সহজিয়া কড়চা-অন্তর্দলীয় ও আন্তদলীয় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড by সৈয়দ আবুল মকসুদ

উপমহাদেশের রাজনীতিতে অন্তর্দলীয় কোন্দল ও শত্রুতা শুরু থেকেই ছিল। কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা, জনসংঘ, মুসলিম লীগের মধ্যে ছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে বিরোধ থাকা অস্বাভাবিক নয়। কখনো কখনো তা শত্রুতার পর্যায়ে গড়ায়। তবে এই অঞ্চলে আন্তদলীয় কোন্দল ও শত্রুতা সম্ভবত পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি।


দলের ভেতরে প্রতিদ্বন্দ্বী পরিণত হন শত্রুতে। এবং সে শত্রুতা এমন একটি পর্যায়ে যায় যে এক সহকর্মী আরেক সহকর্মীকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতেও দ্বিধা করেন না। নিজের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতৃত্বের পথ পরিষ্কার করাই একমাত্র লক্ষ্য। এ রকম রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে প্রচুর।
ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে পথের কাঁটা নিজের দলে, না অন্য দলে—সেটা বিবেচনার বিষয় নয়। কাঁটা তো কাঁটাই। সেটা সরিয়ে ফেলতে হবে। তা করতে গেলে সহকর্মী ও বন্ধুর বুকে ছুরি চালাতে হাত কাঁপে না অনেকেরই। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে যদি এ রকম খুনখারাবি হয়, তাহলে খুনি ও খুনের পরিকল্পনাকারী প্রশাসনের আনুকূল্য পেয়ে বেঁচে যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে নিহতের পরিবার খুব কমই সুবিচার পায়।
স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর সময় একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তখন কেন্দ্রের রেলমন্ত্রী ছিলেন ললিতনারায়ণ মিশ্র। জনসংঘের সভাপতি দীনদয়াল উপাধ্যায় ট্রেনে কোথাও যাচ্ছিলেন। রেললাইনের পাশে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়। রাজনৈতিক মহল ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা উপাধ্যায়ের মৃত্যুকে রাজনৈতিক খুন হিসেবে বিবেচনা করেন। তবে একই দলের ভেতরে শত্রুতামূলক খুনাখুনির ঘটনাও অজস্র।
দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যেও রাজনৈতিক বিরোধ থাকে। কিন্তু সে বিরোধ ব্যক্তিগত শত্রুতার পর্যায়ে গড়ায় না। সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত গান্ধীর সঙ্গে সুভাষ বসুর বিরোধ। কিন্তু তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব ছিল না। অসাম্প্রদায়িক, উদার ও উঁচু সংস্কৃতিসম্পন্ন নেহেরুর সঙ্গে মুসলিমবিরোধী সর্দার প্যাটেল ও রাজেন্দ্র প্রসাদের তীব্র মতপার্থক্য ছিল। তা থেকে সৃষ্টি হয় ব্যক্তিগত দূরত্ব। ফলে তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় বারো বছর রাষ্ট্রপতি থাকলেও রাজেন্দ্র প্রসাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সম্ভবত নেহেরু যোগদান করেননি। কিন্তু কোনো দিনই তাঁরা একে অপরের মৃত্যুর কামনা করেননি। বড় বড় দলে উপদলীয় কোন্দল ও নেতৃত্ব নিয়ে ব্যক্তিগত রেষারেষি খুবই থাকে, কিন্তু তা থেকে ব্যক্তিগত শত্রুতা ও খুনখারাবির ঘটনা ঘটে না।
সংসদীয় গণতন্ত্র মানেই বহুদলীয় গণতন্ত্র। বিভিন্ন দলের মধ্যে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তা নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচির। এক দলের নেতাদের সঙ্গে আরেক দলের নেতাদের যে বিরোধ তা ব্যক্তিগত না। একই দলের মধ্যেও এক নেতার সঙ্গে আরেক নেতার কোনো কোনো প্রশ্নে মতপার্থক্য থাকতে পারে। আবার একই নির্বাচনী এলাকায় একাধিক প্রভাবশালী নেতা থাকলে পরস্পরের মধ্যে একটা ঠান্ডা লড়াই চলতে পারে। তাঁদের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই থাকলেও তাঁদের সমর্থক ও কর্মীদের মধ্যে কখনো গরম লড়াই হয়ে যেতে পারে। তর্কাতর্কি, হাতাহাতি, জামার কলার ধরে টানাটানি, চেয়ার বা মাইকের ডান্ডা দিয়ে মাথা ফাটাফাটি পর্যন্ত হতে পারে। মাথার জখম শুকালে, ব্যান্ডেজ খোলার পর ওপরের নেতাদের মধ্যস্থতায় আবার মিটমাটও হয়ে যায়। এসব প্রকাশ্য ব্যাপার। কিন্তু ব্যক্তিগত শত্রুতা যখন মাত্রা ছাড়ায় তখন তা প্রকাশ্য হাতাহাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। সৃষ্টি হয় গোপন শত্রুতা। গোপন শত্রুতা কখনো ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। গোপন শত্রুতা থেকে প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ড বা গুপ্তহত্যা ঘটা সম্ভব।
আপাত অজাতশত্রু বলে যাদের মনে হয়, তাদেরও রাজনৈতিক শত্রু থাকে অদৃশ্য হয়ে, যেমন ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকে সবুজ সাপ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক দিন আগে আকাশবাণী এক মর্মান্তিক খবর দেয়। অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় বিপ্লবী নেতা, পরবর্তী সময়ে নেতাজী সুভাষ বসুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও ফরোয়ার্ড ব্লকের শীর্ষ নেতা হেমন্তকুমার বসু কলকাতার প্রকাশ্য রাজপথে অত্যন্ত নৃশংসভাবে আততায়ীর হাতে নিহত হন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একসময় তিনি মন্ত্রীও ছিলেন। তখন নকশাল আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। ধারণা করা হয়, উগ্র বামপন্থী তরুণেরাই তাঁকে হত্যা করে। তাঁর নিহত হওয়ার ঘটনাটি আমার মনে আছে এই জন্য যে, আমি ছিলাম আকাশবাণীর খবর ও রবীন্দ্রসংগীতের একজন নিয়মিত শ্রোতা। সেদিনের আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের সংবাদ বুলেটিনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটাই ছিল হেমন্ত বসুর হত্যাকাণ্ডের খবর। অন্য আর কোনো খবর নয়। ১৯৪৬ সাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কোনো নির্বাচনেই তিনি পরাজিত হননি। দলমত-নির্বিশেষে সবার কাছেই ছিলেন শ্রদ্ধেয়। তিনি জীবন দিলেন অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে।
রাজনীতিকেরা অজাতশত্রু হবেন, তা ভাবা ঠিক নয়। ফিলিপাইনে কোরাজন একুইনোর স্বামী নিহত না হলে কোরাজন নন তিনিই হতেন রাষ্ট্রপতি। শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের ক্ষেত্রে তা-ই। লেবাননে, শ্রীলঙ্কায় জনপ্রিয় নেতারা নিহত হয়েছেন। পাকিস্তানে বেনজির ভুট্টোসহ অনেক নেতা আততায়ীর হাতে প্রাণ হারান। ভারতে আঞ্চলিক নেতাদের অনেকে গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। তবে সেসব খুনের বিচারও হয়েছে। বাংলাদেশে কালীগঞ্জে ময়েজউদ্দিন, হবিগঞ্জে শাহ এ এম এস কিবরিয়া, গাজীপুরে আহসানউল্লাহ মাস্টারসহ অনেক নেতা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। আমাদের মতো দেশে বিরোধী দলের নেতারা মারা গেলে কার কী যায় আসে? মরেছে তো কী হয়েছে?
রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সব গণতান্ত্রিক রাজনীতির বৈশিষ্ট্য নয়। জার্মানি, জাপান, ব্রিটেন, ফরাসি দেশ, সুইজারল্যান্ড বা ফিনল্যান্ডের রাজনীতিতে গুপ্তহত্যার প্রবণতা নেই বললেই চলে। দুনিয়ার বহু ভালো ও কু জিনিসের সূতিকাগার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডও সেখানে বারবার ঘটছে দুই শ বছর ধরে। কয়েকজন প্রেসিডেন্ট তো নিহত হয়েছেনই, বর্ণবাদবিরোধী মহানায়ক মার্টিন লুথার কিং পর্যন্ত নিহত হন। তবে শারীরিকভাবে তাঁকে ধ্বংস করা গেলেও তাঁর স্বপ্নকে ধ্বংস করতে পারেনি তাঁর শত্রুরা। বারাক হোসেন ওবামার জয় লুথার কিং-এরই জয়। কোথাও রক্তারক্তি যতই হোক, যদি গণতন্ত্র থাকে তাহলে জনগণ শান্তিপূর্ণভাবে তাদের মতামত দিয়ে এই খেলাটা খেলতে পারে। তারা খুনিদের প্রতিশোধ নেয় নির্বাচনের সময়—ভোটের বাক্সে।
কুশাসন ও নষ্ট দলীয় রাজনীতিতে, যেখানে অন্তর্দলীয় ও আন্তদলীয় কোন্দল প্রচুর, বিরোধী দলের নেতা খুন হলে সরকারের বিশেষ কিছু করণীয় থাকে না। আল্লার মাল আল্লায় নিয়ে গেছেন—তারপর ফেরেশতারা বসে বসে তার পাপ-পুণ্যের হিসাব-নিকাশ করুন গিয়ে, সরকারের কী করার আছে? সরকারি দলের কোনো নেতা নিজ দলের কারও ষড়যন্ত্রে খুন হলে বিরোধী দলের কোনো উপযুক্ত নেতাকে কোমরে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে হাজতে ঢোকাতে মুহূর্ত দেরি হয় না। যদি হাতের কাছে বিরোধী দলের জুতসই কাউকে ফাঁসানোর জন্য না পাওয়া যায়, তাহলে নিহতের পরিবারের কেউ, বন্ধু-বান্ধব অথবা বাড়ির কাজের লোকদের আটক করলেই দায়িত্ব পালন করা হয়। তাও যদি সম্ভব না হয়, তাহলে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের যাঁরা সরকারের বিরুদ্ধে বেশি বেশি রিপোর্ট করেন তাঁদের কাউকে হোক, ফুটপাতের কোনো হকার হোক, ভাসমান দেহপসারিণীর দালাল হোক—দুএকজনকে ধরে হাজতে পুরতে সরকারের দ্বিধা নেই। দ্বিধা শুধু অভিযুক্ত যদি সরকারের কেউ হন তাঁকে গ্রেপ্তার করতে। গ্রেপ্তার তো দূরের কথা, তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদও নয়—তাঁর লোমটি পর্যন্ত স্পর্শ করতে সরকারের অশেষ অনীহা। নিহতের আদ্যশ্রাদ্ধ অথবা চেহলাম হওয়ার আগেই অভিযুক্ত বুক টান টান করে ঘুরে বেড়াতে থাকে।
সভ্য দেশে মাছ থাকে মাছের জায়গায়, শাক থাকে শাকের জায়গায়। সেসব দেশে মাছটাকে শাক দিয়ে ঢাকার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু কোনো কোনো দেশে ক্ষমতাসীনেরা মাছকে শাক দিয়ে এমনভাবে ঢাকেন যে মাছের মাথা তো দূরের কথা তার লেজের ফৈর পর্যন্ত দেখা যায় না।
হত্যার মতো বড় ধরনের অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর কেউ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করল কি না করল তার জন্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার মানুষদের বসে থাকার কথা নয়। আগে দেখেছি, অজ্ঞাতপরিচয় কেউ খুন হলেও রাষ্ট্র নিজেই বাদী হয়ে মামলা করে। কারও আবেদন অথবা আদেশ-নির্দেশের অপেক্ষায় না থেকে পুলিশ-গোয়েন্দারা স্বাধীনভাবে কাজ শুরু করে। প্রকৃত অপরাধীকে চিহ্নিত করতে বিভিন্ন সূত্র থেকে খোঁজ নিয়ে তদন্ত শুরু করে। সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তৈরি হয় মামলার চার্জশিট।
কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার অর্থ এই নয় যে সে অপরাধী। কে অপরাধী আর কে নির্দোষ তা সাব্যস্ত করার ভার আদালতের। অনেক সময় প্রকৃত অপরাধীও আদালতে গিয়ে নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করে বেরিয়ে আসে। অন্যদিকে এমন হতভাগ্যও আছে, যারা অপরাধ না করেও আইনের মারপ্যাঁচে, সাক্ষীসাবুদের অভাবে, শাস্তি ভোগ করে। কিন্তু যেটাই হোক, সবই আইনি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে স্বচ্ছভাবে হতে হবে। তার নামই আইনের শাসন।
যে রাজনীতিতে অর্থ ও পেশিশক্তিই প্রধান নিয়ামক, সেখানে জনগণ গৌণ। অর্থাৎ দলের পক্ষে জনসমর্থন থাকল কি না থাকল—কুচ পরোয়া নেই। নির্বাচনের দিন প্রয়োজনীয় ভোট জোগাড় হয়ে যাবে। উপযুক্ত ক্যাডার ভোটকেন্দ্রের বারান্দায় বা আশপাশের কোনো পাকুড়গাছের তলায় অত্যাধুনিক কিছু একটা হাতে নিয়ে সিগারেট টানতে থাকলে বিজয় ঠেকায় কে? ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতির উপকারিতা সেখানেই।
অপরাধ যে করে সে-ই অপরাধী। তার দলীয় পরিচয় ও সামাজিক অবস্থান যা-ই হোক। যে রাষ্ট্রে আইনের শাসন রয়েছে, সেখানে অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা রাষ্ট্রের অলঙ্ঘনীয় কর্তব্য। নরহত্যার মতো বড় অপরাধ নিয়ে দলীয় রাজনীতি করা জঘন্য অপরাধ। নৈতিক অপরাধ তো বটেই, সংবিধান লঙ্ঘন করার মতো রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক অপরাধও বটে। থানা-পুলিশ, কোট-কাছারি, ম্যাজিস্ট্রেট-বিচারক যা করার করবেন। ক্ষমতাসীন দলের কলকাঠি নাড়া ঘোরতর অন্যায়। কিন্তু নষ্ট গণতন্ত্রে ও স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তা-ই হয়। সে ব্যবস্থায় থানা-পুলিশ-হাকিম রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে নিরুপদ্রবে কাজ করতে পারেন না। চাকরি রক্ষায় বিবেকবহির্ভূত কাজ করেন।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হামেশাই ঘটে। স্থানীয় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অথবা ব্যক্তিগত শত্রুতাবশত অনেকে খুন হচ্ছেন। সেসবের দু-চারদিন কিছু খবর হয়, তারপর চুপ। নিহতের কুলখানির পর মানুষ ও মিডিয়া ভুলে যায়। সর্বশেষ হত্যাকাণ্ডটি নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। তিনি ছিলেন একটি পৌরসভার মেয়র। দেশের সেরা মেয়রদের একজন। তাঁর এলাকায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা। দলমত-নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ তাঁকে ভালোবাসতেন। ঘটনাক্রমে তিনি সরকারি দলের একজন জেলা পর্যায়ের নেতা। তিনি সম্পত্তি নিয়ে বিবাদে জ্ঞাতি আত্মীয়স্বজনের হাতে খুন হননি। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে তাঁর কোনো গণ্ডগোলের কথা শোনা যায়নি। নারীঘটিত কোনো ব্যাপারে লিপ্ত ছিলেন না। নিষ্ঠার সঙ্গে দল করতেন এবং তাঁর এলাকার উন্নতির জন্য সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতেন। তাঁর মতো জনপ্রিয়তা নেই, এমন কেউ তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থাকতে পারেন। তাঁর হত্যাকাণ্ডটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হিসেবেই বিবেচিত।
এসব স্পর্শকাতর ব্যাপারে সরকারের নীতিনির্ধারকদের উচিত ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া। হুট করে কিছু করতে গেলে বড় সমস্যা হয়। খুনের রক্ত শুকানোর আগেই একজন গ্রেপ্তার হলেন। এত দুঃখকষ্টের মধ্যেও বাংলাদেশে কয়েকটি প্রভাবশালী দৈনিক ও টিভি চ্যানেল আছে বলে রক্ষা। তা না থাকলে হত্যার পর যাকে গ্রেপ্তার করা হয় এত দিনে তাঁকে ফাঁসির সেলের দৈর্ঘ্যপ্রস্থ নিয়ে চিন্তা করতে হতো। তাঁর মা ও স্ত্রীকে ভাবতে হতো ফাঁসির আগের দিন দুপুরে তাঁর জন্য কী খাবার রান্না করে পাঠাবেন। যিনি গ্রেপ্তার হলেন তাঁর দলের বিশাল বাহিনী মহাসড়কগুলোতে লেফট-রাইট করছে। নেতা-কর্মীরা গাড়িতে চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া যাচ্ছেন, তাঁর মুক্তির জন্য তাঁর দল যা করেছে তা মামুলি। যা করার তা করেছে মিডিয়া। হপ্তা দুই হাজতে মহাজোটের আতিথ্য গ্রহণের পর তিনি মুক্তি পেয়ে ফুলের মালা পেয়েছেন। যারাই তাঁকে মাল্যভূষিত করুন, ওই মালার একটি প্রাপ্য মিডিয়ার, অন্যটি প্রাপ্য সরকারের নীতিনির্ধারকদের। সরকারের অতি বুদ্ধিমান নীতিনির্ধারকেরা ১৩ দিনে তাঁকে জাতীয় নেতা বানিয়ে দিয়েছেন। একবার স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আশির দশকে নাম করেছিলেন। আর এবার যে নাম করলেন তা হবে স্থায়ী।
সুবিচার চাইতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এখনো আসার সুযোগ পাননি নিহতের স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা। জেলার দলীয় এমপি ও নেতারা বনপোড়া হরিণের মতো দিগ্বিদিক ছুটছেন। রুদ্ধদ্বার বৈঠক ও সভা সমাবেশ করছেন। ঘুষ খাওয়া, তদবির করা জাতীয় কাজ মানুষের চোখ এড়িয়ে গোপনে করা ভালো। বাংলার মাটিতে যাঁরা রাজনীতি করেন তাঁরা এক চোখে দেখেন, অন্য চোখে দেখেন না। জনগণের চোখ তিনটি। তৃতীয় চোখটি দিয়ে যা দেখে সেটাই দিব্যদৃষ্টি—সত্যদৃষ্টি। কোনো দিন যদি এই মামলার পৃথিবীর সবচেয়ে নিরপেক্ষ ও সূক্ষ্মতম ন্যায়বিচারও হয়, তবু মানুষের মন খুঁতখুঁত করবে।
একুশ শতকে বাংলার মানুষ অশোকের শাসনামলের মতো অথবা আব্বাসীয়-উমাইয়াদের রাজত্বকালের মতো ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করে না। ব্রিটিশ আমলে বিচারকাজ যেমনটি হতো, তারা তাও আশা করে না। পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগঅলারা বিচার বিভাগকে যতটা স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, স্বাধীন দেশে ততটুকুও যদি না পায় তখন কষ্টের দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.