কলকাতার চিঠি by ঊর্মি রহমান

মালদা জেলার সিরাজুল ইসলাম তার স্ত্রী জহিরুন বিবিকে পুড়িয়ে মারল দুই কন্যা তামান্না ও শাহমিদার সামনেই। জহিরুনের অপরাধ, সে পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে পারেনি। এই কাজে সিরাজুলকে সাহায্য করেছে তার মা ও বোন। তারা জহিরুনের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেয়।


পুলিশের কাছে এই বয়ান দিয়েছে সিরাজুল আর জহিরুনের মেয়ে তামান্না। দুই মেয়ে চেয়ে চেয়ে দেখেছে। জ্বলন্ত শরীরে জহিরুন বাড়ির বাইরে বেরিয়ে সাহায্যের জন্য আর্তনাদ করে। প্রতিবেশীরা ছুটে আসে এবং তারাই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু জহিরুন বাঁচেনি। পুলিশ সিরাজুল ইসলামকে খুঁজছে। চব্বিশ পরগনায় কন্যাসন্তানের জন্ম দেবার কারণে নেহা জয়সওয়ালের ওপর অত্যাচার করে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন। তার মেয়ে শ্রদ্ধার ওপরও অত্যাচার করা হয়। পুলিশ অবশ্য নেহার স্বামী দীপক ও দেবর দীনেশকে গ্রেফতার করেছে। কিছুদিন আগে দক্ষিণ ভারতের এক বাবা মেয়েকে না খাইয়ে আর কলকাতার এক বাবা ছুড়ে ফেলে মেরে ফেলেছে। এসব হতভাগিনীদের মায়েরা বিচার চেয়েছে।
আপনাদের অনেকেই অভিনেতা আমির খানের টিভি অনুষ্ঠান সত্যমেব জয়তে দেখেছেন। একজন অভিনেতা হয়ে তিনি যেসব সমাজসচেতনমূলক অনুষ্ঠান করেছেন সেটা প্রশংসাযোগ্য। তিনি যেমন সমাজের অবিচার-অনাচার-অনিয়মের ছবি তুলে ধরেছেন তেমনি এসব সমস্যা-কুপ্রথার শিকার ও সেই সঙ্গে এসবের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া মানুষদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন অগণিত দর্শককে। এই অনুষ্ঠানে বেশ ক’টি চ্যানেলে দেখানো হয়েছে, বিশেষ করে দূরদর্শনে দেখার ফলে অনেক বেশি মানুষ এটা দেখতে পেয়েছেন। যাঁরা দেখেছেন তাঁদের হয়ত প্রথম অনুষ্ঠানটার কথা মনে আছে, যেটা ছিল কন্যা ভ্রƒণ ও কন্যাশিশু হত্যা নিয়ে। সেখানে আমরা কন্যার জন্ম দেয়ার অপরাধে অত্যাচারিত-ক্ষতবিক্ষত নারীদের দেখে শিউরে উঠেছিলাম। আজ এই যুগে, এত প্রযুক্তিগত অগ্রগতির পরও মানুষ যে অন্ধকারে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে দেখে হতাশায় মনটা বিষিয়ে ওঠে। মনে পড়ল বিলেতের হাসপাতালগুলো আজকাল ভ্রƒণের লিঙ্গ নির্ধারণ করার ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়েছে, যাতে কেউ ভ্রƒণ হত্যা করার কথা ভাবতে না পারে।
এদিকে এটা নিয়ে নানা রকম শোরগোলের ফলে কেউ কেউ নড়েচড়ে বসছে। হরিয়ানার জিন্দ জেলায় খাপ পঞ্চায়েত কন্যাভ্রূণ হত্যার বিরুদ্ধে সরব হয়ে নিজেদের ভাবমূর্তি বাঁচাবার চেষ্টা করছে। তারা বলেছে, কন্যাভ্রƒণ হত্যা খুনই। কন্যাভ্রƒণ হত্যার কারণেই দেশে নারীর হার কমছে। অবিলম্বে এই সামাজিক ব্যাধি দূর করা দরকার। সেখানে এক মহাপঞ্চায়েতের আয়োজন করা হয় আর এই প্রথম তাতে ২০০’র মতো নারী অংশ নেয়। সেই সঙ্গে ঐ এলাকার ১০০ খাপনেতা এই সভায় অংশ নেন। সেখানেই কন্যাভ্রƒণ হত্যাকে সামাজিক ব্যাধি বলে তার প্রতিকারের কথা বলা হয়েছে। ৯৮ বছর বয়স্ক এক নারী এই সভায় অংশ নিতে পেরে এত আনন্দিত হন যে তিনি বলেন এটা কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নেবার চেয়েও আনন্দজনক। খাপ পঞ্চায়েত কন্যাভ্রƒণ হত্যার বিরুদ্ধে ইতিবাচক রায় দিলেও নারীদের পৈতৃক সম্পত্তিতে অধিকার সম্পর্কে তাদের রক্ষণশীল মনোভাবে অনড় থাকে। কোন কোন নারী তাদের কথা শোনার জন্য যথেষ্ট সময় দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করে বলে তোমরা সমান অধিকারের কথা বল, অথচ আমাদের কথা শোনার সময় তোমাদের নেই।
রাজস্থান সরকার কন্যাভ্রƒণ রক্ষার উদ্দেশ্যে একটি নতুন আইন চালু করার চেষ্টা করছে। এটা দেশের প্রথম এ ধরনের আইন হবে। ২০১১ সালের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে সেখানে প্রতি ১০০ পুরুষশিশুর জন্য রয়েছে ৮৬৩ কন্যাশিশু। মুখ্য রাজ্য নারী ও শিশু উন্নয়ন সচিব সারিতা সিংহ একথা জানান। এই নীতি বা আইন একই সঙ্গে শিশুর অধিকারের বিষয়টাও তুলে ধরবে। এটা রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলটের অনুরোধে করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক রাখার কারণেই এই বৈষম্য ও অন্যায় হচ্ছে বলে তিনি জানান। একই রাজ্যের জয়সলমির জেলায় জানা গেছে, কন্যা শিশুদের না খাইয়ে অথবা অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে হত্যা করা হচ্ছে। তিন শিশুর মৃতদেহ তাদের বাড়ির পেছনে সমাধিস্থ অবস্থায় পাওয়া গেছে। পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও করেছে। এসব শিশুর পরিবারের বিরুদ্ধে ভারতীয় পিনাল কোডের ৩১৫ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। রাজস্থানের ছবিটি পরস্পর বিরোধিতায় ভরা। এই রাজ্যেরই উদয়পুরের একটি আশ্রম কন্যাসন্তানদের রক্ষার কাজে ব্রতী হয়েছে। লিঙ্গ নির্ধারণ করে অনেক জায়গাতেই ভ্রƒণ হত্যা করা হয়। অনেক ডাক্তারই সেসব করেন। কিছুদিন আগে গোপন ক্যামেরায় এ ধরনের একটি ঘটনা ধারণ করে ফাঁস করার পর কয়েকজন গ্রেফতারও হন। আগস্ট মাসে রাজস্থানের এক লেকে কন্যাভ্রƒণ ভাসতে দেখা গেছে। সেখানে ০-৬ মাস বয়সী পুরুষ শিশুর সংখ্যা ১০০০ আর কন্যাশিশুর সংখ্যা ৮৮৩। রাজস্থানের এক বিপণন পেশাজীবী দেবেন্দ্র আগরওয়ালকে এই ঘটনা এত বিচলিত করেছে যে তিনি তাঁর বাড়ির বাইরে একটি দোলনা রেখে দেন। এক সপ্তাহের মধ্যে তাঁর স্নেহছায়ায় আসে তিনটি কন্যাশিশু। তাঁর কোন কন্যা ছিল না। তাঁর একমাত্র পুত্র একই সঙ্গে তিনটি বোন পেয়ে যায়। তাঁর এই মানবিক আচরণ উদয়পুর শিশু কল্যাণ পরিষদ বোঝেনি। তাঁরা শিশু তিনজনকে তাঁর কাছ থেকে নিয়ে দত্তক দিতে চায়। দেবেন্দ্র আইনী লড়াই লড়েও শেষ পর্যন্ত হেরে যান। কিন্তু তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, এভাবে নয়, তাঁকে কিছু একটা করতে হবে। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মা ভগবতী বিকাশ সন্তান নামের সংগঠন। তাঁর ছত্রছায়ায় মহেশ আশ্রম গড়ে তোলেন তিনি যেখানে এখন অনেক মেয়ে আছে। পেশাদার তত্ত্বাবধান ও আদরযতেœ তারা বেড়ে উঠছে। তাদের কাউকে কাউকে দত্তক দেয়া হয়েছে। তবে সে কাজটা সহজ নয়। কারণ দত্তক নেবার সময়ও অনেক পরিবার পুরুষশিশুই চায়। মহেশ আশ্রম তাদের দোরগোড়ায় একটি আর এক হাসপাতালে একটি দোলনা রেখে এসেছে আর আবেদন জানিয়েছে তোমরা এই শিশুদের ফেলে দিও না, আমাদের কাছে দিয়ে যাও। তোমাদের কাছে যারা অবাঞ্ছিত, আমরা তাদের বুকে তুলে নেব। বলা বাহুল্য মায়েরা এসব শিশুকে ফেলে দিতে চায় না, কিন্তু সামাজিক চাপে বাধ্য হয়। একবার একটি শিশুকে যখন মহেশ আশ্রম পায় তখন শিশুটি গুরুতরভাবে আহত। কারণ তাকে গাড়ির জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছিল। দেবেন্দ্র আগরওয়ালের মতো আরও অনেক মানুষকে যদি পাওয়া যেত তাহলে কন্যাসন্তানদের অকালে মৃত্যুবরণ করতে হতো না, অত্যাচারিত হতে হতো না।
একই সঙ্গে অন্যরকম ছবিও দেখা যায়, যা দেখে মনে হবে এটা বোধহয় আফগানিস্তান! উত্তরপ্রদেশের বাগপত জেলার আসারা গ্রামের খাপ পঞ্চায়েত ফতোয়া দিয়েছে যে, মেয়েরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবে না। পুুরুষ সঙ্গী ছাড়া বাইরে যেতে পারবে না। মুখ ঢেকে রাস্তায় চলতে হবে। নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করতে পারবে না। সবচেয়ে দুঃখের কথা এই ফতোয়াকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করেছে তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব। তিনি বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত ভালর জন্যই নেয়া হয়েছে। আর ঐ এলাকার সাংসদ ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজিত সিংহের পুত্র বলেছেন, এটা ফতোয়া নয়, গুরুজনদের পরামর্শ। তবে রাজনৈতিক নেতা শারদ যাদব বলেছেন, দেশে যেখানে আইন আছে সেখানে কি করে একটা খাপ পঞ্চায়েত এমন ফতোয়া জারি করে। আসল কথা নারীকে তার অবস্থান ও অধিকারের লড়াই নিয়ে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.