আশা-নিরাশার দোলাচলে অবসরভোগীরা

সামাজিক সুরক্ষায় বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও সরকার বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করছে। ব্যক্তির কল্যাণের সামষ্টিক পর্যায়ই সামাজিক কল্যাণ। সামাজিক কল্যাণের শতভাগ নিশ্চয়তায় বৈষম্য বিলোপ, আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, আর্থিক ও অর্থতুল্য সেবাসহ আরো সুযোগ সৃষ্টি প্রয়োজন। প্রবীণ-অবসরভোগী-পেনশনারদের কল্যাণে একমাত্র সরকারই পারে প্রাসঙ্গিক ও বাস্তবভিত্তিক মৌলিক বিষয়ের ওপর নীতি প্রণয়ন ও কার্যকর করে তাদের সুরক্ষা দিতে। জনস্বার্থে কিছু দফায় বিস্তারিত বর্ণিত হলো।
(ক) ব্যাংকে সঞ্চয়ী ও স্থায়ী আমানতের সুদহার নি¤œমুখী হওয়ায় আয় প্রত্যাশার চেয়ে কম। মেয়াদি সঞ্চয়পত্র ছাড়াও সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের জন্য সরকারের বিশেষ বিবেচনায় সৃষ্ট পেনশনার সঞ্চয়পত্র বেশি লাভজনক হওয়ায় পেনশন বিক্রির টাকা, গ্র্যাচুইটি ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের তহবিল দিয়ে নির্দিষ্ট নির্ধারিত অঙ্কের টাকা পর্যন্ত পেনশনাররা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে থাকেন। অন্য আয়ের উৎসবিহীনদের কাছে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বেশি নিরাপদ বলে মাসিক পেনশন সম্পূর্ণ বা শতভাগ সমর্পণ বা বিক্রি করেও তা কেনা হয়। যেহেতু, মাসিক ভিত্তিতে প্রাপ্য পেনশন করমুক্ত তাই ৩০.০৬.১১ তাং এর আগে বিক্রীত সঞ্চয়পত্র করমুক্ত রাখা হয়েছিল; কিন্তু পরে প্রয়োজনে পুনঃবিনিয়োগ বা নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফা আয়ের ওপর ৫ শতাংশ হারে করারোপ করা হয়েছে বাধ্যতামূলকভাবে। সুদহার হ্রাস করে ও করারোপ করায় একজন বিনিয়োগকারীর স্থির আয়ের ওপর আঘাত হানা হয়েছে, তাতে তাদের আয়ও হ্রাস পেয়েছে। (খ) বাংলাদেশ ব্যাংকের সঞ্চয়পত্রের মুনাফা বা মূলধন স্থানান্তরের জন্য ইএফটি পদ্ধতির মাধ্যমটি অত্যন্ত যুগোপযোগী। আয়কর প্রত্যয়নপত্রের জন্য গ্রাহককে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করতে হয়, যা কাক্সিত নয়। গ্রাহকের ম্যানডেট অনুযায়ী যে শাখায় মুনাফা স্থানান্তর করা হয় সেখানে কর্তনকৃত করের প্রত্যয়নপত্র পাঠানোর ব্যবস্থা করলে ক্রেতাদের দুর্ভোগ কমবে। অনুরূপভাবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর যেসব শাখা সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সেখানে মুনাফা থেকে কর কর্তন করলে চার্জ ব্যতিরেকে কর প্রত্যয়নপত্র ইস্যুর বিষয়ে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের বিশেষ নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। (গ) বয়স বৈষম্যের সাথে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে চলছে। আয় কমছে; বাজারমূল্য কম বেশি বাড়ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের বেতন দ্বিগুণ বেড়েছে। আর্থিক সুরক্ষার জন্য পেনশন ৪০ শতাংশের পরিবর্তে শতভাগ বাড়ানো দরকার। (ঘ) প্রবীণ অবসরভোগীদের বয়স ৬৫ বছর হলে চিকিৎসাভাতা দুই হাজার ৫০০ টাকায় উন্নীত হয়। অথচ ৫৯-৬০ বছর পর্যন্ত বয়সে চাকরিরত অবস্থায় একই ভাতা ১৫০০ টাকা, পার্থক্য শুধু এক হাজার টাকার। চিকিৎসা ব্যয় ক্রমবর্ধমান বিবেচনায় ওই ভাতা দুই হাজার ৫০০ টাকার স্থলে শতভাগ বৃদ্ধি করা দরকার। অধিকন্তু, যে প্রতিষ্ঠান থেকে অবসরে যাবে সেখান হতে প্রয়োজনে এককালীন চিকিৎসাভাতা প্রদানের বিধান চালু করা প্রয়োজন। (ঙ) ঋণ সঙ্কোচনের জন্য ঋণ মঞ্জুরি ও বিতরণে অনিয়ম রোধে সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে ঋণ প্রদানে লিয়েন প্রথা রহিত করা হয়েছিল। ত্রৈমাসিক মুনাফাভিত্তিক পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্র সুরক্ষায় একটি বিশেষ সঞ্চয়পত্র। অবসরভোগীদের সুবিধার্থে যাদের ওই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ রয়েছে তা লিয়েনের মাধ্যমে ন্যূনতম অঙ্কের ঋণ মঞ্জুরির ব্যবস্থা থাকা দরকার। প্রয়োজনে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণদান পদ্ধতি সহজ করা প্রয়োজন। (চ) সিএসআর নীতিমালায় একক বা কয়েকটি ব্যাংক একসাথে কল্যাণ তহবিল গঠন করে প্রবীণ অবসরভোগীদের, তাদের উত্তরাধিকারীদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের প্রয়োজনে সেবা দিতে পারে।
(ছ) অর্থ মন্ত্রণালয়ের গত ১৪.১০.২০১৫-এর প্রজ্ঞাপনে ১৪২৩ বঙ্গাব্দ হতে বাংলা নববর্ষ ভাতা প্রবর্তনের ঘোষণা যুগান্তকারী পদক্ষেপ। মাসিক নিট পেনশন, আজীবন পারিবারিক পেনশনভোগীদেরও এ সুবিধা দেয়া হয়েছে। তবে সাধারণ প্রভিডেন্ট ফান্ডের আওতায় শতভাগ পেনশন সমর্পণ বা বিক্রি যারা করেছেন তাদের এ সুবিধার আওতায় আনা হয়নি। সিপিএফভুক্তদেরসহ ১০০ শতাংশ পেনশন সমর্পণকারীদের ওই সুবিধার আওতায় আনলে বৈষম্য রহিত হবে। (জ) সঞ্চয়, জমা ও সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে অনেকেই ‘নমিনি’ উল্লেখ করে থাকেন। ‘নমিনি’ শব্দটি মনোনীত ব্যক্তি বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। মনোনীতরা উত্তরাধিকারী হতেও পারে, না-ও হতে পারে, এ ক্ষেত্রে নমিনি ট্রাস্টি। ব্যাংকের হিসাব খোলার ফরমে নমিনির উল্লেখ আছে। অনেক হিসাবের ধারক নমিনিকে সম্পদ বা অর্থ গ্রহণের জন্য যথার্থ মনে করেন। যদিও হিসাব খোলার ফরমেটের পাদটীকায় নমিনিসংক্রান্ত বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয় না। ধারকের ইচ্ছানুযায়ী সুস্পষ্ট ও নির্দিষ্ট করে মনোনয়ন বা ম্যান্ডেট থাকলে মৃত্যুর পর নমিনি কর্তৃক নগদ অর্থ গ্রহণ, সম্পদ আহরণ ও ভোগের বৈধতার বিষয় সবার কাছে সুস্পষ্ট হবে। জানা যায়, সঞ্চয়পত্রসংশ্লিষ্ট উত্তরাধিকারী আইনের বিষয়টি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। (ঝ) মাসিক পেনশন ও পারিবারিক পেনশনভোগীদের মতো শতভাগ পেনশন সমর্পণকারীদের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারীদের চিকিৎসা ভাতা ও বোনাস প্রদানের নিয়ম প্রবর্তনসহ সিপিএফভুক্ত অবসরভোগীদেরও একই সুবিধার আওতায় আনা প্রয়োজন। শতভাগ পেনশন সমর্পণকারীদের পুনরায় মাসিক নিট পেনশন ও পারিবারিক পেনশনের আওতায় আসার বিষয়টি জরুরি ভিত্তিতে বিবেচনা করা প্রয়োজন। (ঞ) প্রবীণ ও অবসরভোগীদের ভ্রমণের সময় পরিবহনে হ্রাসকৃত মূল্যে টিকিট, হাসপাতালে সাশ্রয়ী সময়ে সিট বরাদ্দসহ চিকিৎসাসুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ বাঞ্ছনীয়।
অবসরভোগীদের সংখ্যা প্রতিদিনই বেড়ে চলছে। বয়স ও দায়িত্ব বিবেচনায় তারা সংগঠিত নন। তাদের নির্ভরতা শুধুই সরকারের প্রতি। সরকার তথা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, অর্থ, আইন, সমাজকল্যাণ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, জাতীয় সঞ্চয়ব্যুরো, এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে অবসরভোগীদের সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণ ও বৈষম্য দূরীকরণে সামাজিক সুরক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে অবসরে যারা আছেন বা যাবেন তারা বিশেষভাবে উপকৃত হবেন, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে স্বমর্যাদায় সুন্দর থাকবেন।
লেখক : নির্বাহী কর্মকর্তা (অবসরপ্রাপ্ত),
রূপালী ব্যাংক লিমিটেড

No comments

Powered by Blogger.