জনগণের উত্থানেই মুক্তি এসেছে চিরদিন by শামসুল আরেফিন খান

আর্জেন্টিনার সাবেক সেনাপ্রধানের ৫০ বছর জেল হয়েছে স্বৈরশাসন আমলের জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত দেশটিতে সামরিক শাসন ছিল। সামরিক শাসনামলে দেশটির ৩৫ হাজার বামপন্থী নেতা-কর্মীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়।


সেই সঙ্গে প্রগতিশীল পরিবারগুলো থেকে ৩০ হাজার শিশুকে অপহরণ করা হয়। তাদের অনেকেই নির্মম হত্যা-নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। ৩৫ বছর পর সেই নির্মম-নিষ্ঠুর ও নিদারুণ মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য জেনারেল ভিদেলার কারাদণ্ডিত হলেন অর্ধশত বছর মেয়াদে। তাঁর একজন সহযোগীকেও যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছে। শিশুহরণ ও হত্যার পক্ষে অপরাধীরা সাফাই গাইতে গিয়ে বলেছে, 'সন্ত্রাসীদের' কবল থেকে নিষ্পাপ শিশুদের উদ্ধার করে সুন্দর সুশীল জীবনে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাদের 'মহৎ' লক্ষ্য। কিন্তু যারা ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষা নেয় না, সেই জ্ঞানপাপীদের ইতিহাস পুনর্বার শিক্ষা দিল যে পাপ বাপকেও ছাড়ে না।
১৯৭১ সালে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, জামায়াত-শিবির, মুসলিম লীগও বলেছিল, খাঁটি পাকিস্তানি 'কওম' সৃষ্টির লক্ষ্যেই কাফির ও দুষ্কৃতকারীদের হত্যা এবং তাদের দুই লক্ষাধিক মা-বোনকে ধর্ষণ করা হয়েছে। বর্বর হিটলারও একই ধরনের এক অভিনব যুক্তিতে নির্বিচার গুলিবর্ষণ করে এবং আগুনে ও গ্যাসে পুড়িয়ে ৬০ লাখ ইহুদি নরনারী আবালবৃদ্ধবনিতাকে হত্যা করেছিল। সেই নিকৃষ্টতম মানবতাবিরোধীদের বিচার এখনো অব্যাহত রয়েছে।
রোম সম্রাট থিওডোসিয়াস ৩৮০ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ফেব্রুয়ারি 'ক্যাথলিক ক্রিশ্চিয়ানিটি'কে রাষ্ট্রধর্ম করেন। তখন থেকে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের ওপর গির্জার আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। তার আগে দীর্ঘ ৩০০ বছর প্রাচীন ধর্মমতের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সাংঘর্ষিক অবস্থায় খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরাই ব্যাপক হারে দলিত ও পদপিষ্ট হয়। কিন্তু পরবর্তী সহস্রাব্দে গোটা ইউরোপে রাষ্ট্রধর্মের শিরোস্ত্রাণধারী রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় বল প্রয়োগে ধর্মান্তকরণ তথা ইনকুইজিশনের নামে মধ্যযুগীয় বর্বরতার শিকার হয় লাখ লাখ প্রাচীন ধর্মাবলম্বী এবং বৌদ্ধ, ইহুদি ও মুসলিম জনগণ।
১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে স্পেনে এক রাষ্ট্রীয় ফরমানে ইহুদি ও মুসলিমদের ধর্মান্তর, অন্যথায় দেশত্যাগের কথা বলা হলো। ১৫০১ সাল পর্যন্ত ধর্মের নামে এই জুলুম অব্যাহত ছিল। ইনকুইজিশনের রক্তপ্রবাহ কিছুটা স্তিমিত হলো ১৮৩৪ সালে রানি ইসাবেলার শাসনামলে এসে। রানির পৃষ্ঠপোষকতায় ১৫০২ সালে বিশ্বজয়ী নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস তাঁর চতুর্থ অভিযানে বা শেষ যাত্রায় মধ্য আমেরিকায় পৌঁছাতে সক্ষম হন, বহু ঝড়ঝাপ্টা ও হারিকেনের বাড়ি খেয়ে। এই কলম্বাসই আমেরিকার সঙ্গে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, নিকারাগুয়া, কোস্টারিকা, পানামা এবং ইউরোপের দাস ব্যবসার যোগসূত্র ঘটান। তিনি আমেরিকার উপকূলে ধর্মীয় সহিংসতা ও বর্বরতাও নিয়ে গিয়েছিলেন। তখনকার দাস প্রভুরা আমেরিকার আদিবাসীদের উৎখাত ও বাস্তুচ্যুত করে বসতি স্থাপন করেন। বিস্তার করেন দাস যুগের।
মধ্যযুগীয় বর্বরতার স্মারক সেই দাস যুগের অবসান ঘটিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ১৮৬৫ সালের এপ্রিলে বেঘোরে প্রাণ হারালেন এক ধর্মান্ধ বর্ণবাদী আঁততায়ীর গুলিতে। মধ্যযুগীয় ইনকুইজিশন বা সেই বর্বর ধর্মীয় সহিংসতা হাল আমলের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুদীর্ঘ গৃহযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শত বর্ষব্যাপী সংগ্রামের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পরিণত হয়েছে প্রাণবন্ত ফসিলে। পেঁয়াজের অন্তর উন্মোচনের মতো একটি একটি করে সূক্ষ্ম স্তর অতিক্রম করে অন্তরালে পৌঁছাতে পারলে দেখা যাবে, সেখানে বিরাজমান রয়েছে এখনো বর্ণবাদ ও দাস যুগের দগদগে ঘায়ের কুৎসিত অস্তিত্ব। বর্ণচোরা বর্ণবাদীরা ২০১১ সালেই হোয়াইট হাউসের সামনে কালো সাংসদদের গায়ে থুথু ছিটাতে মোটেও কুণ্ঠিত হয়নি। কালো প্রেসিডেন্টকে কেটে সারমেয়র খোরাকে পরিণত করার সংকল্প ব্যক্ত করে ধর্মান্ধ উগ্রবাদীদের একজন গ্রেপ্তারও হয়েছে। কংগ্রেসের উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশনে ভরা মজলিসে ওবামাকে 'ইউ লায়ার' বা 'তুই মিথ্যুক' বলে উচ্চকণ্ঠে গালি দিয়ে শতাব্দীজয়ী সৌজন্যে কুঠারাঘাত করতে একটুও দ্বিধাচিত্ত হননি একজন বিশিষ্ট রিপাবলিকান বিধায়ক।
বস্তুত, এ সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কার্যকর রয়েছে সোনার শিকল পরানো, রুটি-মাখন-চর্বি খাওয়ানো নব্য দাসত্ব। তার মহাপ্রভু চার শতাধিক বিলিয়ন অধিপতি এবং তাদের দোসর দেশের এক শতাংশ শীর্ষ ধনী। তাদেরই অঙ্গুলি হেলনে আগুন জ্বলে ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া ও ফিলিস্তিনে। যুক্তরাষ্ট্রের জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে যত সামরিক-বেসামরিক সম্পদ, যত শিল্প, কৃষি, গবেষণা ও সেবা প্রতিষ্ঠান, যত শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান- সবই তাদের করতলগত। যত সামরিক যান, যত অস্ত্র-গোলাবারুদ, যত হলাহল, যত অমৃত- সবই তাদের সৃজন। সহযোগী আরো ১৯ শতাংশ ধনাঢ্য পরিবারসহ শীর্ষ ২০-এর দখলে দেশের ৯৩ শতাংশ সম্পদ। বঞ্চিত ৮০ শতাংশ মার্কিনি এখন সোনার খাঁচায় পোষা নব্য দাস। মুদ্রার এক পিঠে সাংবিধানিক সরকার, অন্য পিঠে অলক্ষে অদৃশ্য ভগবানের দৃঢ় অধিষ্ঠান। কিন্তু সুখের বিষয় যে এত গলদ সত্ত্বেও সেখানে কোনো রাষ্ট্রধর্ম নেই। রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো প্রার্থনাসভাও হয় না। গোটা ইউরোপেও 'ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার'। কিন্তু হায়! ৩০ লাখ শহীদের রক্তস্নাত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্মের শিরস্ত্রাণধারী ধর্মনিরপেক্ষতার এখন যে সোনার পাথর বাটির দশা!
তবু যা-ই হোক, ৪১ বছর পর '৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য সুনির্দিষ্ট অভিযোগে বিচার চলছে গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, মুজাহিদ, সাকা চৌধুরী, আবদুল আলীমসহ সে সময়ের শীর্ষ রাজাকার-আলবদর নেতাদের। কিন্তু মহাজোট সরকারের ঘরে-বাইরে ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত নব্য রায়বল্লভ, উমিচাঁদ, ঘসেটি বেগম ও মীরজাফরদের। তার ওপর রয়েছে দাতাগোষ্ঠীর চাপ।
বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিল করায় জাতির আবেগ আবারও নাড়া খেয়েছে। একাত্তরের মতোই নবীন ও তরুণ প্রজন্ম এবারও উদ্বেলিত হয়ে উঠবে নিশ্চয়ই। আশা করি, তারা স্বাধীনতার সোনালি ফসল ঘরে তুলতে, সব দুর্যোগ উপেক্ষা করে এগিয়ে যাবে।
দুঃসাহস না থাকলে কোনো অসাধ্য সাধন করা যায় না। চীন বিপ্লবের স্মারক মুক্তিসেতু নিশ্চয়ই অনেকে দেখেছেন। আমিও দেখেছি। মাও সে তুং উত্তর-পশ্চিম চীনের শক্ত ঘাঁটি থেকে চিয়াংকাইশেকের বিরুদ্ধে শেষ যুদ্ধ পরিচালনা করেন। এই পর্বে ইয়াংশি নদী অতিক্রম করে চিয়াংকাইশেকের রাজধানী মানকিং (নানজিং) জয় করেন ১৯৪৯ সালের ২৩ এপ্রিল। নানজিং পর্যন্ত প্রসারিত মুক্তিসেতুটির নির্মাণ অসমাপ্ত রেখে রুশ প্রকৌশলীরা হঠাৎ করেই প্রস্থান করেন। চীন সে সময় মুক্তিসেতুসহ নির্মাণাধীন স্থাপনাগুলো নিজস্ব অর্থ ও মানব সম্পদ দিয়ে দ্রুত সমাপ্ত করেছিল বলেই আজ তারা বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক পরাশক্তি হতে পেরেছে। আমাদেরও সাহসী হতে হবে। ১৯৭১ সালে যে পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত নৌবহর যাত্রা শুরু করেছিল, সেটা এত দিনে বঙ্গোপসাগরের পথ খুঁজে পেয়েছে। ভারত মহাসাগরের দিয়াগো গার্সিয়ার পথ হারিয়ে সেটা আমাদের প্রবাল দ্বীপে নোঙর ফেলতে চাইলে জাতীয় ঐকমত্য দিয়েই সে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। বাঙালি জাগবে আবার। এ বিশ্বাস আমরা মুক্তিযোদ্ধারা কেউ হারাইনি।
লেখক : ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, কলামিস্ট
ই-মেইল : muktisakhan

No comments

Powered by Blogger.