রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদনের দাবি, তবুও লোডশেডিং

সব ধরনের গ্রাহকপর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর খড়গ ঝুলছে সাধারণের ঘাড়ে। কিন্তু লোডশেডিংয়ের কবল থেকে মুক্ত হতে পারছেন না সাধারণ গ্রাহক। কী রাজধানী, কী গ্রামাঞ্চল, কোনো জায়গাই লোডশেডিং মুক্ত নয়। অন্তত গত কয়েক দিনের রাজধানীসহ সারা দেশের চিত্রই বলে দিচ্ছে এর বাস্তবতা। গত কয়েক দিনে রাজধানীর এমনও এলাকা ছিল যেখানে দিনরাতে পাঁচ থেকে ছয়বার লোডশেডিং হয়েছে। আর গ্রামে তো কথাই নেই। বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, সরকার যতই বলুক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে, কিন্তু প্রক্ষেপণ অনুযায়ী চাহিদা ও উৎপাদনের মধ্যে এখনো ফারাক রয়েছে তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ নামফলক অনুযায়ী উৎপাদনের সক্ষমতা বেড়েছে, প্রকৃত চাহিদা অনুযায়ী বাড়েনি। এ বিষয়ে পাওয়ার সেলের সাবেক ডিজি বিডি রহমত উল্লাহ গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়েনি, বরং ঘাটতি রয়েছে তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট। তিনি জানান, এ ঘাটতি সমন্বয় হচ্ছে গ্রামের সাধারণ জনগণের ওপর লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে। রাজধানীতেও কোনো কোনো এলাকায় বিদ্যুতের লোডশেডিং করা হচ্ছে। কিন্তু ভিআইপি এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। তিনি জানান, এক প্রক্ষেপণ অনুযায়ী বিদ্যুতের প্রকৃত চাহিদা রয়েছে ১২ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু সরকার কোনোভাবেই সাড়ে সাত হাজার মেগাওয়াট থেকে সাড়ে আট হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা সর্বোচ্চ সাড়ে আট হাজার মেগাওয়াটের বেশি নয়। তাহলে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে কিভাবে দাবি করা হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াটÑ এমন এক প্রশ্নের জবাবে বিডি রহমাত উল্লাহ বলেন, এটা নামফলক অনুযায়ী দাবি করা হচ্ছে।
তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, ১৫ বছর আগে যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা ছিল ১০০ মেগাওয়াট, সেটি থেকে এখন আর ১০০ মেগাওয়াট উৎপাদন করা যাচ্ছে না, পুরনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কোনো কোনোটি বন্ধ রয়েছে, কোনো কোনোটি থেকে চার ভাগের এক ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে। কিন্তু নামফলক অনুযায়ী ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ঠিকই ১০০ মেগাওয়াট দেখানো হচ্ছে। এভাবেই বিদ্যুতের মোট উৎপাদন সক্ষমতা দেখানো হচ্ছে। অপর দিকে, যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে তা-ও মাঝে মাঝে বিতরণ করতে পারছে না বিতরণ ও সঞ্চালন লাইনের সংস্কারের অভাবের কারণে। তিনি বলেন, আগে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই বিদ্যুৎ সরবরাহে যেন বিঘœ সৃষ্টি না হয় সে জন্য সঞ্চালন লাইন মেরামত করা হতো। বিদ্যুতের তারের ওপর কোনো গাছের ডাল পড়ে তার ছিঁড়ে না যায় সে জন্য বিতরণ লাইনের পাশ থেকে গাছের ডালপালা ছেঁটে ফেলা হতো। কিন্তু এখন আর সেটি চোখে পড়ে না। এ কারণে সামান্য ঝড়-বৃষ্টিতেই সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন ভেঙে পড়ে। পাওয়ার সেলের সাবেক ডিজি বিডি রহমত উল্লাহ বলেন, গুণগত ও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পাক আর না পাক একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, মন্ত্রী, এমপি ও সরকারের আমলারা ঢাকায় থাকেন। তাই গ্রামের কথা কেউ জানতে পারেন না। ঢাকার আজকের চিত্র গ্রামের প্রতিদিনের ঘটনা। তিনি জানান, কয়েকটি বিশেষ জেলা শহর ছাড়া দেশের প্রায় সব এলাকায়ই বিদ্যুৎ য়ায় না, বিদ্যুৎ আসে
 দিনরাতে কয়েক ঘণ্টার জন্য তারা বিদ্যুৎ পান। পাওয়ার সেলের সাবেক এ ডিজির মতে, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হলে গুণগত ও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে। সেই সাথে সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের সংস্কার ও বিদ্যুৎ সরবরাহের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। অন্যথায় বিদ্যুৎ সমস্যা তিমিরেই থেকে যাবে। গত কয়েক দিন ধরে চৈত্রের তাপদাহ শুরু হতেই লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেড়েছে রাজধানীতে। আর গত সোমবার ও গতকাল ঝড়-বৃষ্টির কারণে রাজধানীতে লোডশেডিং হচ্ছে ঘন ঘন। দিনরাতে এলাকাভেদে ছয় থেকে সাতবার বিদ্যুৎ থাকছে না। এ বিষয়ে পিডিবির এক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ঝড়-বৃষ্টির কারণে সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের সমস্যা হওয়ায় কোনো কোনো এলাকায় বিদ্যুতের লোডশেডিং করা হচ্ছে। এটা উৎপাদন ঘাটতির কারণে নয়। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রাহকেরা তাদের বিদ্যুতের লোডশেডিং-জনিত সমস্যার কথা জানান নয়া দিগন্তের কাছে। রামপুরা থেকে আলী হোসেন জানান, গতকাল দিনে ও রাতে ৫ থেকে ৬ বার বিদ্যুতের লোডশেডিং হয়েছে। দিনের প্রথম ভাগে গরম পড়লেও শেষ ভাগে বৃষ্টির মধ্যেও দুইবার লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েন তারা। এর ফলে আলো-আঁধারিতে পার হয়েছে গতকাল। আগের রাতে বিকট শব্দে ট্রান্সফর্মারে আওয়াজ হয়ে বিদ্যুৎ চলে যায়, আসে কয়েক ঘণ্টা পর। রাতে হঠাৎ বিদ্যুৎ না থাকায় গরমে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন তারা। এ কথা জানান মেরাদিয়ার বাসিন্দা জাকির হোসেন। রমপুরা, মুগদা, ফার্মগেট,
উত্তরা, উলন, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রাহকেরা বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কথা জানিয়েছেন। যাত্রাবাড়ী থেকে আফজাল নামে এক গ্রাহক গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ২০০ টাকার বিদ্যুৎ বিল এখন ৬০০ টাকা পরিশোধ করছেন। কিন্তু এর পরেও লোডশেডিংমুক্ত বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। অথচ আরেক দফা বিদ্যুতের মূল্যের খড়গ ঝুলছে তাদের ওপর। এ ছাড়া আমাদের সারা দেশের প্রতিনিধিরা গত সোমবার ও গতকাল বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের তথ্য জানিয়েছেন। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড পিডিবির পরিচালক (জনসংযোগ) সাইফুল হাসান চৌধুরী জানান, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে কোনো ঘাটতি নেই। বরং উদ্বৃত্ত রয়েছে। যেমন, গতকাল প্রকৃত উৎপাদনক্ষমতা ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ৩৮৩ মেগাওয়াট। কিন্তু চাহিদা ছিল সাড়ে ৮ হাজার মেগাওয়াট। প্রকৃতপক্ষে চাহিদার চেয়ে উৎপাদনের সক্ষমতা বেশি ছিল ৮৮৩ মেগাওয়াট। তবে কী কারণে বিদ্যুতের লোডশেডিং হচ্ছে এ বিষয়ে সাইফুল হাসান জানান, ঝড়বৃষ্টির কারণে কোথাও কোথাও বিদ্যুৎ সরবরাহের বিঘœ সৃষ্টি হতে পারে। অর্থাৎ দেশে উৎপাদনজনিত কোনো ঘাটতি নেই।

No comments

Powered by Blogger.