‘পাঁচ বছর পরও আমিনুল হত্যার বিচার হয়নি’

পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো গার্মেন্ট শ্রমিকদের অধিকার আন্দোলনের নেতা আমিনুল ইসলাম অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার কোনো সুবিচার হয়নি। তার কি হয়েছিল, কে বা কারা তাকে হত্যা করেছিল সেই সত্য সম্পর্কে জানতে পারেনি তার পরিবার বা জনগণ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছে। ‘বাংলাদেশ: ফাইভ ইয়ার্স অন, নো জাস্টিস ফর আমিনুল ইসলাম’ শীর্ষক প্রতিবেদনে আরো বলা হচ্ছে, আমিনুল হত্যার উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, ২০১২ সালের ৪ঠা এপ্রিল সুপরিচিত শ্রমিক অধিকারবিষয়ক কর্মী আমিনুল ইসলামকে অপহরণ করে নির্যাতন করা হয়। তারপর তাকে হত্যা করা হয়। এতে সরকারি কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। এ বিষয়ে তদন্তে পরিমিত অগ্রগতি অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। তাই হিউম্যান রাইট ওয়াচ তাদের বিবৃতিমূলক ওই প্রতিবেদনে আমিনুল ইসলাম হত্যার জবাবদিহিতার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিতে আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক দাতা ও বিশ্বব্যাপী তৈরি পোশাকের বিভিন্ন ব্রান্ডের সোর্সকে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়াবিষয়ক উপপরিচালক ফিল রবার্টসন বলেছেন, ৫ বছর পরেও আমিনুল ইসলামের পরিবার বা জনগণ কেউই সেই সত্য জানতে পারেননি, আমিনুলের কি ঘটেছিল এবং কারা তাকে হত্যা করেছিল। এতে নিরাপত্তা সংস্থার সদস্যদের জড়িত থাকার গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তা তদন্ত না করে সরকার বলেছে, ব্যক্তিগত বিরোধের জেরে মৃত্যু হয়েছে তার। এর মাধ্যমে দৃশ্যত কর্তৃপক্ষ পুরো ঘটনা থেকে তাদের ‘হাত ধুয়ে মুছে নিয়েছে’। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বাংলাদেশ সরকার এ হত্যাকাণ্ড দ্রুত গতিতে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু ৫ বছর গত হয়েছে। পুলিশ গার্মেন্টের সাবেক এক শ্রমিককে সন্দেহজনক দেখিয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে। সন্দেহজনক এই শ্রমিকও নিখোঁজ। আমিনুল ইসলামকে হত্যা ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশের নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের কিছুসংখ্যক সদস্য জড়িত এ অভিযোগ তদন্তের দৃশ্যত কোনো উদ্যোগ নেই। আমিনুল ইসলামের বয়স ছিল ৩৯ বছর। তিনি ছিলেন স্থানীয় বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটি (বিসিডব্লিউএস) নামের একটি ট্রেড ইউনিয়নের সংগঠক। তার সংগঠন গার্মেন্ট ও সমুদ্রজাত খাদ্য প্রস্তুতকারী কারখানার শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে কাজ করে। ২০১২ সালের ৪ঠা এপ্রিল তিনি নিখোঁজ হন। তাকে সর্বশেষ যেখানে দেখা গিয়েছিল দু’দিন পর সেখান থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে পাওয়া যায় তার মৃতদেহ। এ সময় তার শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন ছিল, যা থেকে সন্দেহ হয় যে, এতে জড়িত বাংলাদেশের নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের দায়মুক্তির দীর্ঘ ইতিহাস আছে বাংলাদেশে। সেখানে আমিনুল ইসলাম হত্যার নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে দীর্ঘদিন ধরে আহ্বান জানিয়ে আসছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। ২০১৩ সালের নভেম্বরে এ হত্যার জন্য গার্মেন্টের সাবেক শ্রমিক মুস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে সিআইডি। আমিনুল ইসলাম নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই মুস্তাফিজুর রহমান কোথায় তা অজানা। তবে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ দাবি করে সে ভারতের কোথাও পালিয়ে আছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, আমিনুল ইসলামের মৃতদেহে নির্যাতনের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। তার ডান পায়ে হাঁটুর নিচে ক্ষত ছিল। তার নখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল। দুই হাঁটুতেই জমাটবাঁধা রক্ত ছিল। শরীরের বিভিন্ন অংশে ছিল ক্ষতচিহ্ন। ওই সময় ঘাটাইল পুলিশ প্রধান মাহবুবুল হক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তাকে হত্যা করা হয়েছে। তার পায়ে যে মারাত্মক ক্ষত রয়েছে সেখানে গর্তও আছে। এটা সুচালো কোনো কিছু দিয়ে করা হয়েছে। তার পায়ের আঙুল ভেঙে দেয়া হয়েছে। বিসিডব্লিউএসের একজন শ্রমিক সংগঠক থাকা অবস্থায় মাঝে মাঝেই বিভিন্ন গার্মেন্টের ম্যানেজারদের সঙ্গে তার সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো। নিখোঁজ হওয়ার আগে তিনি ঘন ঘন হুমকি পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। বলা হয়েছিল তার ওপর নজরদারি করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, গার্মেন্ট শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন নিশ্চিত করে কাজের পরিবেশ উন্নত করা, কর্মক্ষেত্র নিরাপদ করা, বেতন বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দাবিতে সহযোগিতা দিয়ে থাকে বিসিডব্লিউএস। শ্রমিক ইউনিয়ন করার চেষ্টা করেছেন অথবা এতে যোগ দেয়ার চেষ্টা করেছেন এমন শ্রমিকরা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছে, কারখানার ম্যানেজাররা এজন্য তাদের হয়রানি করেন এবং হুমকি দেন। বিসিডব্লিউএসের স্টাফরা দীর্ঘ সময় হয়রানির মুখোমুখি হন। একপর্যায়ে বিসিডব্লিউএসের প্রতিষ্ঠাতা কল্পনা আকতারের বিরুদ্ধে ‘লজ্জাজনক ফৌজদারি অভিযোগ’ আনা হয়। এ অভিযোগের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
২০১৩ সালের এপ্রিলে সাভারে ধসে পড়ে রানা প্লাজা। এতে কমপক্ষে ১১০০ শ্রমিক নিহত ও আহত হন। তারপর শ্রম আইন সংশোধন করা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ শ্রমিক ও শ্রমিক নেতাদের অব্যাহতভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে। কয়েক ডজন অভিযোগ আছে যাতে আশুলিয়ায় বেতন নিয়ে ধর্মঘটের পরে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। ফিল রবার্টসন বলেছেন, যতক্ষণ আমিনুল ইসলামের ঘটনার সমাধান না হবে, সব অপরাধীকে খুঁজে পাওয়া না যাবে এবং তাদের বিচারের আওতায় আনা না হবে ততক্ষণ আমিনুল ইসলামের মতো শ্রমিক সংগঠকের মতো বিষয়ে বাংলাদেশের ব্যর্থতায় আন্তর্জাতিক নজর দেয়া উচিত। তিনি আরো বলেছেন, গার্মেন্ট শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে অব্যাহতভাবে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার।

No comments

Powered by Blogger.