কল্পকথার গল্প-ভিলেন বৈরী বৃষ্টি এবং হাইওয়ে টু হেভেন কিংবা লাইসেন্স টু কিল by আলী হাবিব

হাইওয়ে টু হেভেন নামে টিভি সিরিজ ও লাইসেন্স টু কিল সিনেমার কথা এখনো অনেকের মনে থাকার কথা। এনবিসি টেলিভিশনে ১৯৮৪ সালে সম্প্রচার শুরু হয়েছিল হাইওয়ে টু হেভেন। পাঁচ বছরে ১১১ এপিসোড সম্প্রচার হয়েছিল। এই সিরিজে মাইকেল ল্যান্ডন অভিনয় করেছেন দেবদূত জোনাথন স্মিথের ভূমিকায়, যাঁকে স্বর্গ থেকে পাঠানো হয়েছে।

ঈশ্বরের কাছ থেকে বিশেষ কিছু দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন জোনাথন স্মিথ। পৃথিবীতে এসে জোনাথন স্মিথ বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন মার্ক গর্ডনের সঙ্গে। তাঁদের বন্ধুত্বের মধ্যে মাঝেমধ্যে ঝামেলা যে হয় না, তা নয়। কিন্তু তাতে বন্ধুত্বে ভাঙন ধরে না। বন্ধুত্ব আরো গভীর হয়। জোনাথন স্মিথকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিল মানুষের পাশে দাঁড়াতে। দুর্গত, আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোটাই ছিল তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালন করতে পারলে তিনি আবার ফিরে পাবেন তাঁর স্বর্গীয় পাখা। সেই পাখায় ভর করে আবার তিনি উড়ে যেতে পারবেন স্বর্গের উদ্যানে। কিন্তু মার্ক গর্ডন ছাড়তে চান না তাঁকে। তখন তাঁদের দুজনের মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়ান স্বয়ং ঈশ্বর।
ইয়ান ফ্লেমিংয়ের পৃথিবী বিখ্যাত গোয়েন্দা সিরিজ জেমস বন্ড। এই সিরিজের ষোড়শ কাহিনী লাইসেন্স টু কিল। ১৯৮৯ সালে মুক্তি পায় ছবিটি। রেকর্ড ব্যবসা করা এই ছবির মূল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন টিমোথি ডালটন। এ ছবিতে অনেক নিষ্ঠুরতা দেখানো হয়েছে। জেমস বন্ডের এক বন্ধুকে প্রায় পঙ্গু করে ফেলে এক ড্রাগ ব্যবসায়ী। হত্যা করে বন্ধুর স্ত্রীকে। জেমস বন্ডের ছিল হত্যার অধিকার। শত্রু মনে করলেই তাঁকে হত্যার লাইসেন্স দেওয়া ছিল তাঁকে। কিন্তু ড্রাগ ব্যবসায়ীদের শত্রু মনে করে না এমআই সিঙ্। জেমস বন্ডের হত্যার লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া হয়। এভাবেই এগোয় ছবি।
না, সিনেমা কিংবা টিভি সিরিজ নিয়ে আলোচনা আজ নয়। আমাদের মন বেদনায় ভারাক্রান্ত। মনের আর কী দোষ? এভাবে অকালে দেশের সম্পদহানির ঘটনা ঘটলে মন কি আর ভালো থাকতে পারে? এমনিতেই আগস্ট আমাদের জন্য একটি শোকের মাস। আগস্টেই জঙ্গিবোমায় কেঁপে উঠেছিল সারা দেশ। এই আগস্টেই দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাণহানির চেষ্টা করা হয়েছিল। এই আগস্টেই গ্রেনেড হামলায় প্রাণ দেন আইভি রহমান। এই আগস্টেই কেড়ে নেওয়া হলো গানের ভুবনের স্বপ্নচারী মানুষ মৃদুলকান্তি চক্রবর্তীকে। কেড়ে নেওয়া হলো স্বপ্নদ্রষ্টা চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ এবং খ্যাতিমান সিনেমাটোগ্রাফার ও টিভি সাংবাদিক মিশুক মুনীরকে। এভাবে একের পর এক সম্পদহানি হতে থাকলে কারই বা ভালো লাগে? দেশের সম্পদ ছিলেন তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর। একটি সড়ক দুর্ঘটনা কেড়ে নিল তাঁদের। এই শূন্যতা কি কোনো দিন পূরণ হবে? আবার কবে একজন তারেক মাসুদ কিংবা একজন মিশুক মুনীরকে জন্ম দেবে এই দুর্ভাগা দেশ?
খবরের কাগজে চোখ রাখলে সড়ক দুর্ঘটনার খবর। টেলিভিশনের খবরে সড়ক দুর্ঘটনার খবর। এমন কোনো দিন নেই, যেদিন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে না। বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির হার অনেক বেশি। সরকারি হিসাবে, প্রতিবছর তিন থেকে চার হাজার, বেসরকারিভাবে ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এনজিওদের হিসাবে এই সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। বিআরটিএ জানিয়েছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে ৩০ জন সাধারণ নাগরিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। সে অনুযায়ী বছরে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজার ৮০০। সরকারি হিসাবে গত ২০ বছরে দেশব্যাপী ৬৩ হাজারের অধিক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৪৫ হাজার মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছে প্রায় ৫৫ হাজার মানুষ। বলাই বাহুল্য, আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েই চলেছে দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা। 'রোড সেফটি সেল অব বাংলাদেশ' থেকে প্রকাশিত রিপোর্ট বলছে, দুর্ঘটনায় পতিত ৭০ ভাগ মানুষই ১৬ থেকে ৫০ বছর বয়সী। এ ছাড়া দুর্ঘটনাকবলিত ছয়জনের মধ্যে একজন মৃত্যুবরণ করেন এবং ১৯ ভাগ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনায় অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। ইউনিসেফের এক রিপোর্ট বলা হয়েছে, দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে প্রতিবছর ৩০ হাজার মানুষের মধ্যে দুর্ঘটনায় পতিত তিন হাজার ৪০০ শিশু মৃত্যুবরণ করে। যার অধিকাংশই গরিব পরিবারের সন্তান। গবেষণা মতে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৩৪ ভাগ পরিবারের প্রধান ব্যক্তিই নিহত হন।
বাংলাদেশে যে হারে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে, তাতে আমাদের হয়তো অদূর ভবিষ্যতে নন্দলাল হয়ে ঘরে বসে থাকতে হবে। যেভাবে প্রতিদিন রাজপথে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল, তাতে এগুলোকে দুর্ঘটনা না বলে বোধ হয় হত্যাকাণ্ডই বলা যেতে পারে। এই সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশের দুই সম্পদ কেড়ে নিয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মৃত্যুর পর ঘরে-বাইরে তোপের মুখে পড়েছেন সরকারের দুই মন্ত্রী। তাঁদের মধ্যে যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সময় থাকতে রাস্তাঘাট মেরামতের কোনো ব্যবস্থা করেননি। কেন করেননি? যোগাযোগমন্ত্রী একেক সময় একেক রকম জবাব দিয়েছেন। কখনো তিনি বলেছেন, সড়ক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় টাকার বরাদ্দ ছিল না। কখনো বলেছেন, রাস্তা ভালো ছিল। ভালো রাস্তা খারাপ হলো কেমন করে? যোগাযোগমন্ত্রী এখানেও একটি সরল সমীকরণ করে ফেলেছেন। তিনি বলেছেন, বৃষ্টিতেই রাস্তাঘাট খারাপ হয়ে গেছে। অর্থাৎ দেশের সড়ক-মহাসড়ক যে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে, এর জন্য সড়ক মেরামত ও উন্নয়নের কাজ না হওয়া যতটা না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী বৃষ্টিপাত। এখানে বৃষ্টিপাতই ভিলেন। যোগাযোগমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, 'বৃষ্টির মধ্যে তো কাজ করতে সমস্যা হয়। উন্নয়ন কাজের জন্য রোদ ও খরা লাগে।' যখন রোদ ছিল, তখন সংস্কার কাজ করেননি কেন_এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল যোগাযোগমন্ত্রীকে। তিনি জানিয়েছেন, তখন নাকি রাস্তাঘাট এত খারাপ ছিল না। বৃষ্টির জন্য এই সমস্যা হয়েছে। আসলে মন্ত্রী খুব সরলভাবে বলতে চেয়েছেন, বৃষ্টির কারণেই আজ দেশের রাস্তাঘাট চলাচলের উপযোগী নেই।
ভিলেন বৃষ্টি! হাসিমুখ এক ভদ্রলোককে ঘরে-বাইরে নাস্তানাবুদ হতে হচ্ছে এই বৃষ্টির কারণে। বৃষ্টির ব্যাপারে আমাদের একটু আলাদা আবেগ আছে। সেই কবে থেকেই আমরা বলে আসছি, 'আয় বৃষ্টি ঝেঁপে/ ধান দেব মেপে।' বলছি, 'বিষ্টি পড়ে টাপুর-টুপুর...।' কিন্তু বৃষ্টির 'আক্কেলে' বোধ হয় খানিকটা ঘাটতি আছে। বৃষ্টি পড়ুক, আমাদের আপত্তি নেই। বৃষ্টি পড়ুক টিনের চালে। বৃষ্টি পড়ুক গাছের ডালে_কে আপত্তি করতে গেছে! কিন্তু বেয়াক্কেল বৃষ্টি কেন রাস্তায় পড়তে যায়! আমাদের আদুরে রাস্তা ভারি ট্রাকের ভার বহন করতে পারে, কিন্তু বৃষ্টির ফোঁটার আঘাত তার সয় না। বৃষ্টি রাস্তায় না পড়ে খানাখন্দ ভরিয়ে দিক। ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ব্যাঙ ডাকুক। একজন ভদ্রলোকের মুখের হাসি কেড়ে নেওয়া কেন? তাঁর রাতের ঘুুম কেড়ে নেওয়া কেন? রাস্তা দেখতে গিয়ে মন্ত্রী কেন নামতে পারবেন না গাড়ি থেকে? রাস্তা কেন অত খারাপ হবে? বৃষ্টি কি রাস্তা এড়িয়ে পড়তে পারে না? বৃষ্টিতে খারাপ হয়ে যাওয়া রাস্তায় ঘটছে দুর্ঘটনা। বৃষ্টির আর একটু সচেতন হওয়া দরকার ছিল। রাস্তায় পড়ার আগে বৃষ্টি যোগাযোগমন্ত্রীর অনুমতি অন্তত নিতে পারত।
আসা যাক গাড়িচালকদের প্রসঙ্গে। সারা দেশে পেশাদার চালকের লাইসেন্স আছে সাড়ে ছয় লাখ। এর মধ্যে এক লাখ ৮৯ হাজার ৫১৬ জন যোগ্যতার পরীক্ষা ছাড়া ফেডারেশনের তালিকায় লাইসেন্স পেয়েছেন। যোগ্যতার পরীক্ষা ছাড়াই লাইসেন্স আদায়ের অভিযোগ এক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে। তিনি প্রভাব খাটিয়ে নাকি লাইসেন্স আদায় করেন। মন্ত্রী যে ফেডারেশনের সভাপতি, সেই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের তালিকা ধরে যোগ্যতার পরীক্ষা ছাড়া গত ১৮ বছরে এক লাখ ৮৯ হাজার লোককে পেশাদার চালকের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। বিএনপি-আওয়ামী লীগ দুই সরকারের আমলেই নাকি এই ফেডারেশনের দেওয়া তালিকা ধরে এসব লাইসেন্স দেওয়া হয়। অভিযোগ আরো আছে। পরীক্ষা ছাড়া লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে মোটরযান আইনের এ-সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনাই মানা হয়নি। নতুন অভিযোগ, এখন আবার ২৮ হাজার লোককে একইভাবে পেশাদার ও ভারী যানবাহন চালকের লাইসেন্স দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন নৌমন্ত্রী। বিআরটিএতে নৌমন্ত্রীর তালিকা অনুযায়ী লাইসেন্স পাওয়া চালকদের বলা হয় 'খানসেনা'। যোগ্যতার পরীক্ষা ছাড়া লাইসেন্সের পক্ষে নিজের মতও তুলে ধরেছেন মন্ত্রী। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, 'সে যদি অশিক্ষিতও হয়, গরু-ছাগল, মহিষ-ভেড়ার ছবি তো সে চেনে। সিগন্যাল তো ছবি। ছবিটা সে চিনতে পারে কি না, সিগন্যালটা বোঝে কি না, সেটাই কথা।' এখানেই শেষ নয়। আরো যুক্তি আছে মন্ত্রীবাহাদুরের। আমাদের তো এক লাখ ৩০ হাজার চালকের অভাব আছে। এই ঘাটতি পূরণ করতে হবে। কেমন করে সেই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব? মন্ত্রীর যুক্তি, 'অশিক্ষিত চালকদেরও সহজ শর্তে লাইসেন্স দেওয়া দরকার।' মন্ত্রীর এই কথার সূত্র ধরে সম্প্রতি একটি কৌতুক বাজারে চালু হয়েছে। কৌতুকটি শেয়ার করা যাক।
আজকাল তো টিভি টকশো খুব জনপ্রিয়। রাস্তাঘাটের এই দুর্গতি ও দুর্ঘটনা নিয়ে টিভিতে নিয়মিত টকশো হচ্ছে। এমন এক টকশোতে উপস্থাপক জনৈক বিশেষজ্ঞকে প্রশ্ন করলেন, 'সড়কপথে দুর্ঘটনায় এত মানুষ মারা যাচ্ছে কেন?'
'রাস্তাঘাটে এখন যাঁরা গাড়ি চালাচ্ছেন, তাঁরা শুধু গরু-ছাগল, মোষ-ভেড়া চেনেন। মানুষ তো চেনেন না। এই কারণেই মানুষ এত বেশি মারা যাচ্ছে'_বিশেষজ্ঞের নির্বিকার উত্তর।
পুনশ্চ : আমাদের মন্ত্রীরা কবে মানুষ চিনবেন? আদৌ কোনো দিন চিনবেন কি?

লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.co

No comments

Powered by Blogger.