পার্লামেন্ট ভবনে হামলা বদলে দেবে কানাডাকে? by মোহাম্মদ হাসান শরীফ

কানাডার রাজধানী অটোয়ায় পার্লামেন্ট ভবন এলাকায় ২২ অক্টোবর দুপুরে এক বন্দুকধারীর আক্রমণের খবরটি আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় যেভাবে পরিবেশিত হয়েছে, তাতে মনে হয়েছে, ওই ঘটনায় পুরো বিশ্বই কেঁপে উঠেছে। কেন, কিভাবে, কারা এই হামলা চালাল, তা নিয়ে নানামুখী বিশ্লেষণ চলছে। তবে সবকিছুই অন্ধকারে ঢিল মারার মতো করে হচ্ছে। স্পষ্ট কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই কোথাও, কারো হাতেই।

এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, তা হলো হামলাকারী মাইকেল জেহাফ-বিবু কিছু দিন আগে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। হামলায় জেহাফ-বিবু ও এক সৈন্য নিহত হয়। বন্দুকধারী মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন কি না তাও জানা যায়নি। তিনি কোনো চরমপন্থী দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন কি না তাও নিশ্চিত নয়।
বন্দুকধারীর উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। তবে প্রায় সব বিশ্লেষণেই বলা হচ্ছে, এ ঘটনা কানাডায় ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। ইসলামি চরমপন্থীবিরোধী আওয়াজ শোনা যেতে পারে। নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থায় মারাত্মক কড়াকড়ি আরোপ করা হতে পারে।
কানাডাবাসী নিজেদের ‘শান্তিপ্রিয় দেশবাসী’ হিসেবে দেখতে চায়। তারা আশা করে, তারা সন্ত্রাসবাদের শিকার হবে না। বিশেষ করে আমেরিকা যে পরিস্থিতির মুখে পড়েছে, তেমন অবস্থায় তাদের পড়তে হবে না। এই বিশ্বাসে বড় ধরনের ঝুঁকি দিতে পারে এই ঘটনা। ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে এ নিয়ে যত বেশি আলোচনা হবে, আতঙ্ক তত বাড়বে, অস্থিতিশীলতা সবাইকে কুরে কুরে খাবে।
হামলার সময় পার্লামেন্ট ভবনে প্রধানমন্ত্রী এবং সরকার ও বিরোধী দলের অনেক এমপি উপস্থিত ছিলেন। তাদের কেউ এতে আহত হননি। প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার একটি আলমারির ভেতরে প্রায় ১৫ মিনিট লুকিয়ে ছিলেন। আর অন্য এমপিরা পতাকাদণ্ড নিয়ে ওই হামলাকারীকে মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন।
হামলার পরপরই কয়েকটি মিডিয়া এর সাথে ইরাক ও সিরিয়ায় সক্রিয় ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সম্পৃক্ততার কথা বলে। তবে কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন বেয়ার্ড জানিয়েছেন, হামলাকারী মাইকেল জেহাফ-বিবু ‘চরমপন্থী’ হলেও অত্যন্ত বিপজ্জনক ব্যক্তিদের তালিকাভুক্ত নন। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, জেহাফ-বিবু আইএসের সাথে জড়িত বলে কারো পক্ষ থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট দাবি করা হয়নি। তিনি বলেন, কানাডার ‘উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ’ চরমপন্থার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সিরিয়া ও ইরাকে গিয়ে লড়াই করছে। ব্যাপারটা বেশ উদ্বেগজনক। তবে বুধবারের হামলার সাথে এর যোগসূত্র মেলানোর জন্য পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, প্রায় ১০০ জন কানাডীয় মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে জিহাদি লড়াইয়ে অংশ নিচ্ছে।
মাইকেল জেহাফ-বিবুর গত বুধবারের ওই হামলা নিয়ে কানাডা পুলিশ যে ভিডিওচিত্র প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, বন্দুকধারী জেহাফ-বিবু প্রথমে এক মন্ত্রীর মোটরগাড়ি ছিনতাই করে পার্লামেন্টের কেন্দ্রীয় এলাকার দিকে ছুটে যান। পুলিশ তাকে ধাওয়া করে। একপর্যায়ে জেহাফ-বিবু গাড়ি থেকে বেরিয়ে পার্লামেন্ট ভবনের দিকে এগিয়ে গিয়ে গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। এ সময় তিনি একজন রিজার্ভ সেনাসদস্যকে মারাত্মকভাবে আহত করেন। ওই সেনাসদস্য পরে মারা যান। এরপর জেহাফ-বিবু পার্লামেন্ট ভবনসংলগ্ন স্মৃতিসৌধের কাছাকাছি নিরাপত্তা কর্মকর্তার গুলিতে প্রাণ হারান।
অটোয়ার পার্লামেন্ট ভবন এলাকাটিতে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে। আমেরিকান দূতাবাস ও ব্রিটিশ হাইকমিশনও সেখানে অবস্থিত। জেহাফ-বিবুর সাথে আরো হামলাকারী আছেÑ এই সন্দেহে ওই এলাকা কয়েক ঘণ্টা বন্ধ করে তল্লাশি চালানো হয়।
একজন লোক কিভাবে অত্যন্ত সুরক্ষিত ওই এলাকায় ঢুকতে পারল, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কয়েক মাস আগে থেকেই সেখানকার নিরাপত্তাব্যবস্থায় কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ফলে কোনো বন্দুকধারীর সেখানে প্রবেশ করা সহজ নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে কানাডার রাজনীতিতে আরেক দফা পরিবর্তন এসেছে। হারপারের রক্ষণশীল সরকার সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে অন্যতম ইস্যুতে পরিণত করেছে। প্রধান দুই বিরোধী দলের বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী হারপার আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ইরাকে সৈন্য পাঠিয়েছেন। এ প্রেক্ষাপটে প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট দাবি করেছে, গুলির এ ঘটনাকে যদি চরমপন্থী ইসলামের সাথে সম্পর্কিত করা যায়, তাহলে এটা রাজনৈতিক ফুটবলে পরিণত হবে। সব দলই ২০১৫ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনে এটাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করবে।
এর আগে কানাডার পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন এসেছিল আফগানিস্তানের যুদ্ধের সময়। এ ছাড়া ইসরাইলের প্রতিও তাদের ব্যাপক সমর্থন দেখা যায়। এখন আইএসের বিরুদ্ধেও জোট পাকানোতে তাদের ভূমিকা চোখে পড়ার মতো। এসব ঘটনায় চরমপন্থীরা ক্ষুব্ধ হতে পারে।
এ ঘটনার রেশ ধরে আরেকটি পরিবর্তন আসতে পারে, সেটা অভিবাসীদের জন্য। মুসলিম বিশ্ব থেকে অভিবাসনে কড়াকড়ি আরোপ করা হতে পারে। ঘটনার দিনই কানাডার সিনেটর ফ্যাবিয়ান ম্যানিং বলে ফেলেছেন, ‘আজ আমাদের দুনিয়া চিরদিনের মতো বদলে গেল। তবে আমরা এখনো জানি না, কতটুকু বদলাল।’
বিশ্ববাসীকে অপেক্ষায় থাকতে হবে এটা জানতে যে, কতটুকু বদলাল কানাডা।

No comments

Powered by Blogger.