নগর স্বাস্থ্যসেবা by এ এম এম শওকত আলী

নগর স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি কয়েক বছর ধরেই বহুল আলোচিত। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, নগরে স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রের সংখ্যা অপ্রতুল নয়। সরকারি, বেসরকারি এবং এনজিও পরিচালিত বহুসংখ্যক হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালু আছে।


সেবা গ্রহণে মূল সমস্যা নগরীর গরিব অধিবাসীদের, বিশেষ করে যারা বস্তিতে থাকে। তবে সরকারি হাসপাতালেই তারা সেবা গ্রহণের জন্য যায়, কারণ বিনা মূল্যে অথবা অল্প খরচে এসব কেন্দ্রে সেবা গ্রহণ করা সম্ভব। আর যায় এনজিও পরিচালিত স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে।
সম্প্রতি লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় বাংলাদেশের নগরায়ণের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যসেবা-সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। আশঙ্কা করা হয় যে নগরায়ণের ফলে স্বাস্থ্যসেবার জন্য কালো কূপের (black hole) সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে ১৫০ মিলিয়ন লোকসংখ্যার মধ্যে ৩০ শতাংশ নগরে বাস করে। এর মধ্যে বেশির ভাগই ঢাকায় বাস করে। সার্বিকভাবে নগরীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ। কারণ পল্লী অঞ্চলের বহুসংখ্যক গরিব জনমানুষ জীবিকা অর্জনের জন্য নগরে আসে। অথচ ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে জমির অপ্রতুলতার জন্য বাসস্থানের সমস্যা প্রকট। যেকোনো খোলা জমিতে, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানা যদি হয়, সেখানে বস্তি গড়ে ওঠে। আর ব্যক্তিমালিকানার জমিতেও এটা হয়ে থাকে, তবে সেখানে ত্বরিত উচ্ছেদ অভিযান হয়। সরকারি জমিতে যে হয় না, তা-ও সত্য নয়।
গার্ডিয়ান পত্রিকায় যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, তা আংশিক সত্য বলা যাবে না। তবে কিছু অপূর্ণতা রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার সার্বিক চিত্র এ তথ্যে পাওয়া যায় না। বলা হয়েছে সরকারি বাজেটের অপ্রতুলতার কথা। এ কারণে মনে হয়, সরকার বাস্তবতাকে অস্বীকার করছে। সরকারি স্বাস্থ্যনীতির মূল সমস্যা ঐতিহাসিক। পাকিস্তান আমল থেকেই গৃহীত স্বাস্থ্যনীতি ও কৌশলে পল্লী অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র নির্মাণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে এ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন যে হয়নি সে বিষয়টিও সত্য নয়। ১৯৯৮ সালে স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে সরকারি ও বিদেশি সাহায্যপুষ্ট নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় ২০১১ সালের ডিসেম্বরে শেষ হয়। এর আওতায় সব কয়টি সিটি করপোরেশনসহ পাঁচটি পৌরসভায় এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। এর ফলে প্রকল্পের লক্ষ্য অনুযায়ী ৩০ শতাংশ শহরে বসবাসকারী গরিব জনমানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা গ্রহণে সক্ষম হয়েছে। সেবা দেওয়া হয়েছে বিনা মূল্যে। তাদের লাল কার্ড (Red card) দেওয়া হয়। এ প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায় বর্তমানে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ১১টি সিটি করপোরেশন ও পাঁচটি পৌরসভায় এ কার্যক্রম আগামী পাঁচ বছর চালু থাকবে।
গার্ডিয়ান পত্রিকায় ব্র্যাকের কার্যক্রমের কথাই বলা হয়েছে। বিশেষ করে ব্র্যাকের মাতৃসেবার তথ্য নিঃসন্দেহে সত্য। কিন্তু এর পাশাপাশি স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগ ছাড়াও রয়েছে সূর্যের হাসি- যা ইউএসএইড সাহায্যপুষ্ট। আর রয়েছে মেরি স্টোপস ক্লিনিক। ব্র্যাকসহ এরা সবাই শহর ও পল্লী অঞ্চলে কাজ করছে। কাজের মধ্যে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা অন্যতম। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ডিএফআইডি ও ইউএসএইড সম্মিলিতভাবে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করছে বলে জানা গেছে। এ উদ্যোগে প্রাথমিক মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা প্রাধান্য পাবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের কৌশল হিসেবে ব্র্যাকসহ সূর্যের হাসি ও মেরি স্টোপসকে দায়িত্ব দেওয়ার চিন্তাভাবনা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। সমস্যা হবে সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে।
এর জন্য প্রয়োজন হবে একাধিক প্রকল্প বা কর্মসূচির অভিন্ন কৌশল ও দ্বৈততার অবসান। ব্র্যাক, সূর্যের হাসি ও মেরি স্টোপসের বাস্তবায়ন কৌশলের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। সূর্যের হাসি প্রথমে গরিবদের বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দিতে বিশ্বাসী ছিল না। তবে অভিজ্ঞতার আলোকে এ কর্মসূচির বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা বাস্তবতা স্বীকার করতে বাধ্য হন এবং গরিব জনমানুষের ৪০ শতাংশকে বিনা মূল্যে সেবা দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ব্র্যাকের চিকিৎসা বিনা মূল্যে দেওয়া হয়, তবে গরিবদের জন্য। মেরি স্টোপসের কার্যক্রমের কিছু অংশ স্থানীয় সরকার বিভাগের নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অন্তর্ভুক্ত ছিল। গরিবদের চিহ্নিত করে লাল কার্ড-প্রথায় এ সংস্থা বিনা মূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। ব্র্যাক মাতৃ ও শিশুসেবার ক্ষেত্রে চাহিদা সৃষ্টির (demand generation) কৌশলে বিশ্বাসী। ব্র্যাক ছাড়া অন্য দুটি সংস্থা এনজিওগুলোর মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবায় বিশ্বাসী। কৌশল হিসেবে ব্র্যাক কমিউনিটিকেই ব্যবহার করে থাকে। তবে এ ভিন্নতার বিষয়ে এ তিন সংস্থা মনে হয় ঐকমত্য অর্জনে সক্ষম হবে।
যেকোনো কর্মসূচিতে একাধিক অংশগ্রহণকারী সংস্থার কৌশল ও দর্শনে ভিন্নতার বিষয়টি অস্বাভাবিক কিছু নয়। লক্ষ্য ঠিক করে তা অর্জনে সচেষ্ট হওয়াই হবে আসল উদ্দেশ্য। সমন্বয়ের সমস্যা ছাড়াও দ্বৈততা পরিহার করার বিষয়ও বিবেচনার দাবি রাখে। জানা গেছে, এর জন্য নতুন উদ্যোগের ক্ষেত্র হবে ওইসব নগর অঞ্চল, যেখানে স্থানীয় সরকার বিভাগ পরিচালিত প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এর ফলে দ্বৈততা পরিহার ছাড়াও বঞ্চিত নগর অঞ্চলের দরিদ্ররা বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে সক্ষম হবে। অধিক হারে শহরের গরিব অধিবাসীরা বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবার আওতাভুক্ত হবে।
স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হলো, সরকারসহ অন্য সবার নগরের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। তবে এর জন্য সরকারের পক্ষে প্রয়োজনীয় অর্থ জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এটাই আশঙ্কার বিষয়। কারণ এর সঙ্গে ভবিষ্যতেও যাতে এ ধরনের কর্মসূচি অব্যাহত থাকে সে বিষয়টি জড়িত। নগরভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালীকরণের বিষয়টি ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় স্বীকৃত। সরকার এ বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণে সক্ষম হয়েছে। যেমন- পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জাতীয় নগর স্বাস্থ্য কৌশল প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়। স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে এ কৌশল প্রণয়ন করা হয়েছে, বর্তমানে যে বিষয়টি সরকারের বাইরে বহুল আলোচিত তা হলো, স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের সমন্বয়ের অভাব। বলা হচ্ছে, এর জন্য মন্ত্রী ও সচিব পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হলেও তা সঠিকভাবে কাজ করছে না। এ ধারণা যদি সত্য হয়, তাহলে অনুসন্ধান করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অতি জরুরি।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় একটি নগর স্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটি গঠন করেছে, যার মধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তাও সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত। মূল সমস্যা প্রশাসনিক কালচার। এ কালচারে কমিটির মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। এটাই হলো বাস্তবতা। এর সঙ্গে অন্য একটি বিষয়ও যুক্ত। তা হলো, মন্ত্রণালয়ের কাজের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। মন্ত্রণালয়গুলো ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণে বিশ্বাসী নয়। যে কাজটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় করতে সক্ষম নয়, সে কাজ অন্য মন্ত্রণালয় করতে চাইলে তারা বাধাগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের মূল কাজ পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন। এ কাজ সঠিকভাবে না করে তারা একের পর এক কর্মসূচি বাস্তবায়নে লিপ্ত হয়। এমনকি সচিবালয় নির্দেশনামায় একজন যুগ্ম সচিব বা অতিরিক্ত সচিব যে নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্ষমতাবান, সে বিষয়টি স্বীকৃত। বাস্তবতা হলো, সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়ায় এ অনুশাসন পালিত হয় না। সব কিছুই সচিব ও মন্ত্রী পর্যায়ে যায়। তা না হলে কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা যায় না। ফলে প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্থবিরতা এড়ানো যায় না। স্থবিরতার বিষয়টি মিডিয়ায় বহুল আলোচিত। মন্ত্রী বা সচিব পর্যায়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলেও আবার নথি ধীরগতিতে সহকারী সচিব পর্যায়ে পৌঁছে। এরপর খসড়ার কার্যক্রম শুরু হয় সিদ্ধান্তের বিষয়ে আদেশ দেওয়ার জন্য। এ ধরনের কালচার দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার প্রধান অন্তরায়। সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগেই সেবার অভাবে রোগী মারাও যেতে পারে। এ বিষয়টি অবশ্য সরকারি স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সরকারি এনজিও পরিচালিত স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে এ ধরনের স্থবিরতা না থাকারই কথা।
বিদ্যমান প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে সরকার অথবা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান এনজিওদের সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে যে মডেল অনুসরণ করছে, সে ক্ষেত্রেও কিছু অস্পষ্টতা বিদ্যমান। এ সেবার স্থায়িত্বের (sustainability) বিষয়টি সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ পরিচালিত প্রকল্পে স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার জন্য একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, এ তহবিল সৃষ্টির জন্য সরকার থেকে কোনো অর্থের জোগান দেওয়া হবে না। অন্যদিকে স্থানীয় রাজস্ব আহরণে দুর্বলতার কারণে এ তহবিলের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.