জানো না কী, স্ববিরোধিতা জীবনের সৌন্দর্য নষ্ট করে by মাহবুব কামাল

মানুষ কি জন্মই নেয় স্ববিরোধী প্রাণী হিসেবে? অথবা এভাবে যদি বলি- স্ববিরোধিতাই কি মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম? রবীন্দ্রনাথ দিয়েই শুরু করি। তিনি আমাদের শেখালেন, ছোটগল্পে তত্ত্বকথা থাকতে পারবে না। ছোট ছোট প্রাণের ছোট ছোট আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্নার কথাই গল্পের মতো করে বলে যেতে হবে। অর্থাৎ নিছকই গল্প হয়ে উঠবে সেটা, তত্ত্ব যদি থাকতে হয়, তাহলে সেটা ভেতরে থাকবে, দেখা যাবে না।
আমরা যারা তত্ত্বের আকারে কথা বলে পাণ্ডিত্য জাহির করতে অভ্যস্ত, তারা মেনে নিলাম গুরুর এ বাণী। কিন্তু এ কী! তিনি স্ববিরোধী হয়ে উঠলেন কেন? পোস্টমাস্টার গল্পের কথাই ধরুন। তখন পালে বাতাস পাইয়াছে অথবা আরও একটু এগিয়ে পৃথিবীতে কে কাহার পর্যন্ত লিখেই কলম উঠিয়ে নিতে পারতেন তিনি। কিন্তু না, এরপর একগাদা তত্ত্ব ঝাড়লেন। আমাদের জ্ঞান দিলেন- মানবহৃদয় বুদ্ধিহীন। প্রবন্ধের ঢংয়ে আরও বললেন, এই হৃদয় একটি ভুল কাটিয়ে উঠতে না উঠতে আরেকটি ভ্রান্তিপথে জড়ানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এ ধরনের গল্পের নাম দিয়েছি আমি প্রগল্প। অর্ধেক প্রবন্ধ, অর্ধেক গল্প।
শতাব্দীটা নেহায়েতই বিংশ (ততদিনে সভ্যতা অনেক দূর এগিয়েছে), তাই গান্ধী নিজেকে ভগবানের অবতার দাবি করেননি। দশম-একাদশ কিংবা দ্বাদশ শতাব্দী হলে সম্ভবত তিনি তা করতেন, হিন্দু সমাজ তাতে বিশেষ আপত্তিও করত না অনুমান করি। এই মহাপুরুষের স্ববিরোধিতাটা একটু দেখুন। তিনি ছড়িয়েছেন অহিংসার বাণী, ছাগীর দুধ দোহনের সময় বাঁটে জোরে চাপ দিতেন না, যদি কষ্ট পায়! তো একদিন এক ফটোগ্রাফার তার ছবি তুলতে ক্যামেরা তুলে ধরলেন। তিনি বারবার নিষেধ করলেও তা মানছেন না। ফটোগ্রাফার ক্যামেরা হাতে সামনে এগিয়ে এলে গান্ধীর সঙ্গে শুরু হল ধস্তাধস্তি। শেষমেশ ছোটখাটো শরীরের গান্ধীজীই তাকে ক্যামেরাসহ মাটিতে ফেলে ছাড়লেন। বাংলা ভাষায় তিনি নিজমূর্তি ধারণ করলেন-এই বাক্যের অর্থ তিনি অগ্নিশর্মা হলেন। দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণেই তৈরি হয়েছে এই বাগধারা। নিজমূর্তি মানে প্রকৃত মূর্তি অর্থাৎ আসল মূর্তি। হ্যাঁ,গান্ধী নিজমূর্তিই ধারণ করেছিলেন সেদিন। তবে কি ক্রোধই মানুষের দ্রব্যগুণ, বাকি সবটাই মোড়ক?
বঙ্গবন্ধুও কি ৭৫ সালে স্ববিরোধী হয়ে ওঠেননি? তার সমগ্র জীবনটাই ছিল গণতন্ত্র দিয়ে মোড়া। এমনকি, স্বাধীনতার পর এই ভূখণ্ডের তিনি যখন একচ্ছত্র অধিপতি, দেশের চেয়ে তিনিই বড় বললেও অতিরঞ্জন হবে না যখন এবং আরও, সমগ্র জাতি যখন তার গায়ে একনায়কের পোশাক পরিয়ে দিতে রাজি, তখনও একটি সদ্যস্বাধীন দেশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে একনায়ক হলে তা কী এমন দোষের এমনটা ভাবেননি, গণতন্ত্রের প্রতিমাচিত্রে বসাননি অন্য কোনো রঙ। এক বছরেরও কম সময়ে দিয়েছেন একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান। নির্বাচনও দিয়েছেন এর পর। সেই বঙ্গবন্ধু দুই বছর পেরোনোর আগেই প্রতিমাটি ভেঙেই ফেললেন! প্রতিষ্ঠা করলেন একদলীয় বাকশাল।
কী সেই দুর্বোধ্য প্রহেলিকা, যা রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী ও বঙ্গবন্ধুকেও স্ববিরোধী করে তোলে? স্ববিরোধিতা জীবনের সৌন্দর্য নষ্ট করে, চরিত্রের মাধুর্য ঢেকে দেয়, ব্যক্তিত্বকে করে খাটো- এসব সত্য কি তাদের জানা ছিল না? তবে কি এই বিচ্যুতি এতই অনতিক্রম্য যে তা লংঘন করা যায় না? আমি একবার একটা গল্প লিখতে চেয়েছিলাম। গল্পের কাহিনীটি হবে : এক প্রগতিবাদী, অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ, জাত-পাত যার ধাতে নেই, অসাম্প্রদায়িকতার দর্শন প্রচার করে বেড়ান। এই প্রচারের লক্ষ্যে একটি সংগঠনও গড়ে তোলেন। একদিন তার এক কর্মী তাকে খবর দেবে যে, তার ছোট বোন এক হিন্দু ছেলের সঙ্গে প্রেম করছে। বোনের অসম প্রেমে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবেন ওই প্রগতিবাদী। গল্পের শেষ সংলাপটি তিনি উচ্চারণ করবেন-ওই শালার মালাউনের বাচ্চারে র্ধ।
অন্যের কথা কী বলব, আমি নিজেই কি কম স্ববিরোধী? যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ভার আদালতের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। সেই আমি কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড রায়ের পর কেন ছুটে গিয়েছিলাম শাহবাগে? কেন গিয়েছিলাম? ট্রাইব্যুনাল গঠনের সময় কেন বললাম না, এসব ট্রাইব্যুনাল-ফ্রাইব্যুনাল বুঝি না, যুদ্ধাপরাধীদের আমাদের হাতে ছেড়ে দিন,পিটিয়ে মারি! মুখে বলছি একক পুরুষ, ভেতরে দ্বৈতসত্তা! এক যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষিত হওয়ার পর পত্রিকার স্বার্থে ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামের প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিলাম। তিনি বললেন, আদালতের রায়ের আবার প্রতিক্রিয়া কী! রিফ্লেক্স হল আমার। নিজের মূর্খতার জন্য কখনও এতটা অপমানিতবোধ করেছি কি-না, স্মৃতি হাতড়াতে হবে। আদালত মানে কী? এ তো এক অলিখিত সামাজিক চুক্তিরই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। সবাই একযোগে চিৎকার করলে একটা হট্টগোল হবে, কিছুই অর্জিত হবে না। তাই শৃংখলার স্বার্থে আমরাই কর্তৃপক্ষ তৈরি করেছি। নিু কর্তৃপক্ষের রায়ে সন্তুষ্ট না হলে আমাদেরই তৈরি উচ্চ থেকে উচ্চতর কর্তৃপক্ষ নেবে রায় পুনর্বিবেচনার ভার। তারপর এক সময় থামতে হবে। এই থামতে জানাটা খুবই জরুরি। কীভাবে শুরু, শেষটাই বা কোথায়- আমরা কিছুই জানি না।
কীসের এত অহমিকা, ময়ূরের পেখম-ধরা পুলক আমাদের? অহংকার করতে পারেন লেনিন। ভুল করুন, শুদ্ধ করুন- স্ববিরোধী ছিলেন না। মাও-সে-তুং একদিকে কমিউনিস্ট আন্দোলন করেছেন, যা ভিন্নমত সহ্য করে না; অন্যদিকে বলেছেন- শত ফুল ফুটতে দাও। এই স্ববিরোধিতার কী অর্থ আমরা বুঝি না। লেনিন তেমনটা করেননি। তার রাজনীতি ছিল- সমাজে একটাই ফুল ফুটতে পারবে আর সেটা শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী পার্টি। সকাল-বিকাল মত পাল্টাননি তিনি। কমিউনিজম, কমিউনিস্ট শাসন ইত্যাদি নিয়ে বিতর্ক আছে বৈকি। কিন্তু লেনিনের চারিত্রিক সংহতি (Integrity) নিয়ে প্রশ্ন তোলা কঠিন। গ্লাসনস্ত, পেরেস্ত্রৈকার পর যারা লেনিনের মূর্তি নামিয়েছিল, সেই আহাম্মকদের ব্যক্তি-লেনিনের হাইট স্পর্শ করার মতো লম্বা হাত ছিল না, তাই ক্রেন দিয়ে নামাতে হয়েছিল সেসব মূর্তি। আমাদের এক বাঘা কমিউনিস্টের কথা শুনুন। মেয়ের বিয়েতে দুই ধরনের কার্ড ছাপিয়েছিলেন। একটি কমরেডদের; বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম দিয়ে শুরু হওয়া অন্যটি মুসলমানদের জন্য।
এটা এক বড় প্যারাডক্স বটে, মানুষ যুক্তিবাদী প্রাণী, অথচ সে যুক্তি প্রয়োগ করে না। হেয়ালিতেই কাটিয়ে দেয় সে জীবন। আর এই হেয়ালিই জন্ম দেয় স্ববিরোধিতার। অবশ্য যুক্তি নিষেধ করলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বার্থের টানে কথা ও আচরণ পাল্টায় সে। এদেশের রাজনীতিক শ্রেণী যেমন। কখন কী বলছেন, কী করছেন,তার ঠিক-ঠিকানা নেই। তবে কি এদের সবাই অ্যামনেসিয়ার রোগী, আগে কী বলেছেন মনে নেই? স্পষ্ট মনে আছে, প্রধানমন্ত্রী একবার বলেছিলেন, ৫৭ বছরের পর আর রাজনীতি করবেন না। তাকে বলতেই হয়, আপনি কি জানতেন না, আপনি মরে গেলে আওয়ামী লীগ ভেঙে না যাক, অন্তত দুর্বল হয়ে পড়বে আর আওয়ামী লীগ যদি না থাকে, তাহলে এদেশে মৌলবাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো শক্তি থাকবে না? তবু কেন এই স্ববিরোধিতার দায় নিতে গেলেন কাঁধে? এ ধরনের কথা তো ভোটারের সহানুভূতি আদায়ের জন্য বলবেন বয়োবৃদ্ধ, গ্রাম্য চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী- বাবারা এবারই শেষ, আর ভোট চাব না।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর মিসেস জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী হলেন, তিনি জাতির সামনে একশ দিনের একটি রূপরেখা দিয়েছিলেন। ২৪ ঘণ্টাও পার হতে পারেনি, শুরু হয়েছিল লংঘন প্রক্রিয়া। এমন একটি বাস্তবায়নঅযোগ্য রূপরেখা দিতে কেউ তাকে দিব্যি দেয়নি, অথচ তিনি রূপরেখা টানলেন এবং এক নিঃশ্বাসেই হয়ে উঠলেন স্ববিরোধী। অবশ্য দিব্যি একজন দিয়েছিলেন। তিনি নাকি ক্যামেরায় কোন্ শাড়িটি ভালো আসবে, সেটাও ঠিক করে দিয়েছিলেন। যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। স্টান্ট-মেকার তো স্টান্টবাজি করবেই। প্যাথলোজিক্যালি অ্যান্টি-আওয়ামী লীগার ও সাংবাদিকতা দলীয়করণের পাইওনিয়ার এই সম্পাদক দীর্ঘদিন লন্ডনে কাটিয়েছিলেন। এ দেশ সম্পর্কে তার ধারণা কিঞ্চিৎ, রাজনীতি বলতে তিনি বোঝেন হাসিনার চেয়ে খালেদা সুন্দরী। অথচ তিনি হয়ে গেলেন একজন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা!
আমরা যারা ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতার কথা বলি, এই ভণিতা না করে সোজাসুজি বললেই পারি- আমার মতের বাইরে কোনো মত থাকতে পারবে না। তাহলেও একটা কিছু বোঝা হয়। কিন্তু মুখে সহিষ্ণুতার কথা বলছি আর বাস্তবে- মারো, মরো, ফাটো, ফাটাও, এগোও- এটা কেমন কথা? জামায়াত ক্ষমতায় গেলে ব্লাসফেমি আইন করবে বলে আমরা শংকিত; কিন্তু খেয়াল করছি না বারো রকমের ব্লাসফেমি আইনের ঘেরাটোপে ইতিমধ্যেই বন্দি হয়ে আছি আমরা। প্রতিটি দল, সংগঠন, গোষ্ঠীর একটা করে নিজস্ব ব্লাসফেমি আইন আছে। তাদের মতের বিপরীতে কিছু বললে সেই আইনে সে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হবে। আমার ডানে শিবিরের বোমা, বাঁয়ে হেফাজতের লাঠি, সামনে ছাত্রলীগের পিস্তল, পেছনে ছাত্রদলের চকচকে কিরিচ, মাথার ওপর রঙ-বেরঙের জঙ্গির হাতে হাতে তলোয়ার-নিুগামিতাই এখন আমার নিয়তি। আমি নাকি গ্যালিলিও হতে চাই; ব্রুনো হতে চাই! সাধ মিটিয়ে দেবে না আমার!
এক বিচারে কথিত গণতান্ত্রিক দলগুলোর চেয়ে জঙ্গিরাই শ্রেয়। তাদের অন্তত স্ববিরোধিতা নেই। গতকাল যা বুঝেছে, আজও তাই বুঝছে, আগামীকালও সেটাই বুঝবে। কাজও করছে সেই বুঝ থেকে। আমরা কেন দ্বৈতসত্তা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি-একটা আব্রাহাম লিংকনের, আরেকটা মুসোলিনির। মজা তো, কথা বলবে লিংকন সত্তা আর কাজ করবে মুসোলিনি! না, না- এভাবে হবে না, হতে পারে না।
পুনশ্চ : স্ববিরোধিতা কি সবসময়ই ব্যক্তিত্ব খাটো করে? ভাবান্তরটা ইতিবাচক হলেও? না, স্ববিরোধিতা কখনও কখনও ব্যক্তিত্বকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। বাংলা সাহিত্যের একটি চমৎকার ছোটগল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রটি একটু দেখুন। কাহিনীটি অতি সংক্ষেপে নিজের ভাষায়ই বলি।
পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষে (বাংলা ১৩৫০, খ্রিস্টীয় ১৯৪৩) দুর্ভিক্ষপীড়িত এক দম্পতির ক্ষুধার জ্বালা তো আছেই, সম্ভ্রমও যায় যায়। স্ত্রীর একমাত্র শাড়িটি শতছিন্ন। ওটা আর পরা যায় না। গরিবের কাছে ক্ষুধার চেয়ে সম্ভ্রম বড় এজেন্ডা। স্বামী তাই বাজারে জনে জনে টাকা মাগে। পায় না। আড়তদারদের ( দুর্ভিক্ষটা খাদ্যের অভাবে হয়নি, ক্রয়ক্ষমতার অভাবে হয়েছে) কাছে গিয়েও ব্যর্থ হয়। শেষে এক ফন্দি আঁটে সে। পতিতালয়ে যায়। শরীর দুর্বল; কিন্তু মনের জোর অনেক। পতিতার ঘাড় মটকিয়ে কাবু করে তাকে। খুলে নেয় পরনের শাড়ি, তারপর ছুট। দরজা থেকে কী মনে করে সে ফিরে তাকায়। চোখ পড়ে পতিতার উরুতে। সে এক ঘিনঘিনে দৃশ্য! ঘা থ্যাকথ্যাক করছে সমগ্র উরুপ্রদেশে। ভাবান্তর হয় তার। ভাবে, সুন্দরকে না ঢাকলেও চলে, অসুন্দরকেই ঢেকে রাখতে হয়। ছুড়ে মারে সে শাড়িটি। এর পর মৃদুপায়ে ফিরে আসে।
পুনশ্চের পুনশ্চ : অসুন্দরকেই ঢেকে রাখতে হয়-এটা কিন্তু গল্পকারের তত্ত্ব নয়, গল্পটির চরিত্রের উপলব্ধি। সুতরাং এতে ছোটগল্পের রীতি লংঘতি হয়নি।
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক
mahbubkamal08@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.