বিসিএস পদোন্নতিতে বৈষম্যের শিকার স্বাস্থ্য ক্যাডার by ড. তুহিন ওয়াদুদ

স্বাস্থ্য বিভাগ সম্পর্কে সাধারণ জনগোষ্ঠী থেকে শুরু করে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী_সবার একটি নেতিবাচক ধারণা আজ প্রায় প্রতিষ্ঠিত। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থেকে আমরা দূরে আছি বলে আজ আমাদের চিকিৎসা পদ্ধতির এই করুণ পরিণতি। চিকিৎসক হওয়া মানে অনেক বেশি মানবিক হওয়ার পরিবর্তে অনেক বেশি বিত্তবান হওয়া_এই স্বপ্ন এবং সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের দেশে চিকিৎসা পেশায় মেধাবীরা তাঁদের মেধা বিনিয়োগ করে থাকেন।


তা ছাড়া মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত হবে_এমন কোনো শিক্ষা মেডিক্যাল কলেজগুলোতে দেওয়া হয় না। রসিকতা করে তাই অনেকে বলেন, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়াররা উচ্চ মাধ্যমিক পাস। এই রসিকতা হয়তো চিকিৎসকদের আহত করে না। কিন্তু রাষ্ট্র যখন তাঁদের সঙ্গে নির্মম রসিকতা করে, তখন সত্যিই কিন্তু ডাক্তারদের আহত হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। লেখাপড়া শেষ করার পর পিএসসির অভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন ক্যাডারের মতো চিকিৎসা ক্যাডারের কর্মকর্তা হন চিকিৎসকরা। চাকরির একই বিধিমালা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কথা বিসিএস কর্মকর্তাদের। অথচ কী এক অজ্ঞাত কারণে চিকিৎসকরা পদোন্নতির ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্যের শিকার হন, তার সমাধান আজ পর্যন্ত হয়নি। চিকিৎসকরা ছাড়া আর যত ক্যাডার আছেন, তাঁদের পদোন্নতি যত সহজে হয়, চিকিৎসকদের তত দ্রুত হয় না। চিকিৎসকরা ছাড়া চাকরিতে যোগদানের পর বিভাগীয় পরীক্ষা, সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা শেষে অন্যসব ক্যাডারের কর্মকর্তারা পদোন্নতির জন্য যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হন। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করার পর চিকিৎসকরা পাঁচ বছরের উচ্চতর শিক্ষা এবং এক বছর ইন্টার্নশিপ শেষ করার পর চাকরিতে আবেদনের যোগ্যতা অর্জন করেন। স্বাস্থ্য ক্যাডার ছাড়া উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর অন্যান্য ক্যাডারের জন্য মাত্র চার বছর, কখনো কখনো তিন বছরের লেখাপড়া শেষে তাঁরা বিসিএস পরীক্ষায় আবেদনের সুযোগ পান। চাকরিতে যোগদানের পর পদোন্নতির সময় দেখা যায়, উচ্চ মাধ্যমিক শেষে যাঁরা তিন কিংবা চার বছর লেখাপড়া করে এসেছেন, তাঁরাই পদোন্নতি পেয়ে দ্রুত ওপরের পদে চলে যান। কিন্তু যাঁরা মেডিক্যাল অফিসার পদে যোগদান করছেন, তাঁদের অধিক যোগ্যতা সত্ত্বেও পদোন্নতি হচ্ছে না। তাঁদের জন্য চাই আরো বেশি যোগ্যতা। তাঁদের উচ্চতর আরো কোনো ডিগ্রি থাকতে হবে পদোন্নতির জন্য। শুধু এমবিবিএস পাস করে যাঁরা মেডিক্যাল অফিসার হয়েছেন, তাঁদের অল্পসংখ্যক ছাড়া অনেকেই জীবনে চাকরির শেষে গিয়ে একটি পদোন্নতি পাবেন। তত দিনে হয়তো কৃষি কিংবা শিক্ষা ক্যাডারে যোগদান করা বিসিএসের একই ব্যাচে অন্যান্য কর্মকর্তা সর্বোচ্চ পদোন্নতি পেয়ে কৃষি কিংবা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হবেন এবং প্রশাসন ক্যাডারের ব্যাচমেট হয়তো সচিব হবেন। চিকিৎসকদের এই নির্মম বাস্তবতাকে ধারণ করে চাকরি করতে হয়। আমাদের দেশে আজও যাঁরা বেশি মেধাবী, তাঁরাই মেডিক্যাল কলেজে পড়েন। অথচ সবচেয়ে মেধাবীদের প্রতি সবচেয়ে বেশি বৈষম্য করা হচ্ছে। দেশে একমাত্র মেডিক্যাল অফিসার ছাড়া ছোট-বড় অন্য যেকোনো চাকরিতে চাকরিজীবীর পদোন্নতির নিয়ম এতটা কঠিন নয়। এমনও হয়েছে, সারা জীবন মেডিক্যাল অফিসার পদে থেকেই অবসরে যেতে হয়েছে। দেশের আর কোনো কর্মকর্তা কি কখনো যে পদে যোগদান করেন, সেই পদ থেকে অবসরে যান? যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদোন্নতির কথা বলি তাহলে দেখা যায়, প্রাথমিক পর্যায়ে তা অনেকখানি সহজ। দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের মাত্র দুই বছর পর, কোনো কোনো বিশ্ববিদালয়ে তিন বছর পর সহকারী অধ্যাপক হন। তবে এখানে পদোন্নতির জন্য স্বীকৃত জার্নালে আর্টিক্যাল প্রকাশনার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। এখানে পদ শূন্য থাকা সাপেক্ষে নয়, পদোন্নতির সময় হলেই একটি পরীক্ষার মাধ্যমে আপগ্রেডেশনে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ক্যাডারভিত্তিক চাকরিতে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করলে ক্যাডারদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হতো।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ্ েযখন একজন ১৫ বছর ধরে মেডিক্যাল অফিসার পদে চাকরি করেন এবং তাঁর অনেক জুনিয়র প্রশাসন ক্যাডারের একজন তরুণ কর্মকর্তা যখন সেই উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হয়ে আসেন, তখন সেই ইউএনওকে মনে-প্রাণে মেনে নেওয়াটা আর সহজ হয় না। ফলে চাকরির প্রতি বীতশ্রদ্ধ ভাব জন্ম নেয়। এর প্রভাব অনেক নেতিবাচক ফল বয়ে আনে।
চিকিৎসা ক্যাডারের দুরবস্থার জন্য চিকিৎসকরাও অনেকখানি দায়ী। বাংলাদেশ সার্ভিস নীতিমালা অনুযায়ী সরকারি চাকরিজীবীরা রাজনীতি করতে পারার কথা নয়। কিন্তু সরকারি চিকিৎসকরা রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন। আওয়ামী লীগ সমর্থিত স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) এবং বিএনপি সমর্থিত ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি, যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তারা আবার দলের পরিচর্যা করে। সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী রাজনীতি করা যাবে কি না_এই প্রশ্ন কোনো দলীয় সরকার করে না। বরং নিজেদের দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন তারাই এক রকম স্বাস্থ্য বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। এই দুই সংগঠন নিজেদের চাকরির সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেয় না। তারা থাকে দলীয় স্বার্থ সংরক্ষণের কাজে ব্যস্ত। এ দুটি সংগঠনের বাইরে চিকিৎসকদের আরো একটি সংগঠন আছে_বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)। এ সংগঠনটিও চিকিৎসকদের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি সম্পর্কে কোনো কথা বলে না। অথচ দিনের পর দিন একজন চিকিৎসক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন। চিকিৎসকদের পদোন্নতি নীতিমালা অন্যান্য ক্যাডারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রণয়ন করা দরকার। একই সঙ্গে পদ শূন্য না থাকলেও পদোন্নতি প্রক্রিয়া চালু হওয়া প্রয়োজন। তবে পদ শূন্য হওয়া সাপেক্ষে পদায়ন হবে। পদোন্নতির জন্য যোগ্য প্রার্থীদের পরীক্ষা নেওয়া সাপেক্ষে পদোন্নতির বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য ক্যাডারের দুরবস্থা দূর করতে হলে মেধাবীদের মেধার যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে।
চিকিৎসকরা দিনের পর দিন যদি অবহেলিত থাকেন, তাহলে একদিন মেধাবীরা আর চিকিৎসাবিজ্ঞানে লেখাপড়া করতে আগ্রহী হবেন না। তাঁদের কর্মজীবনে স্বস্তি না ফিরলে তাঁরা শুধু অর্থকেই মানসম্মান পরিমাপের মানদণ্ড মনে করবেন, যার প্রভাব শুধু নেতিবাচক ফল ছাড়া অন্য কিছুই বয়ে আনবে না।
লেখক : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.