গড়ে প্রতি মাসে অপরাধে জড়াচ্ছে ১০০ পুলিশ by নুরুজ্জামান লাবু

বেপরোয়া হয়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের মাঠ পর্যায়ের কিছু পুলিশ সদস্য। জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যাদের কাজ করার কথা তারা নিজেরাই জড়িয়ে যাচ্ছেন অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। দিন দিন বেড়েই চলেছে এই অপরাধ প্রবণতা। ঘুষ-দুর্নীতির নিত্যদিনের অভিযোগ ছাপিয়ে খুন, চাঁদাবাজি, অপহরণ আর ছিনতাইয়ের মতো গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা। দেড় লক্ষাধিক সদস্যের পুলিশের এ বিশাল বাহিনী কতিপয় সদস্যের জন্য ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে। বিশেষ করে কনস্টেবল থেকে শুরু করে এএসআই, এসআই ও পরিদর্শকরা বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন বেশি। পেশাদার পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, রাজনৈতিক বলয়ে থাকা মুষ্টিমেয় কিছু পুলিশ সদস্য পুলিশ বাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্ন করছে। অপরাধ করে রাজনৈতিক প্রভাবে পার পেয়ে যাওয়ার কারণে তাদের দেখে অন্যরা উৎসাহিত হচ্ছেন। পুলিশের সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নূরুল হুদা বলেন, পুলিশের সদস্যরা সাধারণ বা ফৌজদারি অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সুপারভিশনের অভাব। ওপর থেকে যথাযথ সুপারভিশন না হওয়ায় পুলিশ সদস্যরা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এটি বন্ধ করতে হলে অপরাধে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত তৈরি করতে হবে। যাতে অন্য কেউ অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সাহস না পায়।
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতি মাসে গড়ে ১০০ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। অভিযোগ ওঠার পরপরই সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও প্রয়োজনে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হচ্ছে। গত দেড় বছরে অন্তত শতাধিক পুলিশ সদস্যকে ফৌজদারি মামলায় গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। গত বছর পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এরকম ১ হাজার ২৬৮ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ তদন্ত করা হয়। এর মধ্যে ৬৪৮ জনকে বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দেয়া হয়। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮৯০টি অভিযোগ আমলে নেয়া হয়েছে। এসব অভিযোগের তদন্ত চলছে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে পুলিশ অধ্যাদেশ ও সরকারি কর্মচারী আচরণবিধি মোতাবেক অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের চাকরিচ্যুতি, বরখাস্ত, পদাবনতি, ইনক্রিমেন্ট বাতিলসহ বিভিন্ন ধরনের বিভাগীয় শাস্তি দেয়া হবে। সূত্র জানায়, পুলিশের কেউ ফৌজদারি অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার পাশাপাশি ফৌজদারি মামলাও হয়। এক্ষেত্রে আদালতের রায় ও বিভাগীয় তদন্তের আলোকে শাস্তি দেয়া হয়। সম্প্রতি পুলিশ সদস্যের মধ্যে ফৌজদারি অপরাধের প্রবণতা বেড়ে গেছে। তবে ফৌজদারি অপরাধে এ পর্যন্ত কতজন পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়ে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। পুলিশ সদর দফতরের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, বছরে কমবেশি ১০ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠে। অপরাধেল মাত্রা নির্ধারণ করে গুরু দন্ড ও লঘু দণ্ড দেয়া হয়। কনস্টেবল থেকে এএসআই পর্যন্ত পুলিশ সদস্যদের অভিযোগ তদন্ত করে পুলিশের ডিসিপ্লিনারি ও প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড বিভাগ। আর এসআই থেকে পরিদর্শক পর্যায়ের পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দপ্তরের সংস্থাপন শাখা। এএসপি থেকে উচ্চ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই কর্মকর্তা জানান, পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এসব বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্সে’র ঘোষণা দিয়েছেন। পুলিশ সদর দপ্তরের প্রতিটি সভায় এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনার পর পুলিশ সুপার ও সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়। মাওলনা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আশরাফুল আলম বলেন, পেশাদারিত্বের অভাবে পুলিশে এ রকম ঘটনা ঘটছে। পুলিশের মধ্যে পেশাদারিত্বের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। একই সঙ্গে পুলিশের সদস্যদের কেউ অপরাধে জড়িয়ে পড়লে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি দেখাতে হবে। কারণ পুলিশ একটি শৃঙ্খল বাহিনী। পুলিশই যদি অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে তাহলে মানুষের আস্থা কমে যাবে। সমাজে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হবে। তিনি বলেন, প্রয়োজনে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের মোটিভিশনের জন্য পর্যায়ক্রমে ট্রেনিংসহ তাদের আর্থিক সুবিধা বাড়াতে হবে।
পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কম পাওয়া গেলেও মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। নিরীহ মানুষকে ধরে গ্রেপ্তার ও ক্রসফায়ারে ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় এখন নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করা হচ্ছে যত্রতত্র। বিশেষ করে রাজনৈতিক বলয়ে থাকা পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাল্লা বেশি ভারি। এসব সদস্যের চেইন অব কমান্ড ভাঙার প্রবণতাও বেশি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশের অপরাধের তদন্ত বা অনুসন্ধান পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমেই পরিচালিত হয়। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহানুভূতি লাভ করেন। একারণে অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না নিয়ে লঘু দণ্ড দেয়া হয়। আর অন্য বাহিনী দিয়ে তদন্ত করালে পুলিশ তাদের তদন্তে সহযোগিতা করে না। চলতি বছরের ৫ই জানুয়ারি নির্বাচনের আগে ও পরে সারা দেশে দু’শতাধিক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে যে আটক বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সেই ঘটনার তদন্তে র‌্যাবকে দেয়া হয়। কিন্তু তদন্তে পুলিশের বিরুদ্ধে সহযোগিতা না করার অভিযোগ রয়েছে।
গত শুক্রবার রাজধানীর ভাটারা থানার দুই এএসআই ও এক কনস্টেবল মিলে এক নারীকে দিয়ে ফাঁদ পেতে বেসরকারি এক চাকরিজীবীকে আটকে রাখে। পরে তারা ওই চাকরিজীবীর পরিবারের কাছে ফোন করে দু’লাখ টাকা দাবি করে। পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি র‌্যাব সদস্যদের জানালে টাকা নেয়ার সময় র‌্যাব তাদের হাতেনাতে আটক করে। গত ২৭শে অক্টোবর বান্ধবীর সঙ্গে অনৈতিক কাজ করতে গিয়ে নিজের গুলিভরা সরকারি রিভলভারটি হারিয়ে ফেলেন পাবনা সদর থানার এসআই জাহিদ। পরে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। শাহ আলম নামে এক গাড়িচালকের স্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়ার জের ধরে তাকে ধরে এনে দুই পায়ে গুলি করে সন্ত্রাসী বানানোর চেষ্টা করেছিলেন রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানার এসআই আনোয়ার। ওই ঘটনায় শাহ আলমের ভাই বাদী হয়ে মামলা দায়ের করলে এসআই আনোয়ারকে গ্রেপ্তার করে দু’দফা রিমান্ডের পর জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। মিরপুরে এক ঝুট ব্যবসায়ীকে থানায় ধরে এনে এক পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন এসআই জাহিদ নামে আরেক পুলিশ কর্মকর্তা। তার বিরুদ্ধে আগেও এক বিহারী যুবককে থানায় পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। কিছুদিন আগে উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকা থেকে র‌্যাব অবৈধ অস্ত্রসহ আসাদ নামে পুলিশের বিশেষ শাখার এক এসআইকে গ্রেপ্তার করেছে। রাজধানীর বংশালে মকবুল নামে এক ব্যবসায়ীকে ভয় দেখিয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা চাঁদা আদায়ের অভিযোগ ওঠে। ওই ব্যবসায়ী চাঁদা আদায়ের ভিডিও রেকর্ডসহ আদালতে মামলা দায়ের করলে ওইদিনই সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা টাকা ফিরিয়ে দিয়ে মামলার হাত থেকে রক্ষা পান। তবে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। তেজগাঁও থানাধীন হাতিরঝিল এলাকা থেকে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার শফিকুল রহমানের ছেলেকে গ্রেপ্তারের পর ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয় তেজগাঁও থানার দুই এসআই ফরমান আলী ও আবুল কালাম। তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গত ১০ অক্টোবর রাতে রাজধানীর ভাষানটেকের গোলটেক বালুর মাঠে মামাতো বোনকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় স্থানীয় সন্ত্রাসীদের পিটুনিতে খুন হন যুবক নাসির উদ্দিন। স্থানীয় সন্ত্রাসীদের সঙ্গে থানা পুলিশের সখ্যতা থাকায় উত্ত্যক্তের বিষয়টি চাপা দেয়ার চেষ্টা করে ভাষানটেক থানা ও ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা। এ ঘটনায় ওসিকে বদলি ও পরিদর্শক (তদন্ত)সহ ১৯ পুলিশ সদস্যকে একযোগে প্রত্যাহার করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.