সোয়া দুই কোটি শিশুকে ফেলা হচ্ছে ঝুঁকির মুখে! by তৌফিক মারুফ

দফায় দফায় চিঠি দিয়ে যোগ্যতা না থাকার কথা জানালেও শেষ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানটিকেই কাজ দিতে বলেছে বিশ্বব্যাংক। আর সেই আদেশ শিরোধার্য করে বিধি ভেঙে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ভারতীয় অখ্যাত কম্পানিকেই ১০ কোটি পিস ভিটামিন 'এ' ক্যাপসুল সরবরাহের কার্যাদেশ দিয়েছে। এ ঘটনায় উচ্চ আদালত সরকারের প্রতি রুল জারি করেছেন।
আদালত সিনিয়র স্বাস্থ্যসচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ আটজনকে দুই সপ্তাহের মধ্যে এ সম্পর্কে জবাব দিতে বলেছেন। একই ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে শুরু হয়েছে তোলপাড়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সরকারি দলের প্রভাবশালী একটি মহলের তদবিরের মুখে এ অনিয়মের দায় এখন তাদের ঘাড়ে চাপছে। একই ধরনের তৎপরতার মুখে বিশ্বব্যাংকও নিজেদের কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসেছে, যা বিস্মিত করেছে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের। পাশাপাশি দেশের দুই কোটি ২০ লাখ শিশুকে এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে ঝুঁকির মুখে। ওই সূত্রে জানা যায়, ভারতীয় কম্পানিটি দরপত্রের সঙ্গে তাদের যোগ্যতার গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণাদি দিতে পারেনি। ফলে তাদের ওষুধ কতটা মানসম্পন্ন হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
গতকাল শনিবার বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ দপ্তরের কর্মকর্তা বুশরা বিনতে আলমের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কোনো কথা বলা সম্ভব নয়।
আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. বদিউজ্জামান ভুঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ ধরনের কোনো ঘটনায় দলের কেউ জড়িত আছেন কি না তা জানি না। এমনকি এ ঘটনাও আমার জানা নেই। এ ছাড়া দলের নাম ভাঙিয়ে কারো পক্ষ থেকেই এমন কোনো তৎপরতা চালানো উচিত নয়।' তিনি বলেন, ওষুধ এমন একটি পণ্য, যার মান নিয়ে কোনো ধরনের অনিয়ম বা কম্প্রোমাইজ করা যাবে না।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি কমানো এবং অপুষ্টিজনিত অন্ধত্ব প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ থেকে দেশের দুই কোটি ২০ লাখ শিশুকে বছরে দুইবার ভিটামিন 'এ' ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। বিশ্বব্যাংকের টাকায় সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বিদেশ থেকে এই ক্যাপসুল সংগ্রহের ব্যবস্থা করে। সত্তরের দশক থেকে সরকার প্রথমে ইউনিসেফের মাধ্যমে এবং পরে নিজস্ব উদ্যোগে কানাডার একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এই ক্যাপসুল সংগ্রহ করে। এবারই প্রথম ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠানকে ওষুধ সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আর ভারতীয় ওই প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশ এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সরকারি দলের প্রভাবশালী এক ব্যক্তি জড়িত।
ভিটামিন 'এ' ক্যাপসুল কেনার টেন্ডার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নকারী সংস্থা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোরেজ ডিপার্টমেন্টের (সিএমএসডি) পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান কবীর খান কালের কণ্ঠকে বলেন, "২০১১-১২ অর্থবছরে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত উন্নয়ন কর্মসূচির (এইচপিএনএসডিপি) আওতায় দুই ধরনের মোট ১০ কোটি পিস ভিটামিন 'এ' ক্যাপসুল কেনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য এই দপ্তরের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছি। এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি। তবে কার্যাদেশ পাওয়া প্রতিষ্ঠানটির যোগ্যতার আরো কিছু কাগজপত্র চেয়েছিল টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটি। সেই কাজপত্র পরে জমা দেওয়ার ফলে বিশ্বব্যাংক ওই প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়ার বিষয়টি অনুমোদন করে।"
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, টেন্ডার প্রক্রিয়ার জন্য গত বছরের ১২ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্র জমা দেওয়ার ডেটলাইন ছিল এ বছরের ৭ ফেব্রয়ারি। এরপর যাচাই-বাছাই শেষে ভারতীয় মেসার্স অলিভ হেলথ কেয়ার নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়ার জন্য প্রাথমিকভাবে মনোনীত করে প্রস্তাব পাঠানো হয় বিশ্বব্যাংকের কাছে। অলিভ হেলথ কেয়ারের পক্ষে বাংলাদেশে কাজ করে মেসার্স জনতা টেড্রাস নামের একটি প্রতিষ্ঠান। মেসার্স অলিভ হেলথ কেয়ারকে মনোনীত করার প্রক্রিয়ায় নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে প্রতিদ্বন্দ্বী কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান ব্যানার ফার্মা করপোরেশনের বাংলাদেশের এজেন্ট এসএস সায়েন্টিফিক করপোরেশন বিশ্বব্যাংকের কাছে অভিযোগ করে। এর ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক প্রয়োজনীয় কাজপত্র পরীক্ষা করে দেখতে পায়, এ কাজের জন্য যেসব যোগ্যতার প্রমাণপত্র জমা দেওয়া দরকার এর সব অলিভ হেলথ কেয়ারের পক্ষ থেকে জমা দেওয়া হয়নি। এমনকি অবশ্য পালনীয় পূর্ণাঙ্গ কার্য-অভিজ্ঞতা ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার জিএমপি সার্টিফিকেটও ওই প্রতিষ্ঠানটি জমা দেয়নি। বিষয়টি তুলে ধরে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ অফিস গত ৩১ মে সিএমএসডির পরিচালক বরাবর আপত্তি জানিয়ে চিঠি পাঠায়। পরে নাইজেরিয়ায় ভিটামিন 'এ' ক্যাপসুল সরবরাহের অভিজ্ঞতার প্রমাণপত্র এবং দরপত্র দাখিলের প্রায় ছয় মাস পরের তারিখে (৭ জুলাই ২০১২) ইস্যু করা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার জিএমপি সার্টিফিকেট জমা দেয় অলিভ হেলথ কেয়ার। কিন্তু বিষয়টি যথাযথ না হওয়ার কথা বলে বিশ্বব্যাংক ১৮ জুন ও ২৫ জুন পৃথক চিঠি দেয় সিএমএসডিকে। তবে ২৮ জুন দেওয়া চিঠিতে বিশ্বব্যাংক রহস্যজনকভাবেই তাদের অবস্থান পাল্টে ফেলে ভারতীয় অলিভ হেলথ কেয়ারকে কার্যাদেশ দেওয়ার জন্য সিএমএসডির কাছে সুপারিশ করে। আর সিএমএসডি ঠিক ওই দিনই (২৮ জুন) জরুরি ভিত্তিতে ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কার্যাদেশ দেয়। কার্যাদেশ অনুসারে প্রতিষ্ঠানটি ১৫ কোটি ৫৭ লাখ ১৮ হাজার টাকায় দুই ধরনের মোট ১০ কোটি পিস ভিটামিন 'এ' ক্যাপসুল সরবরাহ করবে সরকারকে।
এই কার্যাদেশকে অবৈধ দাবি করে কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট এসএস সায়েন্টিফিক করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী ফয়েজ আহম্মেদ গত ১১ জুলাই হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দেন। এর ভিত্তিতে কেন ওই কার্যাদেশকে অবৈধ ঘোষণা করা বা আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না- এ মর্মে সরকারের প্রতি রুলনিশি জারি করেন বিচারপতি এম মোয়াজ্জেম হোসেন ও বিচারপতি মো. হাবিবুল গণির যৌথ বেঞ্চ। আদালত দুই সপ্তাহের মধ্যে সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেরর অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন), সিএমএসডির পরিচালক ও ভারতীয় প্রতিষ্ঠান অলিভ হেলথ কেয়ারের লোকাল এজেন্ট জনতা ট্রেডার্সকে কারণ দর্শাতে বলেছেন।
তবে টেন্ডার বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিএমএসডির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান কবীর খান গতকাল পর্যন্ত আদালতের রুলনিশি সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে কালের কণ্ঠকে জানান।

No comments

Powered by Blogger.