যা খুশি তা-ই চলছে অগ্রণী ব্যাংকে by আবুল কাশেম

প্রতিষ্ঠানের কোনো সাইনবোর্ড নেই, নেই কোনো অস্তিত্ব বা ঠিকানাও। ঋণের আবেদনে গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের কোনো নামও নেই। শুধু অফিশিয়াল ঠিকানা হিসেবে মতিঝিলের 'সেনাকল্যাণ ভবন' উল্লেখ আছে। অস্তিত্বহীন এ প্রতিষ্ঠানটিও অগ্রণী ব্যাংক থেকে ঋণ পেয়েছে ছয় কোটি টাকারও বেশি।


আরেকটি প্রতিষ্ঠান। তারও কোনো ট্রেড লাইসেন্স নেই। জামানত হিসেবে প্রথমে ভুয়া দলিল দাখিলের পর বিকল্প জামানতের ক্ষেত্রে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ জমিকে দেখানো হয় ৯৭৩ শতাংশ। এত সব জালিয়াতি করে অগ্রণী ব্যাংকে ঋণের জন্য আবেদন করে মেসার্স রোকো এন্টারপ্রাইজ। ঋণ আবেদনে চার্জ ডকুমেন্টসও ফাঁকা। তবু এ প্রতিষ্ঠানটিকে দ্রুততার সঙ্গে ৩৬ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। আবার মাত্র দুই বছরে একই ব্যক্তিকে ১৩১টি ঋণ দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে এখানে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের করা এ ধরনের বেশ কিছু অনিয়মের ঘটনা উঠে এসেছে। এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত অগ্রণী ব্যাংকের শাখা পর্যায়ের বেশ কিছু কর্মকর্তার সম্পৃক্ততাও খুঁজে পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিবেদনে এসব অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ত বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরসহ বিভিন্ন শাস্তির জন্য অগ্রণী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবদুল হামিদ গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংকের এই প্রতিবেদনের কথা আমি শুনেছি। তবে এখনো তা পড়িনি। তাই এসব অভিযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারছি না। তবে ট্রেড লাইসেন্স নেই এমন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। হয়তো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন দলকে তাৎক্ষণিকভাবে শাখা ব্যবস্থাপক ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স দেখাতে পারেননি। তিনি বলেন, প্রতিবেদনটি বিস্তারিত পর্যালোচনা করার পর এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, সাইনবোর্ড ছাড়া কিছুই নেই এমন একটি প্রতিষ্ঠানকেও ৪৪ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছেন এই ব্যাংকের কর্মকর্তারা। পুরান ঢাকার মিতু এন্টারপ্রাইজ নামের একটি অস্তিত্বহীন ও ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে ১৩১টি ঋণের মাধ্যমে আড়াই কোটি টাকারও বেশি ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি। একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তিকে একই ধরনের আসবাবপত্র কেনার জন্যও ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি। একই শাখায়, একই ব্যক্তি দুই নামে হিসাব খুলে অর্থ স্থানান্তর করছেন কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই। এমনকি ব্যাংকের কর্মকর্তারাও নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে ঋণ নিয়েছেন নিজের শাখা থেকেই, ঋণ দিয়েছেন স্ত্রীকেও। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করে ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) রিপোর্ট ছাড়াই ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকটির কোনো কোনো শাখা।
ফজলুর রহমান অ্যান্ড কোং (প্রাঃ) লি. নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ছয় কোটি ২৮ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটির প্রধান শাখা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল অগ্রণী ব্যাংকের এই ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানে নিজেদের পরিদর্শনকালীন অভিজ্ঞতা প্রতিবেদনে তুলে ধরেছেন এভাবে- 'পরিদর্শনের শুরুতেই পরিদর্শক দলকে একটি অফিস রুমে (স্থানীয়ভাবে গদিঘর নামে পরিচিত) বসিয়ে বলা হয়, এটাই গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের অফিস। তবে পরিদর্শক দলের মনে হয় এটা আসলে রহমান স্পিনিং মিলের অফিস। এরপর ওই অবস্থান থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে অন্য একটি পুরনো ভাঙাচোরা দোকানে গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা সাইনবোর্ড পাওয়া যায়। ওই দোকান খুলে দেখা যায় কিছু সুতা রাখা আছে। ওই সুতাও রহমান স্পিনিং মিলের হতে পারে। কারণ সেখানে ফজলুর রহমান অ্যান্ড কোং (প্রাঃ) লিমিটেডের কোনো নথিপত্র পাওয়া যায়নি। এমনকি ব্যাংকের যে শাখা থেকে ঋণ দেওয়া হয়েছে ওই শাখার কোনো কর্মকর্তাও ওই প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান জানাতে পারেনি।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ট্রেড লাইসেন্সবিহীন মেসার্স রোকো এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকেও ৩৬ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটি ২০১০ সালের ১৮ আগস্ট ঋণের জন্য আবেদন করে ওই বছরের ৯ সেপ্টেম্বরই ঋণ পেয়ে পায়। আবেদনে প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে বন্ধকি সম্পত্তির প্রমাণ হিসেবে গাজীপুরে কিছু জমির দলিল দেয়। তবে সেখানকার এসিল্যান্ড ও সাব রেজিস্ট্রি অফিসে সরেজমিন তদন্ত করে জমা দেওয়া দলিল জাল বলে প্রমাণিত হয়েছে। পরে ঋণগ্রহীতা চট্টগ্রামের পাঠানটুলি মৌজায় ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ জমিকে ৯৭৩ শতাংশ দেখিয়ে ঋণ নেয়। এ ঋণের চার্জ ডকুমেন্টস ফাঁকা রাখা রয়েছে। এছাড়া বন্ধকি দলিল বা তার কোনো ফটোকপিও ঋণদাতা শাখায় নেই।
অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় মেসার্স জুলিয়া সুয়েটার কম্পোজিট নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে ৪৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। ২০০৪ সালে এ ঋণ দেওয়া হলেও ঋণের প্রথম কিস্তি নির্ধারণ করা হয় ২০১০ সালের জুন মাসে। এই প্রতিষ্ঠানটিতে সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে সাইনবোর্ড ছাড়া আর কিছুই পায়নি পরিদর্শক দল। অগ্রণী ব্যাংকের অন্য গ্রাহক মেসার্স এম আর সুয়েটার কম্পোজিটের বিল্ডিংয়ের এক পাশে জুলিয়া সুয়েটার কম্পোজিটের শুধু একটি সাইনবোর্ড পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই গ্রাহকের কাছ থেকে ঋণ আদায়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়াসহ প্রয়োজনে গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা করতে অগ্রণী ব্যাংককে পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অগ্রণী ব্যাংকের ঢাকার এলিফ্যান্ট রোড শাখায় ভোগ্যঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিয়ম পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ মো. আকরামুজ্জামান এ শাখায় ব্যবস্থাপক হিসেবে ২০০৯ সালের ১ মার্চ, আর দ্বিতীয় কর্মকর্তা হিসেবে সিনিয়র অফিসার দুলাল চন্দ্র ঘোষ যোগ দেন ২০০৬ সালের ১৪ মে। মো. আকরামুজ্জামান শাখা ব্যবস্থাপক থাকাকালে ২০০৯ সালের ১ মার্চ থেকে ২০১১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত দুই বছরে মোট ৭৭৫টি ঋণ মঞ্জুরি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৭৭৩টি ঋণ শাখা ব্যবস্থাপক নিজ ক্ষমতায় মঞ্জুর ও বিতরণ করেছেন। এসব ঋণ মূলত ভোগ্যপণ্য ঋণ। এসব ঋণগ্রহীতার অনেকেরই এখন হদিস নেই।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'এ শাখার ২২৩/১০ নম্বর ঋণগ্রহীতা মো. সোহেল রানার ঠিকানা নিউ মার্কেট, ঢাকা উল্লেখ করা হয়েছে। এ রকম ঠিকানায় কাউকে শনাক্ত করা দুঃসাধ্য হওয়া সত্ত্বেও ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। আবার ২২৬/১০ নম্বর ঋণগ্রহীতা আহসান খান সজীবের ঠিকানা মতিঝিল, খিলগাঁও, ঢাকা উল্লেখ করা হয়েছে। আবেদনপত্রে এ রকম ঠিকানা উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। শাখার দ্বিতীয় কর্মকর্তা দুলাল চন্দ্র ঘোষ, পিতা হীরালাল ঘোষ ব্যাংকের পরিচয় গোপন করে আবেদনপত্র জমা দিয়ে ২৭১/১০ নম্বর ঋণের মাধ্যমে তিন লাখ টাকা গ্রহণ করেছেন। একই সঙ্গে তাঁর স্ত্রী নীপা ঘোষের নামে ৩৪২/১০ নম্বর ঋণ হিসাবের মাধ্যমে তিন লাখ টাকার ঋণ সুবিধা নিয়েছেন।'
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ ঋণের মঞ্জুরিপত্রেই গ্রাহকের ঠিকানা নেই। আবার একই পরিবারের একাধিক সদস্যকেও ঋণ দেওয়া হয়েছে। ২১, পুরানা, মোঘলটুলী, ঢাকার ঠিকানায় মিতু এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ভুয়া ও অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানকেও ঋণ দেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'ভোগ্যঋণ নীতিমালায় গ্রুপের অস্তিত্ব না থাকা সত্ত্বেও শেখ মো. আকরামুজ্জামান ও দুলাল চন্দ্র ঘোষ নিজস্ব সিদ্ধান্তবলে ৪৪৩ জনকে ১৯টি গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত করে ঋণ বিতরণ করেছেন। এর মধ্যে একজনকেই ১৩১টি ঋণের বিপরীতে দুই কোটি ৬২ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।'
এলিফ্যান্ট রোড শাখায় বাদশা নামে একজন এক কোটি টাকা ঋণের জন্য আবেদন করে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৫০ লাখ টাকা ঋণ মঞ্জুর করে। ওই ৫০ লাখ টাকা ঋণ দেওয়ার পরও আকরামুজ্জামান ও দুলাল চন্দ্র ঘোষ অনিয়মের মাধ্যমে স্বনামে-বেনামে বাদশাকে আরো দুই কোটি ৯৯ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছেন। বহুমাত্রিক অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ত শেখ মো. আকরামুজ্জামান ও দুলাল চন্দ্র ঘোষকে শাখা থেকে অপাসরণ করে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে অগ্রণী ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অগ্রণী ব্যাংকের কুমিল্লার মনোহরপুর শাখায় ২০০৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর মঞ্জুর আলম নামে এক ব্যক্তি একটি সঞ্চয়ী হিসাব (নম্বর-১৭৩২৮) হিসাব খোলেন। ২০১০ সালের ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই হিসাবে স্থিতি দাঁড়ায় ৬৩ লাখ ছয় হাজার টাকা। একই শাখায় এ কে এম আফতাব উদ্দিন আহমেদের একটি মেয়াদি আমানত (এফডিআর) হিসাব (নম্বর-০১৩৬৬৩৫/৪১৪৩) খোলা হয় ২০১১ সালের ৬ এপ্রিল। পরে মঞ্জুর আলমের হিসাব থেকে আফতাব উদ্দিন আহমেদের হিসাবে ৬০ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে দেখা গেছে, মঞ্জুর আলম ও আফতাব উদ্দিন আসলে একই ব্যক্তি। ২০১১ সালের ২১ আগস্ট থেকে ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আফতাব উদ্দিন ৯৬ লাখ টাকা নগদ জমা করলেও এ ব্যাপারে ট্রানজেকশন প্রোফাইল মনিটর করা হয়নি।
আবার অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেদের প্রাপ্যতার চেয়েও এক কোটি ৫৮ লাখ টাকা বেশি উৎসাহ বোনাস ভোগ করেছেন বলে প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অতিরিক্ত বোনাস নেওয়া অর্থ ফেরত দিতে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

No comments

Powered by Blogger.