ভুল জীবনের হাতছানি

সময় নাই সময় নাই করে দৌড়াচ্ছে সবাই। পরিবার আছে, সমাজ আছে ভুলে যাচ্ছে যেন সবাই। ছোট থেকে ছোট হচ্ছে পরিবার। ভর করছে একাকীত্ব। একঘেয়ে হয়ে উঠছে জীবন। নারীই এর প্রধান শিকার। পরিত্রাণের পথ বেছে নিচ্ছে কিন্তু তা কতটা সঠিক সে বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী এবং মনোবিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন মাশরেখা মনা


যথেষ্ট সুখী মানুষ রিনি রায়। ছেলেমেয়ের স্কুল, কোচিং, স্বামী, সংসারের দেখাশোনা নিয়ে অবিরাম ছুটে চলা। তার বাড়িতে কেউ আসতে চাইলে আজ মেয়ের গানের ক্লাস, কাল ছেলের ক্রিকেট প্র্যাকটিস, সন্ধ্যায় স্বামী ফিরবেন_ ধীরে ধীরে আত্মীয়- বন্ধুদের পা পড়া বন্ধ হয়ে গেল রিনি রায়ের বাসায়। এভাবেই চলছিল। আমার আর রিনির বাড়ি একই জেলায়। একই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছি। তারপর বিচ্ছিন্ন। বছরপাঁচেক পর ঢাকায় আবার দু'জনের দেখা। বন্ধুত্বটা আরও জোরালো হলো; কিন্তু সেই আমি ওর বাড়ি যাওয়া ছেড়ে দিলাম অনেকটা অভিমান করেই ওর ব্যস্ততার কারণে। আবারও অনেকটা দিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। হঠাৎ একদিন ওকে আবিষ্কার করলাম এক ভদ্রলোকের সঙ্গে গুলশানের একটি ফাস্টফুডের দোকানে। চোখের পলক পড়ছিল না। চোখাচোখি হয়ে গেল ওর সঙ্গে। পরদিন ওর ফোন। একটানা বলতে থাকল, থামা নেই। অনুভব করলাম ওর ভেতরটা হালকা হয়ে আসছে ক্রমশ। ওর কথার সারাংশ, স্বামী সকালে কর্মস্থলে যায় আর গভীর রাতে ফেরে। কাজের কথা ছাড়া অন্য কোনো কথা বলার সময় নেই তার। রাতে ঘুমের যাতে ব্যাঘাত না হয় সে কারণে স্বামী থাকেন আলাদা ঘরে। ছেলেমেয়ে যার যার মতো। বড় হয়ে গেছে ওরা। সংসার সংসার করে সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্নতা। একাকীত্ব ক্রমশ গ্রাস করতে লাগল ওকে। এর মাঝে হঠাৎ একদিন কথা হয় তার পুরনো বন্ধুর সঙ্গে। মাঝে মধ্যে কথা হতো। বন্ধুর ফোন এবং বন্ধুর সঙ্গে কিছু সময় কাটানো রিনির জীবনে শ্রেষ্ঠ আনন্দের সময় হয়ে ওঠে। তার বন্ধুও তাকে যথেষ্ট মূল্যায়ন করে। তাই সে বন্ধুর সঙ্গে তার জীবনের সবকিছু শেয়ার করে। স্বামী-সন্তানের ব্যাপারেও তার সব দায়িত্ব ঠিক রেখেই সে তার বন্ধুত্বের সম্পর্ক ঠিক রেখেছে। রিনি জানে আমাদের দেশে ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিতে তার এই সম্পর্কটি অপরাধ। তারপরও তাকে সুস্থভাবে বাঁচতে হলে তার এই সম্পর্ক প্রয়োজন এই তার কথা।
আধুনিক নগরজীবনে এমন দ্বৈত সম্পর্কের ঘটনা বেড়েই চলেছে_ জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী। তিনি বললেন, পরিসংখ্যান দেখলে অবাকই হতে হয়। আসলে পুরো সমাজে একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে। দেখবেন মানুষের অনেক কিছু আছে এখন, কিন্তু তারপরও শান্তি নেই। ভালো আছি কথাটা শোনা যায় খুব কম। মানুষের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ফলে যারপরনাই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে মানুষ। পারিবারিক জীবন আছে , সামাজিক জীবন আছে সেটা ভুলতে বসেছি আমরা। স্বার্থ ছাড়া এককদম পা ফেলতে চাই না। এমন এমন পরিবার আমি দেখেছি স্বামী-সন্তান-আমি ছাড়া তারা আর কিছু বোঝে না। এই যে জনবিচ্ছিন্নতা এটি মানুষকে একসময় গ্রাস করে এবং করবেই। অতি স্বার্থপরতা এবং বিচ্ছিন্নতা নানা অপঘটনার জন্ম দেবে এটাই স্বাভাবিক। সমাজ এখন দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। মেয়েদের শিক্ষা এবং উন্নয়নের বিষয়ে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র অনেক বেশি সচেতন হয়ে উঠেছে। ফলে আমি মানুষ, মানুষ হিসেবে আমারও চাওয়া আছে, পাওয়ার অধিকার আছে_ এই বোধ তৈরি হচ্ছে মেয়েদের মধ্যে। ফলে মেনে নেওয়ার মানসিকতা কমে যাচ্ছে। গৃহিণী এবং কর্মজীবী সবারই অতিরিক্ত কাজের চাপ। ক্লান্ত এবং আনন্দহীন জীবনে অন্য সম্পর্কে আসক্ত হয়ে পড়ছে সহসা। ফ্রি সোসাইটিতে ঢুকে যাচ্ছে মেয়েরা। স্ত্রীর ওপর স্বামী এবং স্বামীর পরিবারের নির্যাতন একটি বড় কারণ। সমাজ এত পরিবর্তন হচ্ছে যে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে সম্মানবোধ দিন দিন কমে যাচ্ছে। প্রতিযোগী মনোভাব কাজ করছে বেশি। আমার জানামতে, উচ্চবিত্ত নারীদের চাহিদা খুব বেশি বাড়ছে। তারা সম্পদশালী অন্য পুরুষের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে নানা প্রতারণার শিকার হয়ে আবার নিজের ক্যারিয়ার গড়তে গিয়ে বিবাহিত নারীরা অন্য পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে।
আমি মনে করি, বিষয়টি খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত আমাদের। মিডিয়াতে এ ধরনের সম্পর্কের কুফলগুলো বেশি করে তুলে ধরতে হবে। তাহলে নারীরা জানতে বা বুঝতে পারবে। কারও সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠা দোষের নয়, কিন্তু দেখা যায় এ ধরনের সম্পর্ক থেকেও নারীরা প্রতারণার শিকার হচ্ছে। বহু কেইস হিস্ট্রিতে দেখেছি, এতে মেয়েরাই ক্ষতির শিকার হচ্ছে বেশি। স্বাধীনতার সঠিক সংজ্ঞা বুঝতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শাহীন ইসলাম প্রথমতই দায়ী করেন মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, স্যাটেলাইটকে। তিনি বলেন, বিজ্ঞানবিরোধী কথা হলেও আমি বলব প্রযুক্তি যত সহজলভ্য হচ্ছে অপরাধ তত বাড়ছে। অধিকাংশ স্বামীর মনোভাব এমন ঘরে বউ তো আছেই। বউ কি চলে যাবে! বউয়ের যা প্রয়োজন তা দিচ্ছি। বউয়ের সংসার, সন্তান আছে আর কী চাই। পুরুষতান্ত্রিক এই মানসিকতা এখন মেয়েরা মেনে নিতে চাইছে না। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে ভালোবাসা , শ্রদ্ধা এবং আনন্দ থাকা খুব জরুরি। অনেক নারী তাদের জীবনের দুর্বল সময়গুলোতে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। এই আবেগ থেকেও নতুন সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। জীবনের জন্য যেমন মানুষের স্বপ্ন দেখেছিল তা হয়তো পায়নি। অতৃপ্তি থেকেই যায়। যখন সে রকম মানুষের দেখা মেলে বা যার মাঝে তা খুঁজে পায় তখনও আলাদা সম্পর্ক তৈরি হতে পারে। একঘেয়ে জীবন থেকে মুক্তি পেতে বন্ধুর প্রয়োজন অনুভব করে। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিশ্বাস কমে যাচ্ছে। ফলে বেশিরভাগ কর্মজীবী নারী স্বামী বা শ্বশুরবাড়ি কর্তৃক নানা অপবাদ পায় এবং এসবের জন্য নারীটি তখন ক্ষিপ্ত হয়ে অন্য পুরুষের সানি্নধ্যে যায়। কারও সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হতেই পারে। তা দোষের নয়; কিন্তু সম্পর্ক কতটা ঘনিষ্ঠ হবে তা ভাবতেই হবে_ বললেন শাহীন ইসলাম। নিজের অবস্থানে থেকে নিজেকে সুখী ভাবতে হবে। নিজের বিবেক, বুদ্ধি দিয়ে জীবনে পথ চলতে হবে। মাথা গরম করে, প্রতিবাদী হয়ে, আবেগে ভেসে নতুন সম্পর্ক তৈরি করায় সমস্যা সমাধান তো হয়ই না উল্টো সমস্যা বাড়ে। বড় হচ্ছে আপনার ভালো লাগা যে কোনো কাজে নিজেকে ব্যস্ত করে তোলা। নিজের জগৎকে বড় করতে পারলে সমস্যাগুলো অনেক কমে আসবে। আপনি মা, আপনাকে তা মনে রাখতেই হবে।
 

No comments

Powered by Blogger.