সার নিয়ে রমরমা ব্যবসা by ফারজানা লাবনী

ইউরিয়া সারের অন্যতম কাঁচামাল গ্যাস সংকটের কারণে বছরের আট মাস বন্ধ থাকে ইউরিয়া সার কারখানাগুলো। ফলে চাহিদার দুই-তৃতীয়াংশই মেটাতে হয় আমদানি করে। এতে একদিকে যেমন সরকারি সার কারখানাগুলো লোকসান গুনছে, অন্যদিকে সার আমদানিতে প্রতিবছর দেশের বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হচ্ছে।


ইউরিয়া সারের উৎপাদন, আমদানি ও বিপণন সরকারের হাতে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দরপত্রে অংশ নিয়ে সার আমদানি করে সরকারকে সরবরাহ করে। কারখানা কর্তৃপক্ষের দাবি, সরকারি সার কারখানাগুলো সারা বছর উৎপাদনে থাকলে মাঠপর্যায়ে কৃষকের চাহিদা পূরণ সম্ভব। এগুলো চালু রাখলে সারা বছরে গ্যাস বাবদ খরচ হতো ৯৫০ কোটি টাকা। এতে বেঁচে যেত চার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। হাতে গোনা কয়েকটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের হাতেই ঘুরছে সারের বার্ষিক চার হাজার কোটি টাকার আমদানি বাজার। বছরের পর বছর চলছে এ প্রক্রিয়া।
বিসিআইসির চেয়ারম্যান গোলাম রব্বানী কালের কণ্ঠকে বলেন, কারখানা চালু থাকলে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিও করা সম্ভব হবে। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এ দেশ থেকে সার রপ্তানি হয়েছে।
ইউরিয়া কারখানাগুলো আট মাস বন্ধ থাকায় কেবল সার আমদানিই নয়, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আনুষঙ্গিক নানা ব্যবসার দুয়ার। লাখ লাখ টন সার পরিবহন নিয়েও রয়েছে বড় ব্যবসা। এ ক্ষেত্রে গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। অন্যদিকে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে বিকল যন্ত্রাংশ পরিবর্তন বা মেরামত করে কারখানাগুলো সচল করতেও ব্যয় হচ্ছে প্রচুর। আনা হচ্ছে বিদেশি বিশেষজ্ঞ। যন্ত্রাংশ বিক্রি ও সার্ভিসিং, বিদেশি বিশেষজ্ঞ সেবা কেনার টাকা যোগ হচ্ছে সরকারি কারখানাগুলোর খরচের খাতায়। বাড়ছে তাদের লোকসানের অঙ্ক। সার নিয়ে এ বাণিজ্যে সরকারি অর্থ গচ্চা যাচ্ছে, অন্যদিকে লাভবান হচ্ছেন মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ী।
দেশের কারখানায় ইউরিয়া সারের উৎপাদন খরচ পড়ে কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১১ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এ সার কিনতে হয় ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়। সরকার ভর্তুকি দিয়ে কৃষকদের কাছে বিক্রি করে ১৮ টাকায়। ভর্তুকির এ টাকা দিতে হচ্ছে আমদানিকারকদের।
গ্যাস সংকটকে কারখানা বন্ধ রাখার একটি অজুহাত হিসেবে দেখা হয়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাসের সরবরাহ কম থাকলে কয়লাজাত উপকরণ দিয়েও ইউরিয়া সার উৎপাদন সম্ভব। তবে সেই পথে না গিয়ে আমদানির সহজ পথ বেছে নিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। উৎপাদনের চেয়ে আমদানির পরিমাণই এখন বেশি এ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প করপোরেশনের (বিসিআইসি)। সরকারি ছয়টি ইউরিয়া কারখানার দেখভাল করে প্রতিষ্ঠানটি।
শিল্প মন্ত্রণালয় এবং বিসিআইসির কর্মকর্তারাও অবশ্য স্বীকার করেন, সার কারখানাগুলো সচল থাকলে বিসিআইসির মতো বড় প্রতিষ্ঠানকে লোকসান গুনতে হতো না। তাঁদের হিসাবে ছয়টি সার কারখানা সারা বছর উৎপাদনের জন্য চালু রাখতে বছরে ৯৫০ কোটি টাকার গ্যাস লাগত। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী এই কৃষি মৌসুমে দেশে ২৫ লাখ টন সারের চাহিদা রয়েছে। গতকাল পর্যন্ত বিসিআইসির কাছে মজুদ রয়েছে তিন লাখ ৫০ হাজার ২৪৩ টন সার। এবার স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা আট লাখ টন। বাকি সার আন্তর্জাতিক দরপত্র এবং সরকারি পর্যায়ে চুক্তির মাধ্যমে আমদানি করা হবে। শিল্প মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সার আমদানির জন্য এ বছর তাদের বাজেট চার হাজার কোটি টাকা। যা দেশে উৎপাদন করলে খরচ হতো এক হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে সার আমদানি বাবদ সরকারের লোকসান তিন হাজার কোটি টাকা।
আবার কারখানা বন্ধ রাখা হলে যন্ত্রপাতির যে ক্ষতি হয়, তার মেরামত খরচের অঙ্কও ছোট নয়। কারখানা চালুর সময় যন্ত্রপাতি মেরামতে অন্য বারের মতো এবারও বিসিআইসির বড় অঙ্কের বাজেট রয়েছে। তা এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর সার কারখানার যান্ত্রিক ক্রটি মেরামতে মালয়েশিয়া থেকে একজন বিশেষজ্ঞকে আনার বাবদ ফি ধরা হয়েছে ৫০ লাখ টাকা।
শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, কারখানা বন্ধ থাকলেও বড় অঙ্কের অর্থ চলে যায় যন্ত্রপাতি মেরামতে। এ ছাড়া কারখানা বন্ধ থাকলেও শুধু গ্যাস ছাড়া অন্য সব খরচই হয়। আয় না থাকায় সব খরচের অর্থ সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় হয়। যন্ত্রপাতিগুলো সামান্য কিছু মেরামত করে বিসিআইসির সার কারখানাগুলো সারা বছর চালু রাখা সম্ভব হলে এক ছটাকও সার আমদানির প্রয়োজন হয় না।
দেশের বিশেষজ্ঞরাই সার কারখানার যন্ত্রপাতি মেরামতে সক্ষম- এমন দাবি করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কামাল আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ দেশের বিশেষজ্ঞরা আন্তর্জাতিক পরিধিতে প্রতিযোগিতা করে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। অথচ আমাদের সরকারি কর্মকর্তারা বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়ে আসতেই বেশি আগ্রহী। এ ক্ষেত্রে তাঁদের মানসিকতার পরিবর্তন করলেই সরকারি অর্থ সাশ্রয় হবে।' গ্যাস সরবরাহের এমন অব্যবস্থাপনায় সার কারখানাগুলোর যন্ত্রপাতিতে মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে জানিয়ে তিনি এসব প্রতিষ্ঠানে সারা উৎপাদন অব্যাহত রাখতে কয়লা ব্যবহারের সুপারিশ জানান।
বিসিআইসির এক কর্মকর্তা বলেন, গ্যাস সংকট শুরু হলে বিসিআইসি থেকে গ্যাসের বিকল্প হিসেবে কয়লা ব্যবহারে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হয়। মিটিংও হয় কয়েকটি। এরপর সরকারি কাজের গতানুগতিক ধারায় এটিও ফাইলবন্দি হয়ে আছে।
চলতি বছর আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে সার আমদানির অনুমোদন পেয়েছে অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, দেশ ট্রেডিং, প্রোটন ট্রেডার্স, হাইড্রো কার্বন। এ ছাড়া সার পরিবহনে আছে বাল্কি ট্রেডার্স, নোয়াখান লিমিটেড এবং প্রোটন ট্রেডার্স। দেশে ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কামরুল আশরাফ খানের নিজের প্রতিষ্ঠান প্রোটন ট্রেডার্স। তিনি কালের কণ্ঠকে জানান, আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে বিসিআইসির সব শর্ত মেনেই কাজ পেয়েছেন তিনি।
এভাবে স্থানীয় উৎপাদন বন্ধ রেখে আমদানিকারকদের ওপর নির্ভরশীল মাঠপর্যায়ের সারের জোগান। শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া বলেন, সরকারের কাছে পর্যাপ্ত মজুদ না থাকলে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় বিষয়টি।
বিসিআইসির চেয়ারম্যান গোলাম রব্বানী কালের কণ্ঠের কাছে স্বীকার করে বলেন, এবারে যেসব প্রতিষ্ঠান আমদানির অনুমোদন পেয়েছে- তারাই কয়েক বছর থেকে সার আমদানি করছে। আমদানীকৃত সারের পরিমাণ বেশি হওয়ায় এককভাবে কোনো প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেওয়া হয় না। কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ পাবে, সে সিদ্ধান্ত নেয় কমিটি। বিসিআইসির চেয়ারম্যানের এককভাবে তা নেওয়ার সুযোগ নেই।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ বি এম খোরশেদ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, গুটি কয়েক প্রতিষ্ঠানের বাইরে আরো কিছু প্রতিষ্ঠানকে সার আমদানির সঙ্গে যুক্ত করতে মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিসিআইসির এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, গত পাঁচ বছরের আন্তর্জাতিক দরপত্রে কারা অংশ নিয়েছে- তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ঘুরে ফিরে একই প্রতিষ্ঠান আমদানির অনুমোদন পায়। বাইরের দুই একটি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিয়ে অনুমোদন পেলেও তারা নানা রকম বাধার মুখোমুখি হয়। সার আনা-নেওয়ায় পরিবহন সংকটে পড়তে হয়। আবার বিসিআইসি এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজশে ওই সব প্রতিষ্ঠানের পণ্য গ্রহণ না করে বছরের পর বছর বন্দরে ফেলে রাখা হয়। এতে তারা নিরুৎসাহিত হয়ে আমদানি ছেড়ে দেয়।
বিসিআইসি থেকে জানা যায়, কি পরিমাণ সার আমদানি প্রয়োজন তা নির্ধারণ করা হয় ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার কমিটিতে। এরপর আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের দায়িত্বে থাকে বিসিআইসির পাঁচ বা সাত সদস্যের কমিটি। এ কমিটির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়। মূলত সার আমদানি করা হয় চীন, ভিয়েতনাম থেকে। তবে কাতার, আবুধাবি, সৌদি আরব থেকেও সার আনা হয়।
গত কয়েক বছরে গড়ে প্রতি টন ইউরিয়া উৎপাদনে খরচ ১১-১২ হাজার টাকা। তা বিক্রি ১৮ হাজার টাকা, আমদানি মূল্য ৪০-৫০ হাজার টাকা। ডিএপি উৎপাদনে খরচ ৬০ হাজার টাকা, বিক্রি ২৬ হাজার টাকা, আমদানিতে ব্যয় ৬০-৬৫ টাকা এবং টিএসপি বিক্রি ২০ টাকা, উৎপাদনে খরচ ৪৫-৫০ টাকা এবং আমদানি হয় ৫৫-৬০ হাজার টাকায়।
বিসিআইসি সূত্রে জানা যায়, ছয়টি সার কারখানার বর্তমান যন্ত্রপাতিতেই উৎপাদন চালিয়ে যেতে দৈনিক ২১৪ এমএমসিএফ গ্যাস প্রয়োজন। এ পরিমাণ গ্যাসে যমুনা ফার্টিলাইজার কম্পানি লিমিটেড এক হাজার ৪০০ টন, ন্যাচারাল গ্যাস ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড ৭০ টন, আশুগঞ্জ সার কারখানা এক হাজার ২০০ টন, পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড ২৫০ টন, ঘোড়াশাল ফার্টিলাইজার লিমিটেড ৯০০ টন, চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এক হাজার ৬০০ টন উৎপাদনে সক্ষম। হিসাব কষে দেখা যায়, দৈনিক পাঁচ হাজার ৪০০ ২০ টন সার উৎপাদনে এক বছরে সরকারি কারখানাগুলো থেকে সার পাওয়া যাবে ১৯ লাখ ৭৮ হাজার ৩০০ টন। তবে বিআইডিএসের গবেষণা থেকে জানা যায়, যন্ত্রপাতি আধুনিকায়ন করা হলে সার কারখানাগুলো থেকে বছরে প্রায় ২৯ থেকে ৩১ লাখ টন সার উৎপাদন হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী কালের কণ্ঠকে বলেন, গ্যাস-বিদ্যুৎ নেই এমন অজুহাতে সার কারখানা বন্ধের সুযোগে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। নজরদারি করে বিরাজমান সমস্যার সমাধান হবে না। বরং যে কারণে এসব সমস্যার তৈরি তা দূর করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.