মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের ঘোষণা-ইতিহাস অস্বীকার করার শামিল

বাংলাদেশ যখন তিন দশক ধরে এ দেশে আসা প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখন মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের ঘোষণা আমাদের নিদারুণ হতাশ করেছে।


তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন অথবা জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার বা ইউএনএইচসিআরের আশ্রয় শিবিরে পাঠানোই রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান। গত বৃহস্পতিবার ইউএনএইচসিআরের প্রধান অ্যান্টনিও গার্টারের কাছে তিনি এ মন্তব্য করেছেন বলে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়। তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এটাকে মিয়ানমার সরকারের বক্তব্য হিসেবে বিবেচনা করছে না বলে জানা গেছে। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের এ বক্তব্য যদি সত্য হয়, তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি, মিয়ানমার বাংলাদেশ থেকে আর কোনো রোহিঙ্গাকে ফেরত নেবে না। তাহলে দারিদ্র্যপীড়িত ও নানা সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশ কি পারবে অনন্তকাল ধরে এই চার লাখ রোহিঙ্গার বোঝা বহন করতে? তদুপরি নানা কৌশলে প্রতিদিনই রোহিঙ্গারা এ দেশে অনুপ্রবেশ করছে। ইউএনএইচসিআরসহ কিছু পশ্চিমা দেশ রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দিতে বলছে। আমরা কি পারব আরাকানের সব রোহিঙ্গাকে এ দেশে ধারণ করতে?
অর্ধশতাব্দী ধরে মিয়ানমারের ক্ষমতায় থাকা সামরিক জান্তাই মূলত এ সমস্যাটি তৈরি করেছে। নতুন নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। তারা রোহিঙ্গা জনগণের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে এবং তাদের সম্পত্তি কেড়ে নিয়েছে। ফলে সে দেশে রোহিঙ্গাদের মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে তারা যেমন এ দেশে আশ্রয়ের জন্য ছুটে আসছে, তেমনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থাইল্যান্ড বা অন্যান্য দেশেও পাড়ি জমাচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে তাদের নাগরিকত্ব ও মানবাধিকার নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ প্রায় নেই বললেই চলে। অথচ প্রাপ্ত তথ্যপ্রমাণে দেখা যায়, অষ্টম শতাব্দীতে আরব, আফগানিস্তান ও তৎসংলগ্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা প্রথম আরাকানে বসতি গাড়ে। রোহিঙ্গা নাম নিয়েও নানা মত আছে। কারো মতে, আরবি 'রহম' শব্দ থেকে রোহাং ও পরে রোহিঙ্গা নামের উৎপত্তি। আবার কারো মতে, আফগানিস্তানের রুহা অঞ্চলের অধিবাসীদের নামানুসারে রোহিঙ্গা নামের উৎপত্তি। কারো মতে, প্রাচীন আরাকান রাজ ম্রোহাংয়ের নামানুসারে রোহাঙ ও রোহিঙ্গা নামের উৎপত্তি। কাজেই বর্তমান শাসকরা রোহিঙ্গাদের বাঙালি বলে চালিয়ে দেওয়ার যে চেষ্টা করছেন, তা অবান্তর। আর বংশানুক্রমে শত শত বছর ধরে সেখানে যারা বসবাস করছে, তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করার কী যৌক্তিকতা আছে। ড. ফ্রান্সিস বুকানন ১৭৯৯ সালে বার্মার প্রধান তিনটি ভাষার একটি হিসেবে রোহিঙ্গার নাম উল্লেখ করে বলেন, আরাকানে তারা দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছে। অথচ বাংলাদেশে মাত্র দুই-তিন শ বছর ধরে বসবাসকারী অনেক উপজাতি আছে, যাদের নাগরিকত্ব নিয়ে আমরা কখনো কোনো প্রশ্ন তুলিনি। কাজেই মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস নিয়ে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশ যেহেতু মিয়ানমারের এ পদক্ষেপের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাই বিষয়টি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তোলা এবং এর একটি ন্যায়সংগত সমাধান দাবি করা উচিত। গত সপ্তাহে কম্বোডিয়ায় অনুষ্ঠিত আসিয়ান দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা আসিয়ান দেশগুলোরও সহযোগিতা চাইতে পারি।

No comments

Powered by Blogger.