সংকট সমাধানে একযোগে কাজ করতে হবে-অর্থনীতি by আবুল হাসানাত

উভয় পক্ষের বৈঠক অর্থনীতিবিদদের নিয়ে, বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কার্যকর হবে। আলাপ-আলোচনায় সমস্যার সমাধান বেরিয়ে আসবে। কারণ মানুষই তো সমস্যা সৃষ্টি করে, তাই মানুষই তার সমাধান করবে। উপরন্তু আমরা মনে করি, অর্থমন্ত্রী একটু বিবেচক হলে এবং বাংলাদেশের গভর্নর একটু সাহসী হয়ে যুক্তিযুক্ত ব্যবস্থা নিতে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেন অবশ্যই বাংলাদেশ তার বর্তমান সংকট ও সমস্যা থেকে উতরে যাবে দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে অর্থনীতিবিদরা যেসব
মন্তব্য-বক্তব্য পেশ করছেন তাতে উদ্বেগ বাড়ছে। ডলারের মূল্য বৃদ্ধিতে নিত্যপণ্যের বাজার চড়ে গেছে। আর এটা বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়ের অভাবজনিত কারণে। বলা বাহুল্য, এক বছর ধরে ডলারের দাম অব্যাহত গতিতে বেড়েই চলেছে। বর্তমানে এলসি খুলতে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১৬ শতাংশের মতো। আমদানিকৃত সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। সাধারণ মানুষ, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত সমাজ প্রচণ্ড ধাক্কা খাচ্ছে। নিত্যব্যবহার্য খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বেড়েছে যেমন_ সয়াবিন তেল, চিনি, আটা, আদা ও রসুন। চালের মধ্যে মোটাটার মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে; নাজিরশাইল এবং মিনিকেট ৫৬ ও ৫২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গ্যাস-তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বাস ভাড়া বেড়েছে; আদাবর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ভাড়া ছিল ১৫ টাকা, এখন হয়েছে ২০ টাকা। আগে স্টপেজ ছিল কম; এখন পয়সা নেয়, টিকিট দেয় না। ফলে যত্রতত্র বাস থামে, যাত্রী ওঠে-নামে। তেমন যানজট না থাকলে দেড় ঘণ্টায় যাওয়া যায়; এখন লাগছে দু'ঘণ্টা। সময়ের অপচয় হচ্ছে। যাত্রীদের ভাড়া বেশি দিতে হচ্ছে। মধ্যবিত্তের একটি বিরাট অংশ দূরপাল্লার বাসের পরিবর্তে অটোরিকশা নির্বাচন করত। কারণ অনায়াসে তিনজন একসঙ্গে যাতায়াত করা যায়। কিন্তু সহজে পাওয়া যায় না; প্রায় দুর্লভ। যদিবা পাওয়া যায় এবং চালক রাজি হয়, তাহলে প্রথম শর্ত মিটারে যা উঠবে তার সঙ্গে ২০ টাকা বেশি দিতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক, দরদাম করে ভাড়া ঠিক করতে হয়। এই কিছুদিন আগেও আদাবর থেকে উত্তরা ১২ নম্বরে আসতাম ১৯০ টাকায়। এখন হয়েছে ৩০০। মাঝে মধ্যে আমাকে আসতে হয়। একমাত্র কন্যা ও নাতনিকে দেখার জন্য। এক হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। পিতা-মাতা কতবার আসতে পারে নিকটতম আত্মীয়ের খোঁজখবর নিতে_ এত টাকা ব্যয় করে। উপরন্তু দুটি সন্তান থাকলে স্কুলে যাওয়া-আসা ও পড়াশোনার জন্য ব্যয় ধরলে নিম্নবিত্ত কেন, মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস ওঠে পড়ে। অর্থনৈতিক দুরবস্থায় সমাজের একটি বিরাট সম্প্রদায় কাহিল হয়ে পড়েছে। উপরন্তু বাড়িভাড়া বেড়েছে; ওষুধের দামও বেড়েছে। চিকিৎসকদের ফিও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দুরবস্থা কাটিয়ে ওঠার পথের সন্ধান করতে এই বিরাট জনসংখ্যার মানুষ জানে না। কবির আশ্বাস_ সূর্যকরোজ্জ্বলে সব অন্ধকার ধুয়ে মুছে যাবে। ধন্য আশা কুহকিনী।
সমকাল (২৮.১.২০১২) জানিয়েছে, বাণিজ্যমেলার শেষ দিকে বিক্রি ও ভিড় বাড়ছে। গৃহস্থালি পণ্য, আসবাবপত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ প্রভৃতি স্টলে খুবই ভিড়। অর্থাৎ মানুষ কিনছে, কিনতে পারছে। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এসব নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্য, তাই কিনছে। ক্রেতা-দর্শনার্থীদের ভিড়ও উল্লেখযোগ্য। গড়ে প্রতিদিন ২ লাখ লোক বাণিজ্যমেলার ধরে নিলে এক মাসে হয় ষাট লাখ। বাংলাদেশের লোকসংখ্যা ১৬ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। তাহলে?
কাজেই অর্থনীতির কাহিল অবস্থায় সরকার উদ্বিগ্ন এবং বিরোধী দলগুলোর সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের বক্তব্য প্রদানের সুযোগ আছে। সবচেয়ে আতঙ্কের কারণ হচ্ছে, ডলারের দাম বৃদ্ধি, ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধি। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। দারিদ্র্য দূরীকরণে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও বিচারিক সংস্কৃতি গণমুখী করা দরকার। ড. আবুল বারকাত বলেছেন, দারিদ্র্য নিরসনে সরকার ভুল পথে হাঁটছে। বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি পরিবারের নিজের বাড়ি নেই। গ্রাম-শহর নির্বিশেষে আবাসনের দারিদ্র্য বেড়েই চলেছে। তিনি আরও বলেছেন, বসের চেয়ারের পেছনে যতদিন তোয়ালে থাকবে ততদিন ঔপনিবেশিক মানসিকতাও যাবে না। (কলাম লেখক যখন বাংলা একাডেমীর পরিচালক পদে উন্নীত হলেন তখন তাকে দামি চেয়ারে বসার ব্যবস্থা করে চেয়ারের পেছনে তোয়ালে দিল। কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল। কয়েকদিন পর আহমদ শরিফ স্যারের বাসায় গেছি চিরাচরিত নিয়মে আড্ডা দিতে। কথায় কথায় তোয়ালের প্রসঙ্গে বললে তিনি কঠোর ভাষায় এবং ভুরু কুঁচকে বলে ওঠেন, কালই ওটা ফেলে দেব। যত সব
কৈবর্তের বংশ)।
বিশেষজ্ঞদের আরও অভিমত আছে। তারা (ড. আকবর আলি খান, ড. এবি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম ও ড. সালেহ উদ্দিন) যা বলেছেন তার চুম্বক হচ্ছে, সরকারকে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। প্রয়োজনে ঋণের বিকল্প উৎস খুঁজতে হবে। বেসরকারি খাতে ঋণ সংকোচন করলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। ব্যাংক আমানত ও ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার বেঁধে দেওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সরকারের রাজস্বনীতি বর্তমান মুদ্রানীতির জন্য খুব একটা সহায়ক নয়। উপরন্তু এটা বাস্তবসম্মত নয়। বিষয়টি সমকাল স্পষ্ট করেছে :সংযত মুদ্রানীতি নামে বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। এর ফলে চলতি জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সার্বিক মুদ্রা সরবরাহ হ্রাস পাবে। কিন্তু এতে দেশে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে নিম্নগতির রাশ টেনে ধরার যে লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে, তার ওপর সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে ব্যাংকের সুদহার বৃদ্ধি ও ঋণ নেওয়ার প্রবণতা আরও হ্রাস পাবে বলে সার্বিক বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদন পরিস্থিতির ওপর চাপ পড়ে রাজস্ব আয় আরও হ্রাস পাওয়ায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতেও বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। নির্বাচন সামনে থাকায় সরকারের অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় হ্রাসের মাধ্যমে অর্থ সাশ্রয়ের যে উদ্দেশ্য ব্যক্ত হয়েছে, তা আদৌ বাস্তবায়নযোগ্য কি-না সন্দেহ। (সম্পাদকীয় সংযত মুদ্রণনীতি_ আর্থিক ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হোক, ২৮ জানুয়ারি ২০১২)।
কাজেই সরকার ও বিরোধী পক্ষের উচিত, দেশের এই অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলার জন্য একযোগে কাজ করা। উভয় পক্ষের বৈঠক অর্থনীতিবিদদের নিয়ে, বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কার্যকর হবে। আলাপ-আলোচনায় সমস্যার সমাধান বেরিয়ে আসবে। কারণ মানুষই তো সমস্যা সৃষ্টি করে, তাই মানুষই তার সমাধান করবে।
উপরন্তু আমরা মনে করি, অর্থমন্ত্রী একটু বিবেচক হলে এবং বাংলাদেশের গভর্নর একটু সাহসী হয়ে যুক্তিযুক্ত ব্যবস্থা নিতে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেন অবশ্যই বাংলাদেশ তার বর্তমান সংকট ও সমস্যা থেকে উতরে যাবে। সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে ধীরে ধীরে। নির্ভুল পদক্ষেপে অগ্রসর হতে হবে। তড়িঘড়ি কোনো নির্দেশ নয়, সাময়িক লাভজনক কোনো নির্দেশ নয়। বলাবাহুল্য, সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে ক্যাবিনেটের প্রথম (ঋরৎংঃ ধসড়হম বয়ঁধষং) হিসেবে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

আবুল হাসানাত :গবেষক ও কথাশিল্পী

No comments

Powered by Blogger.