জাতীয়তাবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও বাংলাদেশের নিরাপত্তা

আজকের পৃথিবীতে সব মহাদেশেই থেমে থেমে বা কিছু সময় বিরতি দিয়ে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার রূপ অত্যন্ত ভয়াবহ। যখন বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী তাদের লক্ষ্যবস্তুর ওপর আঘাত হানে তখন ওরা একে যুদ্ধ বলেই মনে করে। কিন্তু প্রকৃত যুদ্ধ তা নয়। সঠিকভাবে বলতে গেলে যুদ্ধ হল এক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অন্য রাষ্ট্রের প্রথাসিদ্ধ ও সংগঠিত শক্তি প্রয়োগ। গৃহযুদ্ধকে আমরা যুদ্ধ বলি এ কারণে যে, গৃহযুদ্ধে একটি গোষ্ঠীর মানুষ অপর একটি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগঠিতভাবে বল প্রয়োগ করে। উদ্দেশ্য রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করা অথবা এর চেহারা পাল্টে দেয়া। ব্যর্থ রাষ্ট্রগুলোর গৃহযুদ্ধ এবং স্রেফ ডাকাতির মধ্যে পার্থক্য করা মুশকিল। বর্তমান বিশ্বে শান্তির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হল ব্যর্থ রাষ্ট্র। তবে এটি এ কারণে নয় যে, তারা অন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগের হাতিয়ারগুলো ব্যবহার করতে পারে। কার্যত তারা এমন অসমর্থতায় ভোগে যে, অন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সফলভাবে বল প্রয়োগের হাতিয়ারগুলো ব্যবহার করতে পারে না। তারা যে বিপদের জন্ম দেয় তা হল নৈরাজ্যের মধ্যে তাদের অবসান। আরও বিপদের কারণ হল উন্নত রাষ্ট্রগুলো এগুলোকে মানবিক বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত করে এবং এ বিপর্যয় রোধ করার জন্য হস্তক্ষেপের পথ বেছে নেয়। কিন্তু একটি উন্নত রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ অন্য একটি উন্নত রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকে সুবিধাবাদিতার পথে প্রলুব্ধ করে। এ হস্তক্ষেপ কোনো শক্তিশালী রাষ্ট্রের উদ্যোগে সংগঠিত হয়, অথবা রাষ্ট্রবহির্ভূত সন্ত্রাসবাদীদের হস্তক্ষেপ করতে প্রলুব্ধ করে। এর ফলে মানবিক দুঃখ-দুর্দশা ও রক্তপাত বাড়তে থাকে।
তদসত্ত্বেও এর ফলে বড় ধরনের কোনো যুদ্ধ হয় না। যখন বিশ্বে দুটি পরাশক্তি ছিল, অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন, তখন এক পরাশক্তির হস্তক্ষেপ অন্য পরাশক্তির হস্তক্ষেপকে অনিবার্য করে তুলত। এখন পৃথিবীতে একটিমাত্র পরাশক্তি বিদ্যমান। যদিও অন্য পরাশক্তির উত্থানের সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে। একক পরাশক্তির হস্তক্ষেপ করার প্রবণতা দেখা গেলেও অতীতের তুলনায় তার তীব্রতা হ্রাস পেয়েছে। পরাশক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকার ফলে আণবিক যুদ্ধের ভীতিও হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু গৃহযুদ্ধ কিংবা আধা গৃহযুদ্ধ এক রাষ্ট্র থেকে অন্য রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং সেখানে অস্থিতিশীলতার জন্ম দিতে পারে। এ ধরনের সমস্যা একটি মহাদেশের বিপুল অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেমনটি আমরা লক্ষ করেছি কঙ্গো ও এঙ্গোলায়। এখন সোমালিয়ায় যা ঘটছে তা একই ধরনের বিপদের উৎস হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ রকম অবস্থায় আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বাস্তববাদী ও মানবতাবাদীদের মধ্যে মুখোমুখি দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হচ্ছে। বাস্তববাদীরা দেখতে চান তাদের উন্নত দেশের সরকার নিজস্ব সমাজের স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে কিনা সেটা দেখুক। অন্যদিকে মানবতাবাদীদের কাছে গোটা ব্যাপারটি অসহনীয়। কারণ এর ফলে লাখ লাখ মানুষ নিহত হবে, যেহেতু তারা সন্ত্রাসকবলিত দেশে বাস করছে। তাদের জন্য এটাকে দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। বাস্তববাদীরা এতই উদাসীন যে, দক্ষিণ সুদানে ধর্ষণ, দুর্ভিক্ষ ও হত্যাকাণ্ড ঘটলে আমেরিকা বা ব্রিটেনের কি-ই বা আসে যায়। তারা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এক অদ্ভুত ধরনের যুক্তি হাজির করে। তারা বলে, বিচার-বিবেচনা না করে হস্তক্ষেপ করলে আরও অনেক বেশি ধর্ষণ, অনাহার ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটবে। যারা মানবতাবাদী তারা সমস্যাটিকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চান। তাদের প্রশ্ন, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা কী, কোনো ধরনের বিশ্ব সরকারের কথা কি ভাবা যায় না যা শান্তি ও সমৃদ্ধি আনতে পারে, দেশীয় সরকারগুলো যা করতে পারছে না? বৃহত্তর সংঘাতের ঝুঁকি সৃষ্টি হয় পুরনো ধাঁচের জাতীয়তাবাদ থেকে।
যখন কোনো উগ্র জাতীয়তাবাদী সরকার তাদেরই সীমান্তের ওপারে অবস্থানরত সমজাতীয়দের নিজ অঙ্গীভূত করার চেষ্টা করে। অন্যদিকে সংঘাতের উৎপত্তি ঘটতে পারে যখন একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বহুজাতিক রাষ্ট্রকে ভেঙে ফেলার চেষ্টা চালায়, যা তার উচ্চাভিলাষকে বাস্তবায়ন করবে। প্রথমটির দৃষ্টান্ত আমরা খুঁজে পাই যখন হিটলার তার চেক প্রতিবেশীদের ওপর হামলা চালাল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার ফলে দু’ধরনের সমস্যারই উদ্ভব হল। যেমন, চেচনিয়ায় রুশ উপস্থিতি উগ্র রুশ জাতীয়তাবাদের দৃষ্টান্ত হয়ে দেখা দিল। রুশরা চাইছিল চেচেনদের বৈধ আকাক্সক্ষাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতে। অন্যদিকে চেচেন জাতীয়তাবাদীদের কর্মকাণ্ডকে রাশিয়াকে ভেঙে দেয়ার প্রয়াস হিসেবেও দেখা যায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসানের পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে দু’ধরনের প্রবণতাই লক্ষ করা গেছে। মধ্যপ্রাচ্যে অবশ্যই ইসরাইল নামক কৃত্রিম রাষ্ট্রের সৃষ্টি ভয়াবহ সংকটের জন্ম দিয়েছে। আবার মধ্যপ্রাচ্যে আমরা একের পর এক রাষ্ট্রকে আরব জাতীয়তাবাদ অথবা ইসলামী জাতীয়তাবাদকে উৎসাহিত করতে দেখেছি। এসব জাতীয়তাবাদের লক্ষ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে খর্ব করা। মধ্যপ্রাচ্য তেলসমৃদ্ধ হওয়ার ফলে পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। যদি তেলসম্পদ না থাকত তাহলে বৃহৎ শক্তিগুলো মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে মাথা ঘামাত না। এ রকম পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-সংঘাতে লিপ্ত হয়ে পড়লেও বৃহৎ শক্তিগুলো উদাসীনতাই দেখাত। আরব, ইরানি এবং অন্যান্য মধ্যপ্রাচীয় জাতীয়তাবাদ বিশ্ব রাজনীতিতে অস্থিরতা ছড়াবে। কিন্তু এ কারণে বড় বড় শক্তিগুলোর মধ্যে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এর দ্বারা মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি যে ভীতি ও উদ্বেগ ছড়াচ্ছে তাকে খাটো করে দেখা হয় না। অথবা এর ফলে নাগরিক অধিকার এবং উদারনৈতিক গণতন্ত্রের যে ক্ষতি হবে তাকেও খাটো করে দেখা উচিত নয়। সৌদি আরব সব সময় আল কায়দার লক্ষ্যবস্তু ছিল। কারণ আমেরিকা মক্কায় খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথে বাধা সৃষ্টি করে যাচ্ছে। আমেরিকা নিজেও আক্রমণ ও হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছে।
এসব কারণে যাকে অনিবার্য ক্ষতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তা শুধু ব্যাপকতাই লাভ করবে না, বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েও দাঁড়াবে, যারা কোনোভাবেই এ সংঘাতের সঙ্গে জড়িত নয়। অনিবার্য ক্ষতি এড়াতে গিয়ে তাদের নিজস্ব জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতিও ক্ষতির সম্মুখীন হবে। গত ৫০ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, জাতীয়তাবাদী ক্রোধের একটি সীমা আছে। বিশেষ করে এ জাতীয়তাবাদ যদি হয় উপনিবেশবাদ ও নব্য উপনিবেশবাদবিরোধী। কিন্তু যখন ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ সংমিশ্রিত হয়ে যায় তখন উল্লেখযোগ্য পার্থক্য সৃষ্টি হয়। সাধারণভাবে বলা যায়, জাতীয়তাবাদী আকাক্সক্ষার একটি স্বাভাবিক সীমারেখা আছে। ১৯৫০-এর দশকে কেনিয়ায় যখন মাউ-মাউ অভ্যুত্থান হয়, তখন তার লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্তৃত্বের অবসান ঘটানো এবং সম্ভব হলে বেশির ভাগ শ্বেতাঙ্গ অভিবাসীকে বিতাড়ন করা। একইভাবে অন্যান্য উপনিবেশবাদবিরোধী বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত উপনিবেশবাদী শক্তির অবস্থানকে অকার্যকর করে ফেলেছে এবং উপনিবেশবাদী শাসনের অবসান ঘটেছে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বিদ্রোহী জাতীয়তাবাদীরা রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, যা প্রায়ই বৈধতার সংকটে পড়ে। এ ছাড়া এসব রাষ্ট্রের অর্থনীতি জনসংখ্যা বিস্ফোরণের চাপের মুখে পড়ে এবং বৈদেশিক প্রতিযোগিতাকে ঠেকাতে হিমশিম খায়। এর অর্থ এই নয় যে, জাতীয় মুক্তির কাজটি সুসম্পন্ন হয়নি। বিদেশী শক্তিকে বিতাড়ন করা সম্ভব হয়েছে এবং জাতীয় সরকারও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সব ধরনের মন্দের উৎস বলে চিহ্নিত করে যে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ হয় তার ব্যাপারটি কিন্তু ভিন্ন। সন্ত্রাসবাদীদের এমন কোনো স্বদেশ নেই যা তারা মুক্ত করতে চায়। বরং তাদের দেশটি ভুল লোকের হাতে পরিচালিত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এই অর্থে বৈশ্বিক ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কারণ এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, ইহজাগতিক ও বস্তুবাদী সংস্কৃতির উৎস। যারা এভাবে চিন্তা করে তাদের দৃষ্টিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি সামরিকের তুলনায় অধিকতর আধ্যাত্মিক। ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত যেভাবে উপনিবেশবাদের উচ্ছেদ সাধন করা হয়েছে সেভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে উচ্ছেদ করা যাবে না। উদ্ভূত ব্যাপার হল যুদ্ধের সম্ভাব্য কারণ খুবই সেকেলে। যদি রাষ্ট্রীয় সীমান্ত সুচিহ্নিত না থাকে তাহলে অস্ত্র শক্তিতে বলীয়ান রাষ্ট্রগুলো লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়বে, যার মাধ্যমে তারা সীমান্ত বিরোধগুলোর নিষ্পত্তি খুঁজবে। ভারত হল এমন একটি রাষ্ট্র, যার সঙ্গে পাকিস্তান ও চীনের ভূখণ্ডগত বিরোধ রয়েছে। সুতরাং প্রাচীনকাল থেকে যে কারণে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের যুদ্ধ হয়েছে, সে কারণগুলো আমাদের এ অঞ্চলে স্পষ্টভাবে বিদ্যমান। নিউইয়র্ক টাইমসে ম্যাক্স ফিশারের লেখা একটি বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধে সম্প্রতি বলা হয়েছে, ‘পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে ভারত প্রথম আঘাতের নীতি নেবে!’ তাহলে বাংলাদেশ ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ নীতিতে বিশ্বাসী হয়েও নিজেকে বাঁচাতে পারবে কি? কারণ পারমাণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তা আমাদের ছোট্ট ভূখণ্ডেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিরোধে লিপ্ত কোনো পক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশ না থাকলেও বাংলাদেশের মানুষ বিপদমুক্ত নয়।
ড. মাহ্বুব উল্লাহ্ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ

No comments

Powered by Blogger.