে না পারলে আগামী প্রজন্মের কাছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পরিচয় ঘটানো অসম্ভব হবে। মৎস্যজীবীদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ, মৎস্যের সঠিক বাজারজাতকরণ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার ব্যবস্থা গ্রহণ, হাওর অঞ্চলে মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প স্থাপনসহ বিভিন্ন প্রকল্পের কথা পরিকল্পনায় উল্লেখ রয়েছে। এ প্রকল্পগুলোর সঠিক বাস্তবায়নের মধ্যে হাওর অঞ্চলের মৎস্য সম্পদের উন্নয়ন ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটি নবদিগন্ত উন্মোচিত হবে- এমনটি আশা করা অবান্তর নয়।
হাওর অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি হাওর উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা এখন বাস্তবায়নের পথে। এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য মহাজোট সরকারের এ উদ্যোগের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন আমরা দেখতে চাই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কিছু অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। ভারত সরকার ইতিমধ্যে টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তারা যদি সত্যিই বাঁধ নির্মাণ করে, সে ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। সম্প্রতি পত্রিকার মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম, সারি নদীর উজানেও ভারত বাঁধ নির্মাণের চিন্তা করছে। এ ছাড়া সীমান্তবাঁধ নামে ভারত সরকার স্বাভাবিক পানিপ্রবাহের পথ বন্ধ করে দিচ্ছে। এর ফলে আমাদের এ অঞ্চল দারুণভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে। সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ থাকবে, ভারতের এ ধরনের উদ্যোগের ক্ষেত্রে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করার। যেকোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন বাস্তবায়নকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার সমন্বয় সৃষ্টি, বৃদ্ধি ও উন্নয়ন। নইলে দ্রুত ও কার্যকর ফল পাওয়া কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। এমনটি যেন না ঘটে।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান
ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
neazahmed_2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.