ব্রেক্সিট: একীভূত থাকবে যুক্তরাজ্য! by মোহাম্মদ আবুল হোসেন

দীর্ঘ সময় ‘ব্রেক্সিটের’ ট্রিগারে হাত ছিল বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে-র। তিনি ২৯শে মার্চ ট্রিগার টিপে দিয়েছেন। গুলির মতো বেরিয়ে গেছে লিসবন চুক্তির ৫০ নম্বর অনুচ্ছেদ। ফলে তেরেসা মে-র হাতে এখন মাপা দু’বছর সময়। এর মধ্যেই তাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটাতে হবে। সামনে অসীম কাজ। এ সময়ের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রায় ৮০ হাজার আইনকে ব্রিটিশ আইনে পরিণত করতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ৪৪ বছর আগে গাঁটছড়া বেঁধেছিল বৃটেন। সেই সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটাতে তাদের এখন নানা বাঁকে ঘুরতে হবে। ৬০ বছর আগে রোম চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে জন্ম হয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের। শেষ পর্যন্ত এর সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮। সেখান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে বৃটেন। ফলে এ সংস্থায় সদস্যের সংখ্যা দাঁড়াবে ২৭। এর পর কি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারবে? একীভূত থাকতে পারবে যুক্তরাজ্য? এমন অনেক প্রশ্ন রাজনৈতিক বোদ্ধাদের মধ্যে। এ প্রশ্ন ওঠার যৌক্তিক কারণও রয়েছে। এরই মধ্যে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে ব্রেক্সিট সম্পন্ন হওয়ার আগে, স্বাধীনতা প্রশ্নে গণভোট আহ্বান না করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টার্জেনকে। কিন্তু গত সপ্তাহে তার দেশের পার্লামেন্ট সেই গণভোটের পক্ষে প্রস্তাব পাস করেছে। তবে তেরেসা মে-কে আশ্বস্ত করেছেন নিকোলা। তিনি গণভোটের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে একটি চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকে। সঙ্গে বেশ কিছু তীর্যক বাক্য রয়েছে। তবে ব্রেক্সিট সম্পন্ন হওয়ার আগে সেই গণভোট হবে না এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন নিকোলা। ব্রেক্সিট শেষে যখন স্কটল্যান্ডে গণভোট হবে তখন যদি স্কটিশরা বৃটেন ছাড়ার পক্ষে রায় দেন তাহলে কি ঘটবে! স্কটল্যান্ড বেরিয়ে যাবে যুক্তরাজ্য থেকে। একই পথ অনুসরণ করতে পারে উত্তর আয়ারল্যান্ডও। ফলে ঐক্যবদ্ধ ব্রিটেন নিয়ে যে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে বোদ্ধা মহলে, তার যৌক্তিক কারণ আছে। একইভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে অনেক বোদ্ধা মত দিয়েছেন। তাদের অনেকেই বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নও ভেঙে যেতে পারে। সে যাই হোক, এখন যুক্তরাজ্য বা বৃটেনে বসবাস করছেন ৩০ লাখের মতো ইউরোপিয়ান। তারা সেখানে শুধু বসবাসই করছেন তা নয়। তারা সেখানে যার যার কাজও করছেন। আবার বেশ কয়েক লাখ ব্রিটিশও একইভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। তাদেরও আবাসন ও কাজ করার অনুমতি প্রয়োজন হবে। ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাস্ক যখন অনুচ্ছেদ ৫০ সক্রিয় করা নিয়ে চিঠি হাতে পেয়েছেন তখন তার কণ্ঠে আবেগ ছিল। তিনি বলেছেন, আমরা এরই মধ্যে তোমাদের (ব্রিটেন) মিস করা শুরু করেছি। কিন্তু আবেগ দিয়ে তো আর সব চলে না। এটা এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এখান থেকে পিছু হটার কোনো উপায় নেই। এখন ব্রিটেন বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের কি হয়, ভবিষ্যৎ তা-ই বলে দেবে। গত জুনের গণভোটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার বিরুদ্ধে যে প্রায় অর্ধেক ভোটার ভোট দিয়েছিলেন তাদের বিষয়টি ও স্কটল্যান্ডের অর্ধেকের বেশি মানুষের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে তেরেসা মে-কে। স্কটল্যান্ডের এই অর্ধেকের বেশি মানুষ কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে থাকার পক্ষেই ভোট দিয়েছিলেন। ব্রিটেন বা যুক্তরাজ্য যে কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়তে চাইছে সেই একই কারণ উল্লেখ করা যায় স্কটল্যান্ডের ব্যাপারে। ব্রাসেলস অনেক অনেক বেশি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এটিকে যদি ব্রিটেনের ইউরোপ ত্যাগের কারণ হিসেবে ধরা হয় তাহলে একই কারণ স্কটল্যান্ডের জন্যও প্রযোজ্য হতে পারে। ব্রাসেলসের মতো লন্ডনও অনেক অনেক বেশি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এটাকে কারণ হিসেবে দেখাতে পারে স্কটল্যান্ড। রাজনৈতিক বোদ্ধারা মনে করছেন, তেরেসা মে-র উচিত হবে ভারতের মতো প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ করা। প্রতিটি রাজ্যকে যেমন তার নিজের অধিকার দেয়া হয়েছে, তাদের নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামো আছে, ঠিক একই রকমভাবে যুক্তরাজ্যের প্রতিটি অঞ্চলের ক্ষেত্রে হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে থাকবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মতো কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ। এখন তেরেসা মে তার দেশকে উন্মুক্ত, উদার ও মুক্ত বাণিজ্যের জন্য খোলা রাখতে পারেন। ব্রিটেনে বসবাসকারী বিপুলসংখ্যক ইউরোপীয় ইউনিয়নের নাগরিকদের বসবাসের অধিকার দিতে পারে। যদি তিনি তা দেন তাহলে তার অর্থ হবে যে ব্রেক্সিট মানে নিজেকে নিঃসঙ্গ করে রাখা নয়। ব্রিটেনের জন্য আরেকটি দুঃসংবাদ হয়ে উঠতে পারে ডেনমার্ক। কারণ ব্রিটেনের সঙ্গে সব সময়ই এ দেশটির রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কিন্তু ব্রিটেন এখন অনুভব করছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে তাদের মনোভাবাপন্ন আর কোনো বন্ধু নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার সীমান্ত কড়াকড়ি করতে পারে, যাতে অভিবাসী সংকট মোকাবিলা করা যায়। এতে পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেন বেরিয়ে গেলে তা নিয়ে হতাশ নয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কারণ, তাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে প্রস্তুত আরো অনেক দেশ। তারা অভিন্ন বাজারে প্রবেশ করতে চায়। এমন দেশের মধ্যে রয়েছে নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড। ভবিষ্যতে এতে যোগ দিতে পারে বলকান অঞ্চলের ইউক্রেন, জর্জিয়া, বেলারুশ ও মলদোভিয়া।

No comments

Powered by Blogger.