উত্তরাঞ্চলে গমের উৎপাদন হয়েছে প্রায় সাত লাখ ৮৫ হাজার টন

পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার পুন্ডুরিয়া গ্রামের কৃষক কামাল হোসেন দুই একর জমিতে গম আবাদ করেছিলেন। আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় এ বছর গমের ভাল ফলন পেয়েছেন। বাজারে গমের দাম চড়া থাকায় সে খুব খুশি। দুই একর জমিতে গম আবাদ করতে তার খরচ হয়েছিল সবমিলিয়ে ২৫ হাজার টাকা। দুই একরে গম উৎপাদন হয়েছে ৬১ মন। প্রতিমণ গম ৮০০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন ৪৮ হাজার ৮০০ টাকা। সেই হিসাবে খরচ বাদ দিয়ে তার লাভ হয়েছে ২৩ হাজার ৮০০ টাকা। তাই বেজায় খুশি কামাল হোসেন। ফলন ও আবাদ ভাল হওয়ায় তার মতো উত্তরাঞ্চলের হাজার হাজার গম চাষি বেজায় খুশি হয়েছেন। রাজশাহী ও রংপুর কৃষি সম্প্রসারন অফিসের তথ্য মতে, উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বেশি গম আবাদ হয়েছিল ঠাকুরগাঁও জেলায় ৫৯ হাজার ২৮০ হেক্টরে এবং সব চেয়ে কম আবাদ হয় লালমনিরহাটে এক হাজার ৩১০ হেক্টরে। এছাড়া পাবনা জেলায় ৩৭ হাজার ৫৫৮ হেক্টর, সিরাজগঞ্জে ৩ হাজার ২৭২ হেক্টরে, জয়পুরহাটে এক হাজার ৬৮৯ হেক্টর, বগুড়ায় এক হাজার ৩৫৩ হেক্টর, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৮ হাজার ১১৪ হেক্টরে, নওগাঁওয়ে ১২ হাজার ৬৭৮ হেক্টর, রাজশাহীতে ২৯ হাজার ৯২০ হেক্টর, পঞ্চগড়ে ১৬ হাজার ২৭৪ হেক্টরে, দিনাজপুরে ২৬ হাজার ১১ হেক্টরে, গাইবান্ধায় দুই হাজার ৩২৬ হেক্টরে, নীলফামারীতে ছয় হাজার ৯৬ হেক্টরে,
কুড়িগ্রামে ১৩ হাজার ৪৭৮ হেক্টর জমিতে গমের আবাদ হয়। উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবার গমের আবাদ হয়েছিল দুই লাখ ৬১ হাজার ৭২৭ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছিল প্রতি হেক্টরে দুই দশমিক আট মেট্রিক টন। সেই হিসাবে মোট গম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় সাত লাখ ৩২ হাজার ৮৩৫ মেট্রিক টন। কৃষক ও কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের তথ্য মতে, এ বছর পাবনাসহ উত্তরাঞ্চলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি জমিতে গমের আবাদ হয়েছিল এবং ফলন হয়েছে বেশ ভাল। প্রতি হেক্টরে গমের ফলন হয়েছে গড়ে প্রায় তিন মেট্রিক টন হিসেবে গম উৎপাদন হয়েছে সাত লাখ ৮৫ হাজার ১৮১ টন। ইতিমধ্যে এ অঞ্চলের ৯৫ ভাগ জমির গম কাঁটা ও মাড়াই শেষ হয়েছে। সরেজমিনে বেড়া ও সাঁথিয়ার কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে আরাম্ভ করে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত গম জমিতে লাগানো হয়। ১১০ দিনের এই ফসল ফেব্রুয়ারির শেষ সময় থেকে কৃষক ঘরে তুলতে পারেন। এক একর জমিতে গম আবাদ করতে বীজ, সেচ, নিড়ানি, কাটা-মাড়াই করে ঘরে তোলা বাবদ খরচ পরে ৯ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। যারা জমি বন্ধুক বা লীজ নিয়ে গম আবাদ করেছিলেন তাদের পাঁচ হাজার টাকা বেশি খরচ হয়েছে। গত তিন মৌসুম গমের দাম বেশি থাকায় অনেক আলু চাষি এবার আলুর পরিবর্তে গমের আবাদ করেছিলেন। কারন পর পর তিন মৌসুমে এ আঞ্চলের আলু চাষিদের বিপুল পরিমান টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে।
তাই অনেকে আলুর পরিবর্তে গমের আবাদ করেছিলেন। পাবনার ফরিদপুর উপজেলার ডেমরা গ্রামের কৃষক আহেদ আলী প্রামানিক জানান, সে এ বছর দুই একর (ছয় বিঘা) জমিতে গম আবাদ করেছিলো। বীজ বোপণের পর পরিমিত সেচ ও রাসায়নিক সার প্রযোগে গমের আশাতীত ফলন পেয়েছে। ছয় বিঘা জমিতে সে গম পেয়েছে ৬৩ মন। গত বছর একই পরিমান জমিতে গম উৎপাদন হয়েছিল ৫২ মন। অন্যান্য ফসল আবাদের চেয়ে গম আবাদে পরিশ্রম ও খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক কম। তার ছয় বিঘা জমিতে হালচাষ, গমবীজ, শ্রমিকের মজুরী, কীট নাশক, সেচ, গম কাটা-মাড়াই ও পরিবহন বাবদ খরচ হয়েছে প্রতি একরে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার টাকা। দুই একর জমিতে গম চাষে তার মোট খরচ হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার টাকা। প্রতিমণ গম ৭৭৫ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। শুধু কৃষক আহেদ আলী নয়, সাঁথিয়ার মনমথপুর গ্রামের রজব আলী, পুন্ডুরিয়ার কামাল হোসেন বাউসগাড়ী হযরত আলী, ফলজানার চরের কৃষক আকবর আলী, সোনা মিয়া, চরঢালার আক্কাছ আলী, সাগর সরকার, মীরকুটিয়া চরের রায়হান, আজিবর শ্রীপুর চরের রতন দাস, হোসেন আলী, বাদশা মিয়া, ভারদিঘুলিয়া চরের শাহনুর মিয়া, গহের প্রামানিকসহ অনেক কৃষকের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, এ বছর গমের আশাতীত ফলন পাওয়া গেছে। হাট-বাজারে মানভেদে প্রতিমন গম ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গত বছর মানভেদে প্রতিমণ গম বিক্রি হয়েছে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা দরে।
তবে গমের ফলন ও দাম বেশি হওয়ায় চাষিরা বেজায় খুশি হয়েছেন। পাবনার বেড়া, নাকালিয়া, কাশিনাথপুর, বনগ্রম, আতাইকুলা, বোয়ালমারি, ডেমরা, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া, তালগাছি, শাহজাদপুরসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন হাট বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিমন গম বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। প্রতিমন আটা বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ১০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা। আটা ও গম ব্যবসায়ীরা জানান, গমের এ দাম থাকবে না, বেড়ে যাবে। তবে সাধারন ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা একটি সিন্ডিকেট ধানের মতো গমের মজুদ গড়ে তুলতে তৎপর হয়ে উঠেছে। এই সিন্ডিকেটের হাতে গম চলে গেলে তারা চালের মতো গমের বাজার নিয়ন্ত্রন করবে। এতে সাধারন কৃষকরা যেমন ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে, তেমনি সাধারন মানুষ আটা ও গম বেশি দামে কিনতে বাধ্য হবেন। কৃষক ও সাধারন ব্যবসায়ীরা এখন থেকেই গমের বাজার নিয়ন্ত্রনে সরকারের নজরদারি আশা করছেন। পাবনা কৃষি সম্প্রসারন বিভাগ ও চাষিরা জানান, বোরো ধান আবাদে খরচ ও পরিশ্রম অনেক বেশি। উৎপাদিত ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচ উঠছে না। তাই অনেক চাষি গমের আবাদ করেছিলেন। এছাড়া আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় এ অঞ্চলে গমের আশাতীত ফলন হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.