নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি -আদালতের রায় কোনো বাধা নয় by আবু সাঈদ খান

আগামী সাধারণ নির্বাচনকালে সরকার ব্যবস্থা কী হবে তা নিয়েই দেশের বর্তমান রাজনীতি আবর্তিত। বিষয়টি সাংবিধানিক ও আইনানুগভাবে স্থির থাকলেও রাজনৈতিকভাবে অমীমাংসিত। সরকার ও বিরোধী দল দুই মেরুতে দাঁড়িয়ে আছে, কেউ কারও কথা শুনছে না।


বিরোধী দলের দাবি ক্ষমতাসীনরা আমলে নিচ্ছে না। আবার সরকারের প্রস্তাবে বিরোধী দল 'না' বলছে। এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সংঘাত নিশ্চিতভাবেই বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক।
সরকার ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল বিষয়ে উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণের বাধ্যবাধকতার কথা বলছে। বিরোধী দল এ রায়কে পক্ষপাতদুষ্ট, অগ্রহণযোগ্য ও বাতিলযোগ্য বলে তা প্রত্যাখ্যান করেছে। এ অনড় অবস্থানের মাঝে সমাধান নেই। বরং উভয়পক্ষকে নমনীয় মনোভাব নিয়ে যৌক্তিক সমাধানের কথা ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে আদালতের রায় কোনো বাধা নয়। এ রায়ের আলোকেই সমাধানের পথ খোঁজা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে একে অন্যকে পরাস্ত করার মানসিকতা পরিত্যাজ্য।
আমাদের অনুধাবন করা দরকার, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি কেন সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল? কেন এ দাবির সমর্থনে '৯০ এবং '৯৬তে দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল? এটি ছিল সে সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতা। যে পরিস্থিতি এখনও অক্ষুণ্ন রয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রতি বিরোধী দল আস্থা রাখতে পারেনি। কারণ, স্বাধীনতার পরে যারাই দেশ পরিচালনা করেছে, তারা সবাই নির্বাচন পরিচালনায় পক্ষপাত করেছে। ব্যালট পেপার, ভোটবাক্স ছিনতাই, খুশিমতো বাক্স ভরা, নির্বাচনের রায় পাল্টে দেওয়াসহ হরেক রকমের কারচুপি ও সন্ত্রাস করেছে। সে পরিপ্রেক্ষিতে স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৯০ সালে প্রণীত তিন জোটের রূপরেখায় (৮ দল, ৭ দল ও ৫ দল) নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে কালো টাকার প্রভাব, আঞ্চলিকতা, ক্ষেত্রবিশেষ সাম্প্রদায়িকতা কাজ করলেও নির্বাচনটি ছিল অবাধ ও নিরপেক্ষ। এটি একটি মডেলে পরিণত হয়।
মাগুরার নির্বাচনের ন্যক্কারজনক ঘটনার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারে সেই মডেল অনুসরণের বিষয়টি সামনে এসে যায়। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রয়োজনে এর গুরুত্ব অনুভূত হয়। তাই ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর সম্মিলিত দাবির মুখে বিধান হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। খালেদা জিয়া ও বিএনপির মাধ্যমে এ বিধান প্রবর্তিত হলেও কৃতিত্ব পুরোমাত্রায় শেখ হাসিনা ও তার দলসহ সংগ্রামরত অন্য দলগুলোর প্রাপ্য।
এটি অস্বীকার করার জো নেই, পরবর্তী সময়ে এর নেতিবাচক প্রভাব বিচার বিভাগের ওপর পড়েছে। বিচারপতিদের বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানোর গূঢ় রহস্য নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, বয়স বাড়িয়ে বিচারপতি কেএম হাসানকে প্রধান বিচারপতি করার মধ্যে তৎকালীন সরকারের দুরভিসন্ধি কাজ করেছে। এ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন চলাকালে তাকে প্রথম অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল, যাতে বিধিমতে তিনি পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারেন। যদিও সৃষ্ট পরিস্থিতিতে তিনি তখন দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকার করেছিলেন।
বিচার বিভাগের ওপর এর প্রভাব ছাড়াও নানা অজুহাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ বৃদ্ধি ও ১/১১-এর ঘটনার মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইনগত দুর্বলতা ফুটে ওঠে। তা উপেক্ষা করার বিষয় নয়। তখন এ পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংস্কারের দাবি উঠেছিল, তা বাতিলের নয়। তখন নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে আওয়ামী লীগসহ সব দলই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে। তবে এ সরকার যাতে দীর্ঘায়িত হতে না পারে, ১/১১-এর জন্ম নিতে না পারে সেই প্রতিরোধের বিধান রাখার কথা বলা হয়। কিন্তু ২০১১ সালে হঠাৎ করে উচ্চ আদালতের রায়ের দোহাই পেড়ে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার বিধান করা হয়, যা নতুন করে সংকটের জন্ম দেয়। তবে এ ব্যাপারে বিরোধী দলের ভূমিকাও হতাশাব্যঞ্জক। লাগাতার সংসদ বর্জন এবং সংসদে গিয়ে বক্তব্য তুলে না ধরে কেবল রাজপথে আন্দোলন করার প্রবণতা সংকটকে দীর্ঘস্থায়ী ও ঘনীভূত করেছে। এ ব্যাপারে সরকারও বিরোধী দলকে আলোচনায় আহ্বান জানায়নি, বিরোধী দলও আগ্রহ দেখায়নি; যা সরকার ও বিরোধী দলের দূরত্বকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। এ দূরত্ব কমিয়ে সরকার ও বিরোধী দলকে যৌক্তিক অবস্থানে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। আলোচনার টেবিলেই এর সুষ্ঠু সমাধান হতে পারে।
১৬ সেপ্টেম্বরে আদালতে পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার অবস্থান থেকে এক পা এগিয়ে নির্বাচনের ৯০ দিন আগে সংসদ ভেঙে দেওয়ার কথা বলেছেন। অর্থাৎ বর্তমান বিধান অনুযায়ী সংসদ রেখে নির্বাচন করার অবস্থানে তিনি নেই। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী এবং গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের বিভিন্ন সময়ের বক্তৃতা-বিবৃতিতে প্রতীয়মান হয় যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে বিরোধী পক্ষেরও যোগদানের সুযোগ রয়েছে। আর বিরোধী দল যোগ দিলে সে সরকার হবে সর্বদলীয়। সে ক্ষেত্রে সরকারপ্রধান কে থাকবেন, সেটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সব ক্ষমতাই প্রধানমন্ত্রীর হাতে কেন্দ্রীভূত। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। তাই রাষ্ট্রপতির অভিভাবকত্বে নির্বাচনের বিষয়টি কেবল কথার কথা। বাস্তবে যার কাছে প্রধানমন্ত্রিত্ব, ক্ষমতা তারই মুঠিতলে। এ ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে, অন্য কাউকে সরকারপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হতে পারে। তবে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করার প্রশ্নে সরকার ও বিরোধীদের একমত হওয়া কঠিন ব্যাপার। সর্বদলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় এমন কাউকে কি পাওয়া যাবে, যাকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নেবে?
এখন সামনে রাজনৈতিক বিতর্ক_ সর্বদলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার, না দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার?
অনেকের অভিমত হচ্ছে, পূর্ণাঙ্গ রায়ে দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে দলীয় বা নির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই সমাধান। সেটি খতিয়ে দেখার ব্যাপার। আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছে, 'সংবিধানে (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন ১৯৯৬, অসাংবিধানিক ও অবৈধ হইলেও জাতীয় সংসদ ইহার বিবেচনা (উরংপৎবঃরড়হ) ও সিদ্ধান্ত অনুসারে উপরে বর্ণিত নির্দেশাবলি সাপেক্ষে দশম ও একাদশ সাধারণ নির্বাচনকালীন সময়ে প্রয়োজনমতো নতুনভাবে ও আঙ্গিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যবস্থা করিতে পারিবে। [৪৪।(১৩)]' এ নির্দেশনার আলোকে দুই মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধান করায় কোনো বাধা নেই।
তবে এখানে উপরে বর্ণিত নির্দেশাবলির কথা হয়েছে। সেটি হচ্ছে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অনির্বাচিত বা দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের সুযোগ আছে কিনা? এখানে বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তাই মুখ্য বিবেচনার বিষয়।
আইন-কানুন কোনো অপরিবর্তনশীল বিষয় নয়, যুগের চাহিদা ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা সদা পরিবর্তনশীল। মানুষ ও সমাজের প্রয়োজনে আইন তৈরি হয় এবং তা সংশোধিত হয়। এ ব্যাপারে সর্বদা কঠোরতা শুভ নয়। যে দেশ বা সমাজ চাহিদা অনুযায়ী আইনি পদক্ষেপ নিতে পারে না; সে দেশ বা সমাজ সামনে এগোতে পারে না। রাজনৈতিক বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ল্যাটিন ম্যাক্সিমের কথা বলেছেন। আমি সেটিই পুনর্ব্যক্ত করে বলতে চাই_ ÔThat which otherwise is not lawful, necessity makes lawfulÕ, ÔSafety of the people is the supreme lawÕ, ÔSafety of the state is the supreme law.Õ
আদালতের রায়ে যখন রাজনৈতিক বাস্তবতাকে আমলে নেওয়া হয়েছে, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সদস্যরা নির্বাচিত, না অনির্বাচিত সে বিতর্কে কালক্ষেপণের সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐকমত্য জরুরি। অন্যদিকে আদালতের রায় বাতিলযোগ্য বলে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পরিপন্থী। আদালতের রায়ের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণে বাধা নেই। রায় দানকারী বিচারকদের প্যানেলের তিনজন বিচারক ভিন্নমত পোষণ করেছেন। আদালতের এ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন করার সুযোগ রয়েছে। সেটি না করে আন্দোলনের মাধ্যমে রায় বাতিলের ঘোষণা অনাকাঙ্ক্ষিত। এ প্রসঙ্গে একটি বিতর্ক এসেছে যে, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি পূর্ণাঙ্গ রায় দেওয়ার এখতিয়ার রাখেন কি-না। অবসর গ্রহণের পর রায় লেখার কনভেনশন রয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও এমন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় দিতে ১৬ মাস গড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা অনভিপ্রেত। এ দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ায় বিচার ব্যবস্থার প্রতি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, সেটির দায় কি সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞ বিচারকরা এড়িয়ে যেতে পারেন?
নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংঘাত নয়, তারা সৌহার্দ্য ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসবেন। তিন জোটের রূপরেখা প্রণয়নকালে কিংবা ১৯৯১-এর সংসদে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে আসার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সে সৌহার্দ্য ও প্রীতি দেখা গেছে। এবারও দুই দলের নেতা-নেত্রীরা একই মনোভাবের পরিচয় দেবেন, সেটিই কাম্য। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, সংসদে সদস্য সংখ্যা যাই হোক, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কিংবা আওয়ামী জোট ও বিএনপি জোট ভোটের বিচারে কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে। সামান্য হেরফেরে ক্ষমতার পালাবদল ঘটছে। সেই বিবেচনায় বিএনপি ও তার সহযোগীদের বাইরে রেখে নির্বাচন করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। এটি হবে ১৯৯৬ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখে বিএনপির প্রহসনের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি মাত্র।
দেশের জনগণ প্রহসনের নির্বাচন চায় না। সবাই চায় জনস্বার্থে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। সেই বিবেচনায় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের বিকল্প নেই।

আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com

No comments

Powered by Blogger.