চরাচর-শোক ও ইতিহাসের আগস্ট by বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

বাঙালির শোকের মাস আগস্ট। অনেক বরেণ্য গুণীজন এ মাসেই লোকান্তরিত হন, যাঁরা তাঁদের মহৎ কর্ম দিয়ে দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ভাবমূর্তিকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে অনস্বীকার্য ভূমিকা রেখে গেছেন। কর্মপরিধির গভীরতা অনুসারে মাত্র কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তির ওপর এখানে আলোকপাত করা হয়েছে। ৭ আগস্ট ১৯৪১ লোকান্তরিত হন বাংলা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ছিলেন বিরল ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তিনি সারা জীবনের সাধনায় বিশ্বমানে উন্নীত করে গেছেন। কবি দীনেশ দাশ লিখেছেন, 'তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা।' ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ মহাপ্রয়াণ ঘটে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও সাম্যের অগ্রপথিক জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ দেশি-বিদেশি চক্রান্তে কিছু ঘাতকের হাতে সপরিবারে শাহাদাতবরণ করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১১ আগস্ট ১৯০৮। ঘড়িতে তখন ভোর ৪টা। ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের কারণে সে সময় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা কিশোর ক্ষুদিরাম বসু। ফাঁসির আদেশ শুনে তিনি বলেছিলেন, মৃত্যুতে তার কিছুমাত্র ভয় নেই। ১৭ আগস্ট ২০০৬ আমরা হারিয়েছি 'স্বাধীনতার কবি' শামসুর রাহমানকে। ১২ আগস্ট ২০০৪ মৃত্যুবরণ করেন বহুমাত্রিক লেখক, গবেষক, ভাষাবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদ। ৭ আগস্ট গবেষণা বৃত্তি নিয়ে তিনি জার্মানিতে গেলে পাঁচ দিন পর মিউনিখ শহরের তাঁর ফ্ল্যাটের নিজ কক্ষে রহস্যাবৃত এ মৃত্যু ঘটে। ওই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি জামা'আতুল মুজাহিদীন জঙ্গি সংগঠনটি তাঁর ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালায়। চলতি বছরের ১৩ আগস্ট সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ এবং স্বনামধন্য সাংবাদিক আশফাক মুনীর মিশুক। দেশে সুস্থ ও শিল্পসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণে এবং ইলেকট্রনিক সাংবাদিকতার বিকাশে এই দুজন অসামান্য অবদান রেখেছেন। এ বছরের ১৫ আগস্ট পরলোকগমন করেন প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ, গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. মৃদুল কান্তি চক্রবর্তী। লোকসংগীত গবেষণা ও প্রচারে তিনি উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা রেখে গেছেন। এ ছাড়া ১৯৭৫ সালের ৫ আগস্ট কবি সিকান্দার আবু জাফর, ২০০৮ সালের ২১ আগস্ট বরেণ্য নাট্যব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ আল-মামুন, ২০০৫ সালের ১৬ আগস্ট প্রখ্যাত সুরকার সুবল দাস মৃত্যুবরণ করেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে তাঁর সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালালে ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। কিন্তু ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভি রহমান টানা ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। প্রথিতযশা সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, 'বাংলাদেশের জাতীয় শোকের মাস আগস্ট। সেই শোকের বদলে শক্তি ও সাহস জোগাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল।' উপরোলি্লখিত বরণীয়জনদের জীবন ও কর্ম ছিল দেশ ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিত। তাঁরাই আমাদের আগামী দিনের অনুপ্রেরণাদাতা ও পথপ্রদর্শক।
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

No comments

Powered by Blogger.