চরাচর-ভাওয়াল রাজবাড়ি : কালের সাক্ষী by সাইফুল ইসলাম খান

বিশাল দিঘি। শেষ বিকেলে দিঘির টলমল জলে ছায়া পড়ে রাজপ্রাসাদের। দিঘির স্বচ্ছ জলে দেখা যায়, হাতিফল গাছের পাতায় পাতায় বইছে ঝিরঝির বাতাস। বিদেশি পাম আর নারিকেলের শাখায় শাখায় আলোর নাচন। দক্ষিণের মূল ফটক পেরিয়ে রাজবাড়ির অভ্যন্তরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে নয়নাভিরাম ফুলবাগান, ফুলবাগানের মাঝখানে মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য। বাগান শেষ হলেই সৌকর্যমণ্ডিত কাছারি ঘর। কাছারি ঘর পার হলেই চমৎকার নাটমন্দির।


নাটমন্দির দেখে অনুমান করা যায় রাজার শান-শওকত ও প্রভাব-প্রতিপত্তির কথা। এটি ভাওয়াল রাজবাড়ি। ঐতিহাসিক ভাওয়াল পরগনার রাজবাড়িটি বর্তমানে গাজীপুর জেলার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় নামে সমধিক পরিচিত। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে গাজীদের জমিদারি নিলামে উঠলে তাদেরই পরগনার দেওয়ান জানকীনাথ রায় তা নিলামে কিনে নেন। ময়মনসিংহের গারো পাহাড় থেকে ঢাকার বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত এক হাজার ৬০০ বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত ছিল ভাওয়াল পরগনা। এ সময় থেকেই ভাওয়াল রাজবংশের ইতিহাস শুরু; যার সমাপ্তি ঘটে ভাওয়াল সন্ন্যাসী নামে খ্যাত রাজা রমেন্দ্র নারায়ণ রায়ের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে, ১৯৪৬ সালে। সে সময় উপমহাদেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলাটি ভাওয়াল রাজবাড়ির অবিচ্ছেদ্য অংশ। রাজা রমেন্দ্র নারায়ণের পূর্বপুরুষ ভাওয়াল রাজবংশের আরো এক কৃতী সন্তান, রাজা কালীনারায়ণ রায় চৌধুরী ১৮৬০-৬১ খ্রিস্টাব্দে রাজবাড়ির সামনের মূল ভবনটি নির্মাণ করেন। জয়দেবপুরে যা কিছু প্রাচীন স্থাপনা, যেমন শিববাড়ীর শিবমন্দির, শ্মশানের শিবমন্দির, শ্রীশ্রী মানিক্য মাধবের দেবমন্দির, রানি বিলাসমণি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়_এ সবই ভাওয়াল রাজবংশের রাজাদের সময়ে নির্মিত। রাজবাড়ির অভ্যন্তরে আছে খাজাঞ্চিখানা, তোষাখানা, দেবমন্দির, নাটমন্দির, আস্তাবল, হাতিশালা, বিলাস মহল, হাওয়া মহল। রাজবাড়ির পশ্চিম পাশে পাড় বাঁধানো দিঘিটি বর্তমানে রাজদিঘি নামে পরিচিত। ৩৬৫ কক্ষবিশিষ্ট এ বিশাল রাজবাড়িতে আছে সরকারের অনেক দপ্তরের জেলা অফিস। আছে কোর্ট-কাছারি, জেলা প্রেসক্লাব, সোনালী ব্যাংকের একটি শাখা, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির জেলা ইউনিট অফিস। জেলা বার কাউন্সিলের জেলা অফিসও এ রাজবাড়িতেই অবস্থিত। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশে সিরিজ বোমা হামলার সময় এখানে বোমা হামলা চালানো হয়। এরপর সে বছরই নভেম্বরের ২৯ তারিখে আইনজীবীদের বসার কক্ষে বোমা হামলা সংঘটিত হয়। আত্মঘাতী এ হামলায় চার আইনজীবী নিহত হন। জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে শুরু করে জেলা তথ্য অফিসারের কার্যালয় রাজবাড়িতে অবস্থিত হলেও রাজবাড়ি সম্পর্কে এখানে কোনো তথ্যসেবাকেন্দ্র নেই। নেই যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও নির্মাণশৈলীতে অনন্য এ রাজবাড়ি দেখতে সারা বছরই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটক ও দর্শক আসেন। কিন্তু রাজবাড়ি সম্পর্কে কোনো তথ্যসেবাকেন্দ্র না থাকায় শুধু চোখে দেখা ছাড়া এই ঐতিহাসিক স্থাপনা সম্পর্কে কোনো ধারণা বা তথ্য তাঁরা পান না। সমৃদ্ধ ভাওয়াল পরগনার ইতিহাস ও ভাওয়াল রাজবংশের শেষ স্মৃতিচিহ্ন রাজবাড়ির যথাযথ সংরক্ষণে এখানে একটি তথ্যসেবাকেন্দ্র স্থাপন করা জরুরি। পাশাপাশি নিরাপত্তার বিষয়টিও নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
সাইফুল ইসলাম খান

No comments

Powered by Blogger.