একুশ শতক- ইন্টারনেট ও সাংস্কৃতিক রূপান্তর by মোস্তাফা জব্বার

॥ তিন ॥ মোবাইল ও অপসংস্কৃতি : যে বিষয়টি আমাদের ভাবিত করছে সেটি হলো আমাদের ইন্টারনেট ও মোবাইল ব্যবহারকারীরা কি এই প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করছেন, নাকি এর সাইড এফেক্ট বা কুপ্রভাব অনেক বেশি। আমরা কি ডিজিটাল যুগের সাংস্কৃতিক সঙ্কটেই রয়ে গেছি?


মোবাইলের যাত্রাটি যথেষ্ট আগে ও ব্যাপকভাবে হবার ফলে আমরা মোবাইল ব্যবহারের সাইডএফেক্ট সম্পর্কে খবর পাই আগে। মোবাইলে মিস কল প্রদান, বিরক্তিকর কল প্রদান, মেয়েদের বিরক্ত করা, মোবাইলে পর্নো ছবি তোলা ও প্রকাশ করা ইত্যাদি ঘটনা ঘটছে।
নানা ধরনের উৎপাতের খবর প্রকাশের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত দিক থেকে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীকে শনাক্ত করার উপায় জেনে যাবার পর তূলনামূলকভাবে এখন মোবাইলের বাজে ব্যবহার কিছুটা কমেছে। আইনের দিকে সতর্কতা ও আইন প্রয়োগকারীদের কর্মতৎপরতা এক্ষেত্রে যথেষ্ট কার্যকর হয়েছে। এছাড়াও মোবাইলের কল ব্লক করার সুবিধা ও সেল থেকে কলারকে শনাক্ত করার সুবিধা পাবার ফলে কেউ মোবাইলে কোন অপকর্ম করে পার পেতে পারে না। কলের রেকর্ড রাখার পাশাপাশি কল লিস্ট সংগ্রহ করার সুবিধাও এক্ষেত্রে অপরাধী শনাক্ত করতে সহায়ক হয়েছে। মোবাইল বিক্রির সময় যদি নিবন্ধনের বিষয়টি আরেকটু সতর্ক করা যেত তবে কাজটি আরও সহজ হতো। আইনের প্রয়োগ আরেকটু বাড়লে মোবাইল নিয়ে দুশ্চিন্তা কমে যেতে পারে।
ইন্টারনেট ও অপসংস্কৃতি : অন্যদিকে ইন্টারনেটের খারাপ প্রয়োগ দিনে দিনে বাড়ছে। আমি এখনকার অবস্থাটিকে ভয়ানক ও প্রলয়ঙ্করী বলে মনে করি। এটি দিনে দিনে মহামারীতে পরিণত হচ্ছে। সরকারের উচ্চ মহল হোক আর আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হোক সকলের জন্য ইন্টারনেট একটি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ইন্টারনেটের ব্যবহার করে প্রতারণা করা, অশ্লীলতা ছড়ানো, মানহানি করা, মিথ্যা ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর পাশাপাশি হ্যাকিংয়ের মতো ক্ষতিকর কাজও উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। একটি সমাজে প্রযুক্তি প্রবেশের সময় নানা ধরনের উৎপাত যেমনি করে মানুষকে শঙ্কিত করে এখনকার ইন্টারনেট সম্প্রসারণের বিষয়টা তেমন একটি অবস্থার সৃষ্টি করছে।
ইন্টারনেট মাধ্যমটি সারা দুনিয়াতেই মুক্তমাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। পারতপক্ষে কোন দেশ একে শৃঙ্খলিত করতে চায় না। পশ্চিমা দুনিয়ায় বা তথাকথিত মুক্ত বিশ্বে ইন্টারনেটকে মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর ফলে বিশ্বজুড়ে নাগরিকদের স্বাধীনতা বেড়েছে ব্যাপকভাবে। আমরা লক্ষ্য করব, কোন একটি খবর প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সেই খবরটির ওপর মন্তব্য করার সুযোগকে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা কাজে লাগান। সাধারণ নাগরিকরা সংবাদ তৈরিও করেন। কোন একটি ওয়েবসাইটে কোন তথ্য বা মন্তব্য থাকলে সেটির বিষয়েও মন্তব্য প্রদান করা যায়। এর ফলে যে কোন বিষয়ের ওপর সাধারণ মানুষ কিভাবে এবং তাদের কি প্রতিক্রিয়া সেটি খুব সহজেই গোচরীভূত হয়। ব্লগ লেখার স্বাধীনতা সেই সুযোগকে আরও সম্প্রসারিত করেছে। এক সময় আমরা কেবল পত্র-পত্রিকাতেই মতামত পেতাম। এখন ব্লগে যে কেউ তার নিজের মত প্রকাশ করতে পারছে। বলা যেতে পারে, মানবজাতি এর আগে আর কখনও এত স্বাধীন ছিল না। বাংলাদেশের মতো অনুন্নত ও রাজনৈতিকভাবে অস্থির ও অসহনশীল দেশেও এই অবস্থাটি অব্যাহত আছে। মাঝখানে দু’বার এই সরকার ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েছিল। তবে এরপর সম্ভবত সরকারের নীতি নির্ধারকরা এটি অনুভব করেছেন যে, কোন কিছু বন্ধ করে দিয়ে তার সমাধান করা যাবে না। বরং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ব্যাহত না করলে যেমন করে খারাপ মতটি প্রকাশিত হবে তেমনি খারাপের বিপরীতে ভালো মতটিও প্রকাশিত হবে। এক সময়ে সত্যই জয়ী হবে; এটিই স্বাভাবিক।
কিন্তু এত চমৎকার একটি সুযোগ ও প্রকৃত সম্ভাবনাময় একটি ব্যবস্থাকে যখন কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে অপব্যবহার করে তখন তাকে নিয়ন্ত্রণ বা সীমিত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। মাত্র কিছুদিন আগে ভারতের উচ্চ আদালত সেই দেশে অনেক ওয়েবসাইট এবং ফেসবুকের পেজ নিষিদ্ধ করার নির্দেশ প্রদান করেছে। সেইসব সাইটের মতপ্রকাশের বিষয়টির চাইতেও জরুরী ছিল পর্নোগ্রাফি। ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফি যে কতটা ভয়ঙ্কর সেটি সবচেয়ে বেশি অনুভব করেন অভিভাবকরা। ছেলেমেয়েদের ইন্টারনেটে প্রবেশ করতে দিতেও মানা করতে পারেন না, আবার ইন্টারনেটে থাকা বাজে উপাত্ত সন্তানের মানসিকতাকে কতটা বিপজ্জনকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে সেটি নিয়েও নিশ্চিত হতে পারেন না। এই সঙ্কটে পাকিস্তানও পড়েছে। বস্তুত বিশ্বের প্রায় সকল দেশই এই সঙ্কটের বাইরে নয়। বিগত দুই যুগ ধরে যখনই ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের ইন্টারনেট ব্যবহারে তাদের সন্তানদের উৎসাহিত করা ও সুযোগ দেবার কথা বলেছি তখনই এই আশঙ্কার কথা প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থা সত্যি সত্যি ভয়ঙ্কর। এখানে কেবল যে ইন্টারনেট পর্নোগ্রাফির জন্য ব্যবহার করা হয় তা নয়, মোবাইল ফোন এই দেশের পর্নোগ্রাফির একটি বড় হাতিয়ার। শুধু আমাদের কথাই কেন বলি। ভারতের দুই মন্ত্রী সেদিন পদত্যাগ করেছেন সংসদে বসে পর্নো ছবি দেখার জন্য। আমাদের দেশে মেয়েদের ছবি মোবাইলে তুলে সেটি মোবাইলেই প্রচার করার একটি বাজে প্রবণতা গড়ে উঠেছে। এর বাইরে আছে ইন্টারনেটে মোবাইলে তোলা ছবির প্রচার। নামী-দামী লোকজন ছাড়াও সাধারণ ছেলেমেয়েদের নগ্ন ছবি ইন্টারনেটে অহরহ ছাড়া হয়। কখনও ব্ল্যাকমেইল করার জন্যই এসব মাধ্যমকে ব্যবহার করা হয়। আমরা পত্র-পত্রিকায় এমন অসংখ্য খবর পড়েছি। উন্নত দেশগুলোতে পর্নোগ্রাফি তেমন কোন বড় ঘটনা না হলেও বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান বা এমন উন্নয়নমুখী দেশগুলোর জন্য পর্নোগ্রাফির অত্যাচার প্রকটভাবে সামাজিক সঙ্কট তৈরি করছে। পশ্চিমা দেশের সমাজটি খোলামেলা বলে তারা ইন্টারনেটে কি আছে তাতে তেমন মাথা ঘামায় না। কিন্তু আমরা কোনভাবেই এসব বিষয়ে নীরব থাকতে পারি না।
সাম্প্রতিককালে ফেসবুক ও ইন্টারনেট নিয়ে আমাদের দেশে কয়েকটি ছোট অথচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। একটি ঘটনা হলো; আমাদের একজন খ্যাতিমান নায়ক (জাহিদ হাসান) একটি অজ্ঞাত পরিচয় মেয়ের কাছ থেকে ফোন পেয়ে জানলেন যে, তার ফেসবুক আইডি থেকে তাকে টাকা দেবার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। তিনি নিজে পরীক্ষা করে দেখলেন যে ঐ ফেসবুক আইডিটা তার নিজের নয়, সেটি একটি ফেক আইডি। এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে। মেইলে স্প্যাম হিসেবে আমরা টাকা পাঠানোর এমন অনুরোধ প্রতিদিন পাই। কোন পরিচিত জন বিদেশে গিয়ে তার টাকা হারিয়ে ফেলেছে এবং হোটেলের বিল দিতে পারছে না এমনসব তথ্যসহ মেইল আসে। লটারিতে জেতার বিষয়ে এখন বোধহয় সবাই সতর্ক হয়ে গেছেন।
জাহিদ হাসানের মতো মানুষদের ফেক আইডির সংখ্যা লাখে লাখে। সেলিব্রিটিরাই এর শিকার বেশি হলেও সাধারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরাও এ থেকে নিস্তার পান না। বিশেষ করে মেয়েদের ছবি ব্যবহার করে ফেসবুকে ভুয়া এ্যাকাউন্ট খোলা একটি অতি সাধারণ ঘটনা।
কারও নাম ভাঙিয়ে প্রতারণা করাও নতুন নয়। আমি নিজেই দেখলাম, গত মার্চ মাসে নিউ শেরাটন বিডি নামের একটি ওয়েবসাইট থেকে ইন্টারনেটে আয় করার কার্যক্রম চালাতে গিয়ে জানানো হয়েছে যে, আমি নাকি তাদের উপদেষ্টা। ওদেরকে ফোন করলাম নিজে এবং তারা বলল যে, আমি তাদের উপদেষ্টা। তাদের কাস্টমাররা ফোন করলেও তারা বলে যে আমি উপদেষ্টা। আমি তাদের কাছে জানতে চাইলাম, কে তোমাদের অনুমতি দিয়েছে। ওরা জানাল, সেটি তাদের বস জানে। বসকে খুঁজলাম, পাওয়া গেল না। এরপর এসএমএস, ফোন করে তাদের কাছে প্রতিবাদ পাঠানোর পর পান্থপথে তাদের অফিসের ঠিকানায় গত ২২ মার্চ চিঠি পাঠাতে গিয়ে আমাদের লোকজন দেখল যে, অফিসের সামনে শত শত ছেলে জড়ো হয়েছে এবং ওদের কেউ অফিসে নেই। সবাই তখন বুঝল যে, সেটি একটি ইন্টারনেটের হায় হায় কোম্পানি। আমাদের নতুন প্রজন্মের ইন্টারনেট ববহারকারীদের ঠকিয়ে টু পাইস কামানোর জন্য এইসব ফন্দি ফিকির করা হয়ে থাকে।
গত মার্চেই আমাদের সর্বোচ্চ আদালত থেকে ৫টি ফেসবুক পেজ ও ১টি ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেবার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। এই পেজ ও সাইটটি থেকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া হচ্ছিল। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে খবর প্রকাশিত হচ্ছে। ফেসবুকের এসব অপরাধের কোন সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব হবে না। আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে এসব অপরাধ করাই হচ্ছে।
অন্যদিকে ফেসবুকে বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ সম্পর্কে কুৎসিত ও বাজে মন্তব্য করা, বাজে ছবি প্রকাশ করা এবং ইউটিউবে বাজে ভিডিও উপস্থাপন করা একটি আতঙ্কের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কোন একটি ইস্যুতে কেউ কোথাও যদি একটি মন্তব্য করে এবং সেটি যদি কারও পছন্দ না হয় তবে সেই মন্তব্যের খ-িত অংশ ইন্টারনেটে উপস্থাপন করে তাকে অপমানিত ও অসম্মানিত করা একটি দৈনন্দিন বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ভুল তথ্য দিয়ে, ফটোশপে বানানো ছবি দিয়ে ভিডিও তৈরি করে প্রকাশ করা বা বাজে ছবির মাথাটা বদল করে একজন সম্মানিত মানুষের ছবিকে সংযোজন করাটাও একটি রীতিমতো আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিনেতা, অভিনেত্রী, রাজনীতিক, কবি, লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষ কেউ এই আক্রমণ থেকে নিস্তার পাচ্ছেন না। বিশেষ করে বহুল আলোচিত, পরিচিত বা জাতীয় পর্যায়ের সুশীল সমাজের মানুষ ও রাজনীতিকদের বিষয়ে এসব আক্রমণ ব্যাপক হারে বাড়ছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বাড়ার চরম ক্ষতিকর সাইড এফেক্ট এগুলো। এসব ক্ষেত্রে ব্লগ বা ফেসবুক কিংবা ইউটিউব কর্তৃপক্ষ যতœবান থাকেন না। ব্লগের নিচে এই মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয় এমন একটি বাক্য জুড়ে দিয়েই তারা দায়িত্ব সেরে ফেলেন। অথচ প্রচলিত আইনেই কোনভাবেই ওয়েবসাইটের প্রকাশক এবং নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করার দায় থেকে মুক্ত থাকতে পারেন না। যে কেউ তার নিজের মন্তব্যের জন্য দায়ী হলেও সেই মন্তব্য জনসমক্ষে প্রকাশ করার দায় ওয়েবসাইটের প্রকাশক, ফেসবুক বা ব্লগিং সাইটের কর্তৃপক্ষের। (চলবে)
ঢাকা, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১২ ॥ লেখক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ-এর প্রণেতা ॥
ই-মেইল : mustafajabbar@gmail.com, ওয়েবপেজ: www.bijoyekushe.net

No comments

Powered by Blogger.