স্মরণ-প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার by জাহাঙ্গীর হোসেন অরুণ

কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে! হৃদয়ের এই খোঁড়াখুঁড়িকে হয়তো ভালোবাসা বলা চলে। আর হৃদয় খুঁড়ে যখন সমুদ্র হয়ে যায়, তখন তার নাম হয় দেশপ্রেম। জাতির ক্রান্তিলগ্নে সুস্থির, প্রশান্ত এই মহাসাগর জেগে ওঠে। টর্নেডোর মতো চুরমার করে দেয় মায়ের চেয়ে প্রিয় মাতৃভূমির সব শত্রুকে। নারী মায়ের জাত।


মায়ের মমতা তাই তার জন্মগত। যাঁর কথা বলছি, তাঁর মধ্যে এই মমতাটা মনে হয় একটু বেশিই ছিল। একবার পাঁঠা কাটার কথা বলায় তিনি বলেছিলেন, 'নিরীহ জীব হত্যা করতে সত্যিই মায়া হয়, আমি পারব না।' নিরীহ জীব যিনি হত্যা করতে পারেননি, তিনিই আবার নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের কমান্ডার হয়েছিলেন। আর এই অভিযান ছিল প্রশান্ত সাগরের টর্নেডোর চেয়েও ভয়ংকর। এই অভিযান ছিল স্বদেশি আন্দোলনের একটি অভিযান। বলছি এই বঙ্গে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বিদ্রোহী নারী প্রীতিলতার কথা। ডাক নাম তাঁর রানী। আর পারিবারিকভাবে পাওয়া পদবি ওয়াদ্দেদার। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ১৯১১ সালের ৫ মে চট্টগ্রামের ধলঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন মিউনিসিপ্যাল অফিসের হেড কেরানি জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার। মা প্রতিভা দেবী। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে প্রীতি দ্বিতীয়। প্রীতি ছিলেন অন্তর্মুখী, লাজুক ও মুখচোরা স্বভাবের। আমৃত্যু তিনি নম্রতা, বদান্যতা, লজ্জাশীলতা লালন করেছেন। বিদ্রোহী বলতে মনে যে চিত্রটা ফুটে ওঠে তেমন তিনি ছিলেন না। মাস্টারদা সূর্য সেনকে গুরু মেনে নিভৃতে, নীরবে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন স্বদেশের পাশে। পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রামের খাস্তগীর স্কুলে। পরে ইডেন কলেজে এসে আইএতে ভর্তি হন। মেয়েদের মধ্যে প্রথম তিনি স্ট্যান্ড করেন। এর পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিস্টিংকশনসহ বিএ পাস করেন। পরে চট্টগ্রামে ফিরে এসে অপর্ণাচরণ স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। আড়ালে তিনি সব সময় জড়িত ছিলেন স্বদেশি আন্দোলনে। প্রীতির নম্র-ভদ্র স্বভাব দেখে কেউ কল্পনাও করেনি যে তিনি স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। ইডেন কলেজে পড়ার সময় বিপ্লবী সংগঠন 'দিপালী সংঘে'র সঙ্গে যুক্ত হন। চট্টগ্রামে তিনি বিপ্লবী মেয়ে সদস্য ও ছাত্রীদের নিয়েও একটি চক্র গড়েন। সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পরিকল্পনা করতে গিয়ে বোমা বানানোর খোল আনার দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রীতির চক্রকে। এই খোল পরে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে কাজে লাগানো হয়। ১৯৩২ সালের ১৩ জুন প্রীতিলতা দেখা করেন মাস্টারদার সঙ্গে ধলঘাটে। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে পুলিশ এই বাড়ি ঘেরাও করে। প্রীতিলতা ও মাস্টারদা বাড়ির পেছনের জঙ্গল দিয়ে পালিয়ে যেতে সমর্থ্য হন। কিন্তু ফেলে যান হাতে লেখা কিছু কাগজ ও তাঁর নিজের ছবি। পরে পুলিশ তাঁর বাড়িতে গিয়ে তল্লাশি চালায় হাতের লেখা মিলিয়ে দেখার জন্য। বিপদ দেখে তিনি ঘোড়ার গাড়িতে করে পালিয়ে যান। এ প্রসঙ্গে এক পুলিশ অফিসার বলেন, এত নম্র-ভদ্র মেয়েটি যে এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত, তা টের পাওয়ার আগেই মেয়েটি পলিয়ে গেল। ১৯৩২ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয় এবং মাস্টারদার ইচ্ছায় এর দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রীতিলতাকে। মিশন সাকসেস করে ফিরে আসার সময় আত্মগোপনকারী এক ইংরেজ যুবকের গুলিতে তিনি আহত হন। পরে তিনি সিদ্ধান্ত নেন আহত অবস্থায় ধরা পড়ার কোনো সুযোগ দেওয়ার চাইতে পটাশিয়াম সায়ানাইড মুখে দিয়ে মরে যাওয়া শ্রেয়। তিনি তাই করলেন। তিনি স্বদেশের জন্য আত্মাহুতি দিয়ে অনন্তকাল ধরে কোটি হৃদয়ে খুঁড়ে চলবেন মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসায়।
জাহাঙ্গীর হোসেন অরুণ

No comments

Powered by Blogger.