হেরোইন কারবারে ওরা কোটিপতি by এস এম আজাদ

হেরোইনের নেশা ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছে অনেক জীবন। আশির দশকে দেশে এ মাদকের প্রচলন শুরু হয়। ওই সময় উঠতি বয়সের তরুণদের হাতে নিষিদ্ধ হেরোইন তুলে দিয়ে অল্প দিনে কোটিপতি হয়ে যায় অনেক মাদক ব্যবসায়ী। আগারগাঁও বিএনপি বস্তি, আনন্দবাজার, সুইপার কলোনি, কারওয়ান বাজারসহ আরো কিছু এলাকা হেরোইনের স্পট হিসেবে পরিচিত ছিল।


এসব স্পটে প্রকাশ্য বাণিজ্য এখন কমেছে। তবে শেষ হয়নি।
২০১০ সালের ৯ ডিসেম্বর রনি নামের এক মেয়ে ও তার মা করিমুন্নেসাকে এক কেজি হেরোইনসহ গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। এর কিছুদিন পর রনির স্বামী লিটনকে সৌদি আরব থেকে ফেরার পর বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। এ পরিবারটিই ছিল আগারগাঁওয়ের সবচেয়ে বড় হেরোইন বিক্রেতা। গ্রেপ্তারের পর জানা যায়, মিরপুর ও গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় তাঁদের আছে ছয়টি বাড়ি। করিমুন্নেসা ও রনি জামিনে ছাড়া পেয়ে গা-ঢাকা দিয়েছেন। আগারগাঁও এলাকায় তাঁদের আস্তানাটিও এখন বন্ধ। এবার কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা গেছে আরো কয়েকটি হেরোইন ব্যবসায়ী পরিবারের কাহিনী। ফুটপাত, বস্তি আর গোপন আস্তানায় হেরোইন ব্যবসা করে এরাও এখন কোটিপতি। পুরো পরিবারই জড়িত এ অপকর্মে। মাদকাসক্তিতে নিজের পরিবার বিপন্ন হয়ে গেলেও কেউ ছাড়েনি এ পেশা।
কোটিপতি গুলবাহার : গুলবাহার ওরফে গুলে (৫৫)। নব্বইয়ের দশকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের টাউন হল এলাকায় হেরোইনের কারবার শুরু করেন তিনি। গুলবাহার ও তাঁর স্বামী মীর হোসেন (বর্তমানে মৃত) ছিলেন ওই সময়ের শীর্ষ হেরোইন ব্যবসায়ী। আশির দশকে সুইপার কলোনিতে বাংলা মদ বিক্রি করতেন তাঁরা। একসময়ে মোহাম্মদপুরের সুইপার কলোনিতে থেকে সুইপারের কাজ করে আজ তাঁরা কোটিপতি। আদাবরের পিসি কালচার ১ নম্বর রোডে এখন গুলবাহারের চার কাঠা জমির ওপর ছয় তলা বাড়ি (নম্বর ৩/বি/খ)। দক্ষিণখানে আলেয়া নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজের কাছে আট কাঠা জমির ওপর আছে চার তলা বাড়ি। রূপগঞ্জে আছে অন্তত ২৫ বিঘা জমি।
সূত্রে জানা যায়, একসময় প্রতিমাসে অন্তত তিন কোটি টাকার হেরোইনের চালান পাইকারি বিক্রি করতেন গুল ও তাঁর স্বামী। এখন গুল মাসে দেড় থেকে দুই কোটি টাকার হেরোইন বিক্রি করেন। জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে তাঁদের গ্রামের বাড়ি। মাদক বাণিজ্য শুরু করার পর ১৯৯০ সালে স্বামী মীর হোসেন একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ১৪ বছর কারাভোগ করেন। সালাম নামের এক সহযোগী ছিল গুলের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। গুঞ্জন আছে, সালামকে গুল বিয়েও করেন। কারাগার থেকে বের হয়ে মীর হেরোইনে বুঁদ হয়ে থাকতেন সব সময়। গুল ও মীরের একমাত্র ছেলে মোবারকও জড়িয়ে পড়েন মাদক বাণিজ্যে। ২০০৯ সালে হেরোইন ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধে টঙ্গীতে খুন হন মোবারক। ২০১০ সালে অসুস্থ হয়ে মারা যান মীর হোসেনও। মোবারকের স্ত্রী জেমি এবং গুলের দুই মেয়েও মাদকাসক্ত। ইয়াবায় আসক্ত মোবারকের স্ত্রী জেমি আদাবরের বাড়ি নিয়ে শাশুড়ির সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। ওই বাড়িতে তিনি স্বামীর দু'আনা মালিকানা বুঝে নিতে চান শাশুড়ি গুলের কাছ থেকে। এ নিয়ে মামলাও করেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে এমন অন্ধকার নেমে এলেও মাদক বাণিজ্য ছাড়েনি গুল। ২০১০ সালের দক্ষিণখানে হেরোইনসহ গ্রেপ্তার হলেও কিছুদিন পর জামিনে বের হয়ে আসেন তিনি। সর্বশেষ গত ৯ মে ডিএনসি কর্মকর্তারা গুলকে আদাবরের বাড়ি থেকে ১০০ গ্রাম হেরোইনসহ গ্রেপ্তার করেন। এক সপ্তাহের মধ্যেই আবার জামিনে বের হয়ে আসেন তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গুলের অনেক আত্মীয় মাদক ব্যবসায় জড়িত। গুলের ভাই সফর আলী ও তাঁর স্ত্রী ফুল মেহের চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। ২০০৩ ও ২০০৪ সালে দুইবার গ্রেপ্তার হন তাঁরা। তাঁদের মেয়ে ঝর্ণা ও ঝর্ণার স্বামী রবিজ গাবতলী, নারায়ণগঞ্জ ও রূপগঞ্জে হেরোইন বিক্রি করেন। গুলের অন্য দুই ভাই রবিউল ও সুজা মাদক ব্যবসায়ী। গুলের স্বামী মীরের বোন রাবেয়া ওরফে রাবী এবং রাবীর মেয়ে আমেনা বেগম হেরোইন ব্যবসা করেন। আমেনা তাঁর কথিত স্বামী টিপুকে নিয়ে মাদক ব্যবসা করেন। রাজশাহীর সীমান্ত এলাকা থেকে তাঁরা রাজধানীতে হেরোইনের চালান নিয়ে আসেন। ১০০ গ্রাম হেরোইনসহ আমেনা গ্রেপ্তার হলেও জামিনে বের হয়ে আসেন। আমেনার দক্ষিণখানে ও জয়দেবপুর রেললাইনের পাশে রয়েছে দুটি বাড়ি।
জানা গেছে, গুলের ননদ কালুমাসুর নাতজামাই বিল্লাল এখন তেজগাঁও রেললাইন বস্তির অন্যতম হেরোইন বিক্রেতা। কোটি টাকার হেরোইনের চালান তিনি পান পারিবারিক সিন্ডিকেট থেকেই। নিশীথা নামের এক বান্ধবীকে নিয়ে তিনি তেজকুনিপাড়ায় অভিজাত ফ্ল্যাটে থাকেন। তবে দক্ষিণখানে তাঁর বাড়ি আছে।
গুলবাহার অবশ্য কালের কণ্ঠের কাছে দাবি করেন, তিনি এখন মাদক ব্যবসা করেন না। একসময় তাঁর স্বামী করতেন। আদাবর এলাকায় কারো সঙ্গে তাঁর ব্যাপারে কথা না বলতেও অনুরোধ জানান তিনি। তিনি বলেন, 'এসব কেউ জানে না।' কালের কণ্ঠের কাছে গুলবাহার বলেন, 'আমার স্বামী একটু-আধটু খাইত। বেচত। হেগুলা আমরা অনেক আগেই ছাইড়া দিছি।' এত সম্পদের উৎস কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমরা কষ্ট কইরা করছি। তুমি এত কিছু জানতে চাইও না। পরে আইসো। অনেকেই তো আসে, তোমারে তো দেখি নাই!'
ভ্যানচালক সৈয়দ আলী : সৈয়দ আলী (৫০)। রাজধানীর আনন্দবাজার বস্তি এলাকায় ১০ বছর ধরে বড় হোরোইন বিক্রেতা। তবে এলাকায় তিনি ভ্যানচালক হিসেবেই পরিচিত। স্ত্রী তারা বানুও তাঁর হেরোইন ব্যবসার দোসর। কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা গেছে, সৈয়দ আলী দীর্ঘদিন ধরে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা এলাকায় থাকেন। আনন্দবাজার এলাকায় ভ্যানের গ্যারেজ ও একটি একতলা বাড়ি আছে তাঁর। আর জিঞ্জিরার বাড়িটি পাঁচ তলা ভবন। খিলক্ষেতের বড়ুয়া এলাকায় তিন কাঠা জমির ওপর সৈয়দ আলীর একটি টিনশেড কলোনি বাসা আছে। আনন্দবাজার এলাকায় রিকশাভ্যানের আড়ালে হেরোইন সরবরাহকারী সৈয়দ আলীর ৪০টি রিকশাভ্যান আছে। তাঁর বিরুদ্ধে ২০০৪ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হলেও তিনি কৌশলে মাদক বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছিলেন। গত ১৬ এপ্রিল বঙ্গবাজার এলাকায় ফাঁদ পেতে সৈয়দ আলীকে গ্রেপ্তার করেন ডিএনসি কর্মকর্তারা। সৈয়দ এখন কারাবন্দি থাকলেও তাঁর স্ত্রী চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসা। তারা বানু ২০০৫ সালের জানুয়ারি মাসে একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ভুয়া মেডিক্যাল সার্টিফিকেট তৈরি করে আদালত থেকে জামিনে বের হয়ে আসেন তিনি। আদালতে প্রমাণ দেখান, অভিযানের সময় তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সৈয়দ ও তারার তিন ছেলে ও এক মেয়ে। তাঁরা সবাই মাদক ব্যবসায় জড়িত। জানা গেছে, সপ্তাহে এক বা একাধিক হেরোইনের চালান আনন্দবাজার এলাকা দিয়ে কেরানীগঞ্জে চলে যায়। তাঁদের পক্ষে খুচরা হেরোইনের পুরিয়া বিক্রি করে তিন-চারজন। আনন্দবাজার এলাকায় এক পুরিয়া হেরোইন খুচরা বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়। প্রতি গ্রামে ১০ থেকে ১২টি পুরিয়া তৈরি করে হেরোইন বিক্রেতারা।
ভাতওয়ালীর হেরোইন ব্যবসা : গোলাপী বেগম ওরফে ফালানী ওরফে ভাতওয়ালী (৪৫)। আনন্দবাজার বস্তিতে তিনি ভাতওয়ালী নামেই বেশি পরিচিত। কারণ বস্তির ঘরে ভাত রান্না করে কর্মজীবীদের কাছে বিক্রি করেন তিনি। প্রতিদিন দুপুর ও রাতে টিফিন ক্যারিয়ারে গ্রাহকদের পৌঁছে দেওয়া হয় ভাত। ভাত বিক্রির আড়ালে টিফিন ক্যারিয়ারের মধ্যে হেরোইনের পুরিয়া ঢুকিয়ে খদ্দেরের কাছে পৌঁছানোই তাঁর কারবার। আর এ গোপন কারবারে গোলাপী ও তাঁর স্বামী নাসির হয়েছেন আঙুল ফুলে কলাগাছ। আনন্দবাজার এলাকায় একসময় ভাসমান হয়ে থাকলেও এখন আছে তাঁদের নিজস্ব দোতলা বাড়ি। জানা গেছে, গত ১০ এপ্রিল ডিএনসি কর্মকর্তারা গোলাপীকে ৫০ গ্রাম হেরোইনসহ গ্রেপ্তার করেন। তবে এক সপ্তাহের মধ্যেই জামিনে বের হয়ে আসেন গোলাপী। এরপর তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করে শাহবাগ থানার পুলিশ। বর্তমানে জেলহাজতে আছেন গোলাপী। তবে স্বামী নাসির চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁর কারবার।
জাকিরের পুরিয়া বাণিজ্য : জাকির হোসেন (৪৫) আনন্দবাজার কাঁচাবাজারের পূর্ব পাশের ঘরে হেরোইনের পুরিয়া তৈরির একটি কারখানা চালান তিনি। সেখানে বাহারামসহ কয়েকজন বসে হেরোইনের পুরিয়া তৈরি করে (মাদক ব্যবসায়ীদের ভাষায় 'কাটে')। এ জন্য প্রত্যেকের পারিশ্রমিক দিনে ৫০০ টাকা। ওই ঘরের দুই পাশের দরজা সব সময়ই থাকে খোলা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ গলিতে ঢুকলেই হাওয়া হয়ে যায় কারিগররা। আর হেরোইন ক্রেতারা পুরিয়া নেয় জানালা দিয়ে। গত ১ এপ্রিল জাকির ডিএনসি কর্মকর্তাদের হাতে গ্রেপ্তার হলেও পরে জামিনে ছাড়া পেয়ে যান। তাঁর হেরোইনের চালান আসে গণকটুলী সুইপার কলোনি এলাকার হেরোইন ব্যবসায়ী জমিলার কাছ থেকে।
ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা বিবি সাহারা : বিবি সাহারা ওরফে সায়রা (৪৫)। রাজধানীর এক ভ্রাম্যমাণ হেরোইন বিক্রেতা। হেরোইন বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা আয় করলেও তিনি থাকেন বস্তিতে। রাজধানীর কড়াইল বস্তি তাঁর স্থায়ী ঠিকানা। তবে মিরপুর ৭ নম্বরের চলন্তিকা বস্তিতে তাঁর একটি অস্থায়ী আস্তানা আছে। সায়রার টঙ্গীতে একটি বহুতল ভবন আছে বলেও জানা গেছে। সায়রার নিয়ন্ত্রণে থাকা স্পটগুলো হলো- মিরপুরের বাংলা স্কুলের পাশের স্পট, মিরপুরের বিহারি ক্যাম্প, মিল্লাত ক্যাম্প, ইমরপুর ১০ নম্বর, তেজগাঁও রেললাইন বস্তি ও তেজকুনিপাড়া। তেজগাঁওয়ের খাদিজা ওরফে খুদি, আঙ্গুরী, ইদ্রিস ও তাঁর স্ত্রী সাহারার অন্যতম সহযোগী। গত ২৯ জুন ১০০ গ্রাম হেরোইনের ৬০০ পুরিয়ার একটি চালান নিয়ে অটোরিকশায় তেজগাঁওয়ে যাচ্ছিলেন সায়রা। সিএসডি গোডাউন এলাকায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা তাঁকে গ্রেপ্তার করেন। সায়রার বোন গোলাপী ও গোলাপীর স্বামী মাহাবুবও হেরোইন ব্যবসায় জড়িত।
ডিএনসি সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে কল্পনা, সখিনা ও বিউটি নামের আরো তিন নারী দীর্ঘদিন ধরে হেরোইনের ব্যবসা করে আসছেন। ২০০৯ সালের ২৫ আগস্ট পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের মনির হোসেন লেনের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে ডিএনসি কর্মকর্তারা আড়াই কোটি টাকার হেরোইনসহ গ্রেপ্তার করে সাজেদা আক্তার বেবী ও তাঁর স্বামী আবদুল ওয়াদুদ ওরফে সাধনকে। দুই কেজি ৬০০ গ্রামের ওই হেরোইনের চালানটি গত তিন বছরের মধ্যে রাজধানীতে ডিএনসির হাতে আটক হওয়া সবচেয়ে বড় চালান। গ্রেপ্তারের পর জানা যায়, বেবীও রাজধানীর বড় হেরোইন বিক্রেতা। চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্তের গণি মিয়া নামের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে হেরোইনের চালান আনেন তাঁরা। যাত্রাবাড়ীর ইব্রাহিম, রামপুরার বাবু ও বুলি এ দম্পতির সবচেয়ে বড় পাইকারি ক্রেতা।

No comments

Powered by Blogger.