বুয়েটে হঠাৎ উপাচার্যপন্থী সংগঠনের উদয়-সংকট নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আজ বৈঠক by অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য

বুয়েটের উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে গতকাল শনিবার সকালে মৌন মিছিলের পর আন্দোলন অব্যাহত রাখার শপথ নিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। অন্যদিকে বিকেলে 'বুয়েট শিক্ষক ছাত্র কর্মকর্তা কর্মচারী ঐক্য ফোরাম' নামে একটি সংগঠন সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি অযৌক্তিক।


গতকাল দুপুরেই উপাচার্যপন্থী হিসেবে সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করে।
বুয়েটের সংকট কাটাতে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। গত কয়েক দিন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বুয়েট আন্দোলনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আজ রবিবার দুপুরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হবে। এ বৈঠকে সংকট নিরসনে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সভাপতিত্বে বৈঠকে মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান ছাড়াও শিক্ষাসচিব উপস্থিত থাকবেন বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেকটা রুদ্ধদ্বার এ বৈঠকে বুয়েট পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। এরপর বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হবে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শিক্ষাসচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিষয়টি ওভাবে দেখা উচিত নয়। বৈঠকে বুয়েটের সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হবে।'
গতকাল দুপুরে বুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক এস এম নজরুল ইসলাম আবারও বলেছেন, একটি গোষ্ঠীর ইন্ধনে তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। এতে বহিরাগতরা যোগ দিয়ে বুয়েটকে অস্থিতিশীল করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত না হলে তিনি পদত্যাগ করবেন না।
আর শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, 'উপাচার্যের এসব কথা কল্পনাপ্রসূত ও মনগড়া। আমাদের সঙ্গে যারা আন্দোলনে যোগ দিয়েছে তারা কেউই বাইরের নয়, তারা সবাই বুয়েটের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারী।' বুয়েট পরিস্থিতি নিয়ে আজ সকাল ১১টায় রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি দেবে শিক্ষক সমিতি। সেখানে উপাচার্য, উপ-উপাচার্যের পদত্যাগ দাবির কারণ তুলে ধরা হবে। তিনি জানান, উপাচার্য আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তবে শিক্ষক সমিতি তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
এদিকে একটি গোয়েন্দা সংস্থা গতকাল সকালে জানায়, উপাচার্যের পক্ষে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং কর্মচারীদের একাংশ মাঠে নামছে। এরপর বিকেলেই দেখা যায় বুয়েট ক্যাফেটেরিয়ার সামনে 'বুয়েট শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মচারী ও কর্মকর্তা ঐক্য ফোরাম' নামে সংবাদ সম্মেলন করা হচ্ছে। সেখানে বক্তব্য দেন অধ্যাপক মুনহাজ আহমেদ। তিনি বলেন, 'যারা আন্দোলন করছে তারা নিজেরাই জানে না কেন আন্দোলন করছে। এ আন্দোলনে হিজবুত তাহরীর নামে একটি সংগঠনের ইন্ধনে বুয়েট পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়েছে।' সংবাদ সম্মেলনে পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান লিখিত বক্তব্যে দুটি আহ্বান এবং চারটি প্রশ্ন তুলে ধরেন। এর মধ্যে অবিলম্বে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন প্রত্যাহার এবং বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের কাজে সহায়তা করার আহ্বান জানানো হয়েছে। তাঁর চারটি প্রশ্ন হচ্ছে- তদন্তের আগে দ্বন্দ্ব কেন, বিচার বিভাগীয় তদন্তে আপত্তি কেন, শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা নয় কেন, সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় কেন?
এর জবাবে শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক আতাউর রহমান বলেছেন, যাঁরা ঐক্য ফোরামের নামে সংবাদ সম্মেলন করেছেন, তাঁরা উপাচার্যের উপদেষ্টা। তাঁরা কথায় কথায় উপাচার্যকে 'জি স্যার, জি স্যার' বলে সায় দেন। তারা উপাচার্যের অনিয়মের সাক্ষী। শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, 'ঐক্য ফোরামের কারণে আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছি। কারণ ইতিমধ্যে ঐক্য ফোরামের সদস্যরা আন্দোলনের ব্যানার নামিয়ে ফেলেছেন।'
মৌন মিছিল : গতকাল সকাল সাড়ে ১১টায় উপাচার্য কার্যালয়ের সামনে থেকে একটি মৌন মিছিল বের করেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা। মিছিলটি বকশীবাজার, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল হয়ে শহীদ মিনারে এসে শেষ হয়। এখানে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে আন্দোলনরতদের শপথবাক্য পাঠ করান অধ্যাপক মো. এহসান। শপথবাক্যে বলা হয়, 'আমরা আমাদের ঐতিহ্যবাহী বুয়েটকে যেকোনো মূল্যে রক্ষা করব, বুয়েট রক্ষার তাগিদে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের মধ্যে যে ইস্পাত-দৃঢ় ঐক্য গড়ে উঠেছে তা যেন বজায় থাকে।' সমাবেশে শিক্ষার্থীরা তাঁদের পরিচয়পত্র উঁচিয়ে ধরে প্রমাণ করেন তাঁরা সবাই বুয়েটের শিক্ষার্থী। বন্ধের মধ্যে ক্যাম্পাসে অবস্থানরত কয়েক শ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী শপথে আন্দোলন কর্মসূচি থেকে সরে না যাওয়ার অঙ্গীকার করেন। দাবির সপক্ষে গণস্বাক্ষরতা অভিযান শুরু করেছেন শিক্ষার্থীরা। সংগৃহীত স্বাক্ষরসহ দাবি আজ রবিবার আচার্য রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের কাছে দেওয়া হবে বলে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন।
সমাবেশে শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, 'আমরা রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করব উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যকে বুয়েট থেকে অব্যাহতি দিয়ে বুয়েটকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য। কোনো অবস্থাতেই বুয়েটের সুনাম ও ঐতিহ্য রক্ষায় পিছু হটব না।'
শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক জয়নুল আবেদীন ও কোষাধ্যক্ষ আতাউর রহমান বলেন, 'আমরা এমন কোনো উপাচার্য চাই না যিনি অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পালিয়ে এসেছেন।' আন্দোলনে হিযবুত তাহরীরের উসকানি দেওয়ার যে অভিযোগ উঠেছে তা প্রত্যাখ্যান করেন শিক্ষক নেতারা।
উপাচার্যপন্থী ফোরামের আত্মপ্রকাশ : ক্যাফেটেরিয়ার সামনে সংবাদ সম্মেলনে মুনহাজ আহমেদ বলেন, 'অভিযোগ আছে, নম্বর কমিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নামানো হয়েছে। আশা করি, সাংবাদিকরা বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। প্রশাসনে এমন কোনো অনিয়ম হয়নি, যার জন্য উপাচার্যের পদত্যাগ চেয়ে আন্দোলন করতে হবে।' আরো বক্তব্য দেন পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক আবদুল জব্বার, সোহরাওয়ার্দী হলের প্রভোস্ট মিজানুর রহমান, ডেপুটি রেজিস্ট্রার জামাল আহমেদ, সোহরাওয়ার্দী হলের সহকারী প্রভোস্ট ড. কায়েস বিন জামান প্রমুখ। উপাচার্যের পক্ষের সংবাদ সম্মেলনে মাত্র পাঁচ-ছয়জন শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। ছাত্রদের উপস্থিতি ছিল নগণ্য। এতে অধিকাংশই ছিলেন বুয়েটের কর্মচারী।
উপাচার্যের পক্ষে নামা বুয়েট অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কামাল আহমেদ বলেন, 'শিক্ষকদের চলমান উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে কর্মকর্তাদের কোনো সংহতি নেই। কারণ শিক্ষকদের ১৬ দফা দাবির মধ্যে ১০ দফাই অফিসারদের স্বার্থবিরোধী। আমরা কেন নিজের পায়ে নিজেরা কুড়াল মারব? অথচ শিক্ষকরা প্রচার করছেন, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাঁদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন।' তিনি বলেন, শুধু তৃতীয় শ্রেণীর এক হিসাব কর্মকর্তা কেরামত আলী আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছেন। বিএনপিপন্থী কেরামত আলী গত অফিসার্স নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পরাজিত হন। তিনি বলেন, 'শিক্ষকরা আমাদের চেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। বাসা-বাড়ি, পদোন্নতিসহ অনেক ক্ষেত্রেই অফিসারদের জায়গাগুলো তাঁরা দখল করে রেখেছেন।'
উল্লেখ্য, গত বুধবার থেকে প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে আছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এতে প্রকৌশল শিক্ষার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম অচল হয়ে পড়েছে। আন্দোলনের মুখে ঈদ ও রোজার ছুটি এক মাস এগিয়ে এনেছে কর্তৃপক্ষ। তবে সেই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে ক্যাম্পাসেই অবস্থান নিয়ে আছেন শিক্ষার্থীরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপাচার্যকে আন্দোলনরত শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেও দাবি থেকে সরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন শিক্ষক সমিতির নেতারা। সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল গত শুক্রবার বলেন, 'আমরা তো দুই বছর ধরে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে আসছি। তাতে কাজ হয়নি। এখন আর তাঁর সঙ্গে আলোচনার সুযোগ নেই। তবে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে কেউ আলোচনা করতে চাইলে আমরা রাজি আছি।'
টানা অসন্তোষের মধ্যে বুয়েটে শিক্ষকদের গণপদত্যাগের পরদিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে বুয়েট সিন্ডিকেটের একটি প্রতিনিধিদল। এতে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যও ছিলেন। সিন্ডিকেট উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নিলেও আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তা প্রত্যাখ্যান করেন। উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে বুয়েটের শিক্ষক সমিতি এর আগে গত ৭ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করে। প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের দাবি বিবেচনার আশ্বাস দিলে সমিতি আন্দোলন এক মাসের জন্য স্থগিত করে। দাবি পূরণ না হওয়ায় গত ৭ জুলাই থেকে প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করছিলেন শিক্ষকরা। এরপর তাঁরা ১৪ জুলাই থেকে পূর্ণ কর্মবিরতির কর্মসূচির হুমকি দিলে আগাম ছুটি ঘোষণা করেন উপাচার্য।

No comments

Powered by Blogger.