জিপিএ-৫ প্রাপ্ত কৃতীদের সংবর্ধনা ২০১২-আলোর মিছিল চলতেই থাকবে by আনিসুল হক

এক মাসেরও বেশি সময় আগে শুরু হয়েছিল এই কর্মযজ্ঞ। নরসিংদী, হবিগঞ্জ আর বরিশালে। জুনের প্রথমার্ধে। গতকাল ১৪ জুলাই চন্দ্রার নন্দন পার্কে হলো শেষতম অনুষ্ঠান। মেধাবীদের সংবর্ধনা দেওয়ার অনুষ্ঠান। যে ৮০ হাজারের মতো ছেলেমেয়ে মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো করেছে, তাদের বরণ করে নেওয়ার জন্য


প্রথম আলো ছুটে গেছে ৬৪টি জেলায়, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) সহযোগিতায়, প্রায় ৭০টি আয়োজন নিয়ে। আমি গিয়েছিলাম রংপুর, চট্টগ্রাম আর নন্দন পার্কে।
এখন এই লেখা লিখছি নন্দন পার্কে মঞ্চের পেছনে গ্রিনরুমে বসে, ১৪ জুলাইয়ের দুপুরে। যেন বসে আছি সমুদ্রসৈকতে। মেধাবীদের প্রাণতরঙ্গ এসে আছড়ে পড়ছে সৈকতে, কল্লোল শোনা যাচ্ছে তরঙ্গ গর্জনের মতোই। আমার পাশে বসে আছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট, এভারেস্টজয়ী প্রথম বাংলাদেশি মুসা ইব্রাহীম। মঞ্চে ঘোষণা দিচ্ছেন সুমনা শারমীন। ওই তো এই পাশে সংগীতশিল্পী কনা আর আসিফ। তারানা হালিম, মাহ্ফুজ আনাম, মতিউর রহমান মঞ্চের পাশে বসে আছেন। এইমাত্র এলেন সুলতানা কামাল। (১৩ জুলাই যেমন এসেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, কবরী, মোহাম্মদ কায়কোবাদ) পাইলটকে বললাম, ‘আপনার ওই কথাটা আমি জীবনেও ভুলব না।’ পাইলট আইসিসি ট্রফির ফাইনাল খেলার দিনে সেই ১৯৯৭ সালে প্রার্থনা করেছিলেন, ‘হে সর্বশক্তিমান, আমার প্রিয়তম মানুষটিকে তুলে নেওয়ার বিনিময়ে হলেও আজকের খেলায় জয় দাও।’
বাংলাদেশের মানুষের দেশপ্রেমের কোনো তুলনা হয় না। আমি মাইক্রোফোন হাতে পেয়ে পাইলটের সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সমবেত হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করলাম, তারা কোন দলকে সমর্থন করে। সবাই চিৎকার করে উঠল, বাংলাদেশ। হাজার মেধাবীকণ্ঠে ‘বাংলাদেশ’ শোনার সঙ্গে সঙ্গে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। মুহম্মদ জাফর ইকবাল শিক্ষার্থীদের সামনে এসে প্রায়ই একটা কথা বলেন—মোবাইল ফোনের ব্যাটারি যেমন চার্জ দিতে হয়, মানুষের জীবনেও তেমনি চার্জ লাগে, মুহম্মদ জাফর ইকবাল চার্জ পান তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের সান্নিধ্য থেকে। কৃতী শিক্ষার্থীরা ‘বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ’ বলে চিৎকার করছে, আমি দেখছি প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের দুই হাত আপনাআপনিই উঁচু হয়ে যাচ্ছে। এই মেধাবী মুখ, উজ্জ্বল চোখগুলোর সামনে দাঁড়ালে তাদের কথা শুনলে বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বিষয়ে আবার প্রত্যয়ী হওয়া যায়।
এক মাস আগে রংপুর জিলা স্কুলের মাঠে জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা কৃতীদের সঙ্গে অনেকক্ষণ সময় কাটিয়েছি। তেমনি ওদের কাতারে দাঁড়িয়ে কথা বলেছি চট্টগ্রামের ফয়’স লেকে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। ঢাকায়ও সুযোগ পেলেই কৃতীদের কাছে গেছি, তাদের সঙ্গে গল্প করেছি। জানতে চেয়েছি তারা কে কী হতে চায়। প্রথম আলো ঢাকা অফিস থেকে অনেক সাংবাদিকই সারা দেশে ছুটে গেছেন। একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে সর্বত্রই, গতবার কেন কৃতী শিক্ষার্থী সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়নি? আমরা গত বছরের কৃতীদের কাছে ক্ষমা চাই একটি বছর আয়োজনটি করতে না পারার জন্য। আশা করি, সামনের বছরও আমরা তরুণ মেধাবীদের বরণ করে নেওয়ার সুযোগ নিতে পারব। এরপর আর ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়বে না। এবারের আয়োজনে নিশ্চয়ই ভুলত্রুটি হয়েছে, শিক্ষার্থীরা, অভিভাবকেরা অনেক কষ্ট স্বীকার করেছেন। আমরা সব ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি। কোনো কোনো অভিভাবক পরামর্শ দিয়েছেন অনুষ্ঠানটার চরিত্র কেমন হওয়া উচিত, অনুষ্ঠানের আয়োজন কোথায় হওয়া উচিত, সেসব বিষয়ে। আমরা অবশ্যই চেষ্টা করব আগামীবারের অনুষ্ঠানকে এবারের চেয়েও উন্নত করতে। ভুলত্রুটি থেকে শিক্ষা নিয়েই আমরা এগিয়ে যাব।
ইউসিবি প্রথম আলোর সঙ্গে থেকেছে এবারের কৃতী শিক্ষার্থী সংবর্ধনায়। মাছরাঙা টেলিভিশন তো তিনটা অনুষ্ঠান সরাসরি দেখিয়েছেই। নন্দন পার্ক কর্তৃপক্ষসহ সহযোগী সবাইকে ধন্যবাদ। কৃতী শিক্ষার্থীদের আবারও অভিনন্দন। অভিবাদন বাবা-মা আর অভিভাবকদের। কৃতজ্ঞতা শিক্ষকদের। ধন্যবাদ শিল্পী, বিশিষ্টজন, খেলোয়াড়, প্রথম আলো বন্ধুসভার কর্মীসহ সারা দেশে এই অনুষ্ঠানে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের সবাইকে।
‘যা কিছু ভালো তার সঙ্গে প্রথম আলো’ এই স্লোগান ছিল, আছে, থাকবে। শুধু ভালোর সঙ্গে থাকলে চলবে না, ভালোর দিকে সবাইকে টেনেও নিতে হবে। নিজে বদলে গিয়েও তো বদলে দিতে হবে চারপাশ। তরুণদের কাছে দেশপ্রেমের বার্তা, অধ্যয়ন আর অধ্যাবসায়ের আহ্বান, নেতৃত্বের গুণ অর্জনের পরামর্শ পৌঁছে দেওয়ার একটা উপলক্ষ আসলে এই সংবর্ধনা। সারা দেশে শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, বিশিষ্ট নাগরিকেরা কিশোর-কিশোরীদের কাছে সেই বার্তাই পৌঁছে দিয়েছেন।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের কাছ থেকে শেখা একটা কথা তরুণদের আবারও স্মরণ করিয়ে দিই। সক্রেটিসকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, সর্বোচ্চ দেশপ্রেম হলো সর্বোত্তমভাবে নিজের কাজটুকু করা। শিক্ষার্থীদের অবশ্যই লেখাপড়া মন দিয়ে করতে হবে। পরীক্ষার ফল ভালো করতে হবে। এটাই হবে প্রকৃত দেশপ্রেমিকের কাজ। পাশাপাশি একটা কথা। বিশ্বখ্যাত প্রকৌশলী, যাকে বলা হয় স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আইনস্টাইন, সেই ফজলুর রহমান খানের একটা উক্তি ধাতব অক্ষরে তাঁর নির্মিত সুউচ্চ ভবন সিয়ার্স টাওয়ারের নিচে খোদিত আছে, ‘একজন প্রযুক্তিবিদের তাঁর নিজের প্রযুক্তির ভেতরে হারিয়ে যাওয়া উচিত নয়। তাঁকে অবশ্যই জীবনকে উপভোগ করতে পারতে হবে। আর জীবন হলো সংগীত, নাটক, শিল্প ও সর্বোপরি মানুষ।’
আমাদের শিক্ষার্থীদের অবশ্যই মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রস্তুত হতে হবে।
আমাদের কৃতী শিক্ষার্থীরা আলোয় আলোয় ভরে তুলুক আকাশ, নিজস্ব আকাশ ও সম্মিলিত আকাশ।
আলোর এই মিছিল চলতেই থাকুক।
দোয়া প্রার্থনা: আরেকটি কথা। কাল জিপিএ-৫ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় নটর ডেম কলেজের ছাত্র আশিকুর রহমান খান চৌধুরী দুর্ঘটনার শিকার হয়। বর্তমানে সে ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
মেধাবী এই তরুণের আরোগ্য কামনা করি কায়মনোবাক্যে। তার বাবা ডা. মাহফুজুর রহমান খান চৌধুরী ছেলের সুস্থতার জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.