দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার জীবন-একঃ ওরা হাটে পণ্য বেচে, স্কুলে যায়, রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমায় by জেসমিন পাঁপড়ি ও মোয়াজ্জেম হোসেন

দহগ্রামের মানুষ এখন কাজ সেরে রাত-বিরেতে বাড়ি ফেরে, নিজেদের হাটে বেচে উৎপাদিত পণ্য। এখানে মেয়েরাও স্কুল-কলেজে যায়, বিয়ে বাড়িতে হয় আলোকসজ্জ্বা, চলে ধুমধাম।

দীর্ঘ সময় ধরে নিজভূমে পরবাস হয়ে থাকা এই মানুষগুলোর এখন স্বাধীনচেতা মনোভাব। তাদের আর কথায় কথায়ে হেনস্ত হতে হয়না, স্কুলগামী শিশুদের পথে আটকে কাজ করানো হয়না, মেয়েরা ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমায়। নেই যেকোনো মুহূর্তে সম্ভ্রম হারানোর কিংবা বিএসএফ সদস্যদের ভোগ্যপণ্য হওয়ার ভয়।
“গেট খুল্যার পর ম্যালা ভাল আছি বাহে। কামলা-কিষাণ করি খাবার পারি। আগে তো তাও পারতাম না,” বলছিলেন দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ইউনিয়নের ১নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা হাফিজার রহমান।

তিন বিঘা করিডোর ২৪ ঘন্টা খোলা রাখার একবছর পূর্তির পর সেখানের অবস্থা জানতে, পথে প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে হাফিজারদের কথা শুনছিলেন বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট জেসমিন পাঁপড়ি। সঙ্গে স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট সবিতা রহমান ও লালমনিরহাট জেলা প্রতিনিধি মোয়াজ্জেম হোসেন।

২০১১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর এই তিন বিঘা করিডোর ২৪ ঘন্টা বাংলাদেশীদের ব্যবহারের জন্য খুলে দেওয়ার চুক্তি কার্যকর করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন গিয়েছিলেন সেই কোরিডোর খুলে দেওয়ার উদ্বোধনে।

“সেই দিনটি ছিলো ভীষণ আনন্দের,” বলছিলেন হাফিজার।

কিন্তু তার আগের দিনগুলো ছিলো দুঃসহ স্মৃতির। তিনি বলেন, “সেদিনকার কতা আর মনে করবার চাইনে। কম কষ্ট করি আজ এই জায়গাত আসিনি।”

এ গ্রামেরই আরেক বাসিন্দা আমীর হোসেন বলেন, “আগে অনেক নিম্নমানের জীবন যাপন করতাম। এখন তো আমরা স্বাধীন। বাংলাদেশীর মত জীবন আমাদের।”

তাজা স্মৃতি থেকে তিনি বলেন, “১৯৯২ সালের আগে দহগ্রামে বাংলাদেশের কোন প্রসাশন ছিল না। দেশি কোন মুদ্রার ব্যবহারও ছিলনা। ভারতের রুপিতেই বেচা-কেনা ছিল আমাদের। হাট বাজারও করতাম ভারতের মেখনিগঞ্জ, কুচবিহার, ধাপড়া, জলপাইগুড়িসহ অন্যান্য বাজারে। সেখানে গেলেও আবার ভারতীয়দের নিরযাতনের শিকার হতে হত।”

“হাটেবাজারে গেলে ভারতীয়রা আমাদেরকে বলত... তোমরা আমাদের সঙ্গে যোগ দাও, আমরা দহগ্রামকে উন্নত করব। তোমাদেরও ভাল হবে,” বলেন আমীর হোসেন।

আঙ্গরপোতা জিরো পয়েন্টে বাস করে সাবিনা বেগমের পরিবার। তিনি বলেন, আগে রাত্রির অন্ধকারে বিএসএফ মেয়ে মানুষগো ওপর নির্যাতন করত। সঙ্গে যোগ দিতো স্থানীয়দেরও কেউ কেউ। ঘরে দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়েও মাফ পাওয়া যেত না। গেট হওয়ার পর তারা পলায় গ্যেছে। কেউ বাড়ি-জমি কম দামে বিক্রি করি গেছে, কেউ আবার সব থুয়ে পলায়ছে।

“এখন আমার স্বামী মাঝে মাঝে রাত একটার সময়ও বাড়ি ফেরে। তবু আল্লাহর রহমতে কোন সমস্যা হয় না। এখন খুব ভাল আছি, আপা।”

সাবিনার স্বামী আব্দুস সোবহান বলেন, “প্রথম যখন গেট (করিডোর) ২৪ ঘন্টা খুলল, তখন মনের আনন্দেই কয়েকবার করে দহগ্রাম থেকে গেট পার হয়ে পাটগ্রাম গেছি। আগে বিএসএফ দেখলে আমরা পলাতাম। এখন সেটা করতি হয় না। খুব ভাল লাগে।”

দহগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সানজিদা জেসমিন বেবী জানায়, আগে তারা অনেকে স্কুলে যেতে না পারলেও এখন সেটা পারে। অনেকে পাটগ্রামের কলেজেও পড়ালেখা করছে।

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হতেই চোখে পড়লো উজ্জল সব বাতিতে সাজানো একটি বিয়ে বাড়ি। রাতে ধুমধাম করে বিয়ের প্রসঙ্গ আসতেই আমীর আলী জানান, একসময় এখানকার গ্রামের ছেলেমেয়েদের মধ্যেই বিয়ে দিতে হত। তারপর যখন অল্প সময়ের জন্য তিনবিঘার গেট খুলে দেওয়া হল তখন দিনের বেলা বিয়ে হত। কারণ, দিনের আলো থাকতে থাকতেই বরকে তিনবিঘা করিডোর পার হয়ে চলে যেতে হত। আর এখন রাতেও বিয়ে হয়। বলতে গেলে করিডোর খোলার আগে তো ছেলে মেয়েকে বাংলাদেশে বিয়ে দেওয়াটাই মুশকিল ছিল। সেসব সমস্যাও এখন গ্যেছে।

দহগ্রাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান বলেন, দহগ্রাম এখন আর সিটমহল নয়। দেশের অন্যান্য ইউনিয়নের মতই এখানকার ছেলেমেয়েরাও এগিয়ে যাচ্ছে।

তিনবিঘা করিডোর খোলার আগের স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির পর দহগ্রাম, আঙ্গরপোতা পরিচিতি পায় ছিটমহল নামে। ১৯৯২ সাল পর‌যন্ত ভারতের অধীনস্থ হয়ে বসবাস করে এখানকার মানুষ। তখন দিনের পর দিন, রাতের পর রাত নিরযাতিত হতে হতো। ভারতীয় হাট বাজারে গেলে তারা অতর্কিতে আক্রমণ করত।

নিজের জীবনের উদাহরণ টেনে বলেন হাবিবুর রহমান বলেন,  বিএসএফদের একটি স্কুলে আমি অষ্টম শ্রেণী পরযন্ত পড়ালেখা করেছিলাম। সেখানকার স্কুলে ভারতীয় ছাত্ররা বেঞ্চে বসত আর আমাদের(ছিটমহলবাসীদের) জায়গা হত মাটিতে। স্কুলে যাওয়ার পথেও নানা ধরনের বাধা পেতাম। রাস্তায় অনেকে ডেকে খড়ি কুড়ানোর কাজ কর‍াতো। খড়ি কুড়ানো শেষ হলে তার পর স্কুলে যেতাম।

তিনি বলেন, দিনের পর দিন শিক্ষা, স্বাস্থ্য সবদিক থেকে আমরা বঞ্চিত থেকেছি। চাহিদামত বেচাকেনা করার ক্ষমতা আমাদের ছিলনা। কখনো সাত দিন কখনো ১৫দিন পর পর বাজারে যেতে হত। ভাল কোন পোশাকও আমরা পরতে পারিনি কখনো।

স্মৃতি হাতড়ে হাবিবুর আরো বলেন, ১৯৮৮ সালে প্রায় চার মাস অবরোধ থাকাকালে এখানে অনেক লোক না খেয়েও মারা যায়। তখন দাফন করার কাপড়ও কিনতে পারিনি। পুরাতন কাপড়, গাছের পাতা দিয়ে মানুষের দাফন করিয়েছি।

তিনি বলেন, পরপর কয়েকটি সরকারের আন্তরিক চেষ্টায় আমরা সেসব দিন কাটিয়ে এখন স্বাধীন জীবন যাপন করছি। সর্বশেষ বর্তমান সরকারের আন্তরিক চেষ্টায় তিনবিঘা করিডোর এখন ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে। এখানে এখন স্কুল, মাদ্রাসা, হাসপাতাল সবকিছুই আছে। আছে মানুষের ভোটাধিকারও। এখানকার অনেক মানুষ এখন রাজধানী ঢাকায় কর্মরত।

তিনবিঘা করিডোরে অবস্থানরত বিজিবি সদস্যরা বলেন, তিনবিঘা করিডোর খোলার ২৪ ঘন্টা খোলা থাকায় পাটগ্রামসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার সঙ্গে এ এলাকার মানুষের যোগাযোগ বেড়েছে। এতে করে তাদের জীবন যাত্রার মানেরও পরিবর্তন আসছে।

বর্তমানে দহগ্রামে ইউনিয়নে চারটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি ১০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালসহ উন্নত জীবনের নানা সুবিধা আছে।

এছাড়া এ এলাকার জীবন মানের উন্নয়ন ঘটাতে আরো বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার।

প্রসঙ্গত,  ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ছিটমহল দহগ্রাম-আংগরপোতা। ১৯৭৩ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির মধ্য দিয়ে দহগ্রাম-আংগরপোতা বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে আসে। এই চুক্তিতে এ ছিটমহলের সাথে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগের জন্য  একটি ‘প্যাসেজ ডোর’এর ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল, যা বর্তমানে‘তিন বিঘা করিডোর’নামে পরিচিত। পাটগ্রাম উপজেলার কুচলিবাড়ী ইউনিয়ন ও দহগ্রাম-আংগরপোতা ছিটমহলের মাঝখানে তিনবিঘা করিডোরের অবস্থান।

চুক্তিতে এই তিন বিঘা বাংলাদেশকে হস্তান্তরের  কথা থাকলেও  ভারতের হাই কোর্টের রায়ে  চুক্তির এই অংশ ভারতের সংবিধান বিরোধী বিবেচনা করে তা স্থগিত করে। পরবর্তিতে ১৯৯২ সালে ভারত বাংলাদেশের কাছে ইজারার মাধ্যমে এই  তিন বিঘা বাংলাদেশকে দেওয়া হয়। তবে এই চুক্তির বলে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ১ ঘন্টা পর পর করিডোর দিয়ে বাংলাদেশীদের যাতায়াতের সুযোগ দেয়া হয়। ২০১১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশীদের জন্য ২৪ ঘন্টার জন্য খুলে দেওয়া হয় এই তিন বিঘা করিডোর। যা দহগ্রাম-অঙ্গোরপোতার মানুষকে দিয়েছে স্বাধীনচেতা জীবন যাপনের সুযোগ।

No comments

Powered by Blogger.