হরতালের ক্ষতি

দেশের রাজনীতিতে হরতাল এক মারাত্মক অপসংস্কৃতির রূপ নিয়েছে। কারণে-অকারণে, এমনকি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক কারণেও হরতালের ডাক দেয়া হচ্ছে। যেমন, এ মুহূর্তে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিরুদ্ধে আদালতের দেয়া রায়ের প্রতিবাদে জামায়াতে ইসলামী পালন করছে লাগাতার হরতাল কর্মসূচি। হরতালের কারণে অর্থনীতি, শিক্ষা, কৃষি, পরিবহন ইত্যাদি খাতের তথা জনগণের কী ক্ষতি হচ্ছে, তা বিবেচনায় নেয়া হয়নি। কখনোই হরতাল আহ্বানকারীরা তা বিবেচনায় নেন না। বস্তুত প্রতিটি হরতালই বিপুল ক্ষতির কারণ। এই অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা কত জরুরি, মঙ্গলবার যুগান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এতে ঢাকা চেম্বারের এক গবেষণার বরাতে বলা হয়েছে, একদিনের হরতালে দেশের অর্থনীতিতে ২০ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থাৎ প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। এ ক্ষতি শুধু ব্যবসা ক্ষেত্রে। বর্তমানে সহিংসতা হরতালের অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর ছয় মাসে দেশে মোট ৫৫টি হরতাল-অবরোধ হয়েছে। ওই সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় ক্ষতি হয়েছে ৪৯ হাজার কোটি টাকা।
হরতালের সময় পরিবহন খাতের ক্ষতিও বিপুল, কারণ এ সময় পরিবহন বিশেষত দূরপাল্লার পরিবহন বন্ধ থাকে। ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একদিনের হরতালের দেশের সড়ক পরিবহন খাতে প্রায় ২৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয় শুধু পরিবহন বন্ধ থাকার কারণে। পরিবহন বন্ধ থাকায় গ্রাম থেকে সবজি ও অন্যান্য ফসল শহরে আনা সম্ভব হয় না। এতে ক্ষেতেই নষ্ট হয় ফসল। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষক সমাজ। হরতালের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দিনমজুর তথা স্বল্প আয়ের মানুষ। কারণ হরতালের কারণে তাদের কাজ বন্ধ থাকে। ফলে হরতালের দিন তাদের সন্তান-পরিজন নিয়ে উপোস থাকতে হয়।
হরতালের কারণ শিক্ষা খাতের যে ক্ষতি হচ্ছে, ভবিষ্যতে এর মাশুল দিতে হবে গোটা জাতিকে। জামায়াতের এবারের ডাকা হরতালের কারণে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট পরীক্ষা ইতিমধ্যেই দুদফা পেছানো হয়েছে। পেছানো হয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিস্টার ও ভর্তি পরীক্ষাও। স্থবির হয়ে পড়েছে অন্যান্য শিক্ষা কার্যক্রমও।
এসবের বাইরেও হরতালের আরও অনেক ক্ষতিকর দিক রয়েছে। যেমন- ঘন ঘন হরতালের কারণে বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বিনিয়োগ পরিস্থিতির ওপর। হরতালে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ায় এবং বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হওয়ায় ক্রমেই রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ। ফলে বাড়ছে বেকারত্ব। এর নানা নেতিবাচক
প্রভাব পড়ছে সমাজে।
যে হরতালের এত ক্ষতি, তা কোনোভাবেই চলতে দেয়া যায় না। আজ সময় এসেছে হরতালের বিষয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করার, হরতাল অপসংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে বিকল্প সন্ধানের। উচ্চ আদালত, সরকারের নীতিনির্ধারক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ- সবার কাছ থেকেই এ বিষয়ে যৌক্তিক পদক্ষেপ আশা করে দেশবাসী। সবকিছু জেনেশুনে দেশের ক্ষতি হতে দেয়া যায় কি-না, তা ভাবতে হবে সবাইকে। মনে রাখতে হবে, সবকিছুর ওপরে দেশ ও জনগণ। জনস্বার্থকে দিতে হবে অগ্রাধিকার।

No comments

Powered by Blogger.