ফের রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনীতি

গত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের আগে থেকেই দেশের অর্থনীতিতে মন্দাভাব বিরাজ করছে, যা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এর মধ্যে টানা হরতাল শুরু হয়েছে। ফলে আবারও দেশের অর্থনীতি রাজনৈতিক অস্থিরতার প্যাঁচে পড়তে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা। তাদের মতে, হরতালের কারণে পণ্য শিপমেন্ট করতে পারছেন না শিল্প উদ্যোক্তারা। পিকেটারদের ভয়ে ঢাকার বাইরে পণ্যবাহী ট্রাক পাঠাতে সাহস পাচ্ছেন না তারা। এর আগের হরতালে অনেক পণ্যবাহী ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে হরতাল সমর্থকরা। অন্যদিকে রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় খাত পোশাকশিল্প হরতালের আওতামুক্ত রাখার কথা থাকলেও উভয় সঙ্কটে পড়েছে তৈরী পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এভাবে টানা হরতাল চলতে থাকলে অর্থনীতির রক্তক্ষরণ আরও বেড়ে যাবে। এ অবস্থায় আরও নাজুক হয়ে পড়বে অর্থনীতি। ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়বে। হরতালের কারণে পণ্যের সরবরাহ বন্ধ থাকায় দাম বেড়ে যাবে। কৃষিপণ্য পচে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই। তারা জানান, দৃশ্যত সব কিছুই স্বাভাবিক। দোকান, কাঁচাবাজার, শপিংমলসহ সব প্রতিষ্ঠান খোলা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এসব প্রতিষ্ঠানে উল্লেখযোগ্য গ্রাহক নেই। বেচা-কেনা নেই। তাই দিনের পর দিন টানতে হচ্ছে লোকসানের ঘানি।
কাওরান বাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী খোরশেদ আলম মানবজমিনকে জানান, গত চার দিনের হরতালে ৬০ বস্তা চাল বিক্রি করতে পারিনি। স্বাভাবিক দিনে দৈনিক ১৫ বস্তা চাল বিক্রি করি। কিন্তু হরতালের কারণে দৈনিক এক বস্তা চালও বিক্রি করতে পারি না।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি এসএ কাদের কিরণ মানবজমিনকে জানান, স্বাভাবিক দিনে দৈনিক সারা দেশে লেনদেন হয় প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। কিন্তু হরতালের দিনে উল্লেখযোগ্য কোন লেনদেন হয় না। বরং কর্মচারী, ব্যাংক লোনের সুদ ও দোকান ভাড়া বাবদ উল্টো গচ্চা দিতে হয়।
বিজিএমইএ’র সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের রাজনৈতিক সহিংসতায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েন উদ্যোক্তারা। ওই বছরে ৭২ দিনে এ শিল্পের উৎপাদন ক্ষতি হয় ১১,৭৫০ কোটি টাকা। এ ছাড়া জাহাজে পণ্য না পাঠিয়ে বিমানযোগে পাঠানোর জন্য তো বাড়তি খরচ আছেই। একই সঙ্গে দিনের পর দিন শ্রমিকদের বসিয়ে বেতন দিতে হয়েছে। গার্মেন্ট শিল্পের লিংকেজ কারখানাগুলোও ছিল বন্ধ। এবারও টানা হরতাল হতে থাকলে এ শিল্পের বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন উদ্যোক্তারা। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন তারা।
বিজিএমইএ’র সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজীম জানান, গত বছরের হরতালের ক্ষতি এখনও পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। ওই সময়ের হরতাল-অবরোধে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আবারও টানা হরতাল শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, উদ্যোক্তারা এখন উদ্বিগ্ন। হরতালের হাত থেকে পোশাকশিল্পকে বাঁচানো না গেলে দেশের পুরো অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে যাবে। অন্যদিকে উদ্যোক্তারা পথে বসে যাবেন। হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হবে। তখন আবারও অস্থিরতা সৃষ্টি হবে, যা কারও পক্ষে ঠেকানো কঠিন হবে।
এদিকে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো হরতাল বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই জানায়, হরতালের মতো কর্মসূচি দেশের অর্থনীতিকে চরম বিপর্যয় ও এক অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে দেশের ব্যবসায়ী সমাজ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে বলে জানায় সংগঠনটি। এ অবস্থায় ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে হরতাল প্রত্যাহার করার আহ্বান জানান এফবিসিসিআই নেতারা।
জানা গেছে, গত বছর টানা হরতালের কারণে সময়মতো পণ্য পাঠাতে না পারায় একের পর এক অর্ডার বাতিল করতে থাকেন ক্রেতারা। অবশ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসায় তৈরী পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, সরকারের প্রতিনিধি দল ও উদ্যোক্তারা আবারও ক্রেতা দেশগুলোয় সফর করে তাদের ফিরিয়ে আনতে কিছুটা সক্ষম হয়। এর আগে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড ও রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক শ্রমিক নিহত হওয়ায় অনেক ক্রেতা দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কঠিন কঠিন শর্ত জুড়ে দেয়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশী পণ্যের অগ্রাধিকারমূলক পণ্যের প্রবেশাধিকার (জিএসপি) স্থগিত করে দেয়। আর বাংলাদেশী পোশাকশিল্পের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) জিএসপি স্থগিতের হুমকি দেয়। এরপর সরকার, মালিকপক্ষ নড়েচড়ে বসে। অল্প সময়ের মধ্যে অনেক শর্ত পূরণ করেছেন তারা। এরই মধ্যে আমেরিকান ক্রেতাদের জোট ও ইইউ’র ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স আবারও কঠিন পর্যবেক্ষণে পরিদর্শন করেন পোশাক কারখানাগুলো। অনেক কারখানা বন্ধ করে দেন তারা। আর শ্রমিক অসন্তোষ তো লেগেই আছে এ শিল্পে। কারণে-অকারণে কারখানায় কাজ বন্ধ করে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছেন শ্রমিকরা। অনেক ক্ষেত্রে কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে মালিকপক্ষ।
বিজিএমইএ সূত্র জানায়, বর্তমানে পোশাক রপ্তানির ভরা মওসুম চলছে। আসন্ন শীত ও বড় দিনের বাজার ধরার জন্য আন্তর্জাতিক ক্রেতারা বাংলাদেশকে যেসব অর্ডার দিয়েছে তার সরবরাহ পেতে তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রয়েছেন। এখনও জাহাজীকরণ করলে তা বাজার ধরতে পারবে। কিন্তু আর এক সপ্তাহ দেরি হয়ে গেলে ওই সব পণ্য আর বড় দিন ও শীতের বাজার ধরতে পারবে না। ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে যে পণ্য রপ্তানি হয় তার বেশির ভাগই যায় শীতের সময়ে।
এ বিষয়ে বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপিত ও এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, পোশাকশিল্প যদিও হরতালের আওতামুক্ত, কিন্তু এ শিল্পের সঙ্গে লিংকেজ শিল্পগুলোর কাজ বন্ধ থাকে। সাপ্লাই বন্ধ থাকে। এ ছাড়া এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পণ্যবাহী ট্রাক যেতে পারে না। ফলে সময়মতো পণ্য ক্রেতাদের কাছে পৌঁছানো যায় না। ক্রেতাদের কাছে সময়মতো পণ্য পৌঁছতে না পারলে তারা অর্ডার বাতিল করে দেন। এর দায়ভার পড়ে কারখানা মালিকের ওপর।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ১৮০ দিনের মধ্যে দেশে ৫৫ দিন হরতাল-অবরোধ হয়েছে। ওই সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় ক্ষতি হয়েছে ৪৯ হাজার কোটি টাকা। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে একদিনের হরতালের কারণে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় পরিবহন খাতে। এ খাতে ক্ষতির পরিমাণ ৩০৩ কোটি টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কৃষি খাত। এ খাতে এক দিনের হরতালে ক্ষতি হয় ২৮৮ কোটি টাকা। বস্ত্র ও গার্মেন্ট খাতে ক্ষতির পরিমাণ হচ্ছে ২৫০ কোটি টাকা। পর্যটন খাতে ক্ষতির পরিমাণ হচ্ছে ৫০ কোটি টাকা। বিজিএমইএ’র তথ্য মতে, এক দিনের হরতালে তাদের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় কমপক্ষে ১০৮ কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির আদেশ দেয়ার পর সংগঠনটি ৩ দফায় ৫ দিনের হরতালের ঘোষণা দেয়। এ ছাড়া কামারুজ্জমানের ফাঁসি কার্যকর হলে আগামী দিনগুলোতে আরও হরতালের আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।

No comments

Powered by Blogger.