তত্ত্বাবধায়কের আমলে নেওয়া টাকা ফেরত পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা!

আলোচিত এক-এগারো পরবর্তী সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অনেকটা অন্যায়ভাবে নেওয়া এক হাজার ২৩২ কোটি টাকার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেই। ঘটনার পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও টাকা ফেরত দেওয়া অথবা না দেওয়ার বিষয়ে কোনো সুরাহা হয়নি।


তবে একটি বিশ্বস্ত সূত্র বলছে, সরকারের কোষাগারে জমাকৃত ওই অর্থ ব্যবসায়ীরা আর ফেরত পাচ্ছেন না।
জোর করে আদায় করা ওই অর্থ ফেরত পেতে হাইকোর্টে রিট করেন দুজন ব্যবসায়ী। হাইকোর্ট তাঁদের পক্ষে রায় দেন। সরকারের নির্দেশে বাংলাদেশ ব্যাংক এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল ঠুকে দিয়েছে। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত করে দিয়েছেন। ফলে পুরো বিষয়টি অনিশ্চয়তার মধ্যে ঝুলে আছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রিটকারীদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবদুল বাসেত মজুমদার বাংলানিউজকে জানান, হাইকোর্টের রায়কে স্থগিত করে আপিল বিভাগ আদেশ দিয়েছেন। ফলে বিষয়টি এখানে ঝুলে আছে। আবার নতুন করে উদ্যোগ না নিলে এর কোনো সুরাহা হবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, 'এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের হয়ে শুধু হিসাব পরিচালনা করে। সরকার যেভাবে চায় সেভাবে হিসাবটি চলে। সরকার কাকে দেবে না দেবে, সে সিদ্ধান্ত কেবল সরকারই নিতে পারে। সরকার চাইলে আমরা টাকা ফেরত দেব।'
ওই কর্মকর্তা আরো জানান, সরকার ব্যবসায়ীদের জব্দকৃত অর্থ বাজেটে নিয়ে নিয়েছে। এটি বসে নেই। সুতরাং এ অর্থ বের করতে হলে বাজেট থেকেই বের করতে হবে। তাই সরকার সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী আপিলও করেছে। এখন সর্বোচ্চ আদালত ব্যবসায়ীদের অর্থ ফেরত দিতে হাইকোর্টের রায় বলবৎ রাখলে সরকার সে টাকা ফেরত দিতে বাধ্য। ব্যবসায়ীদের মধ্যে যাঁরা তাঁদের অর্থ ফেরত চান, তাঁদের আদালতের রায় নিয়েই আসতে হবে।
প্রসঙ্গত, গত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের এপ্রিল থেকে ২০০৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত জরুরি অবস্থার সময়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা প্রায় ৪০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এক হাজার ২৩২ কোটি টাকা আদায় করেন। এই টাকা দুই শতাধিক পে-অর্ডারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের ০৯০০ নম্বর হিসাবে জমা হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়ে নানা ধরনের আলোচনা হয়।
সূত্র বলছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের শুরুর দিকে সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ প্রয়োজনে আইন করে টাকা ফেরত দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। পুরো বিষয়টি ঝুলে আছে।
তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারের নীতিনির্ধারকদের পরামর্শে দুই ব্যবসায়ী তাঁদের টাকা ফেরত চেয়ে আদালতে মামলা করেন। সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ওই দুই ব্যবসায়ীকে ২৯৭ কোটি টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য ওই বছরের ২৪ আগস্ট রায় দেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এর বিরুদ্ধে আপিল করে।
অর্থমন্ত্রীও একবার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সরকারের হিসাবে টাকা জমা পড়লে তা ফেরত দেওয়া কঠিন। সরকারের কোষাগারে জমা হওয়া টাকা ফেরত দেওয়া যায় না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের কাছ থেকে কয়েক দফায় প্রায় আড়াই শ কোটি টাকা আদায় করা হয় ওই সময়। প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে অন্যদের মতো অন্যায়ভাবে এই অর্থ 'ছিনতাই' করে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বসুন্ধরা গ্রুপের নামে প্রথমে ৭৭ কোটি টাকা ৯টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ২০০৭ সালের ২৮ মে সরকারের হিসাবে জমা পড়ে। এরপর একই বছরের ২৮ অক্টোবর বসুন্ধরা গ্রুপের কাছ থেকে ১০০ কোটি টাকা আদায় করা হয়। ২০০৮ সালের ২৩ এপ্রিল এবং ১১ জুন বসুন্ধরা গ্রুপের কাছ থেকে যথাক্রমে ৭৩ কোটি ও তিন কোটি টাকা নেওয়া হয়। বসুন্ধরা গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টি ডেভেলপমেন্টের নামেও বাংলাদেশ ব্যাংকে তিন কোটি টাকা জমা হয়। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পরিচয় ছাড়াও একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা চার দফায় ৪৭ কোটি টাকা জমা নেন।
২০০৭ সালের ১৯ এপ্রিল জেমস ফিনলের কাছ থেকে আদায় করা ১১৭ কোটি ৪১ লাখ টাকার ১৬টি পে-অর্ডার বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের কনসোলিডেটেড ফান্ডের ওই হিসাব নম্বরে প্রথম জমা দেওয়া হয়। এরপর ২২ এপ্রিলে একই প্রতিষ্ঠানের নামে ১৫টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে আরো ১২০ কোটি ২৪ লাখ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হয়। একইভাবে দেড় বছর ধরে বিভিন্ন তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের সংশ্লিষ্ট হিসাবে টাকা জমা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আরো যেসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চাপের মুখে জোর করে টাকা আদায় করা হয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের ১৯ কোটি ৪৫ লাখ, এবি ব্যাংকের ১৯০ কোটি, এবি ব্যাংক ফাউন্ডেশনের ৩২ কোটি, আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশনের ৩২ কোটি ৫০ লাখ, যমুনা গ্রুপের ৩০ কোটি, এমজিএইচ গ্রুপের ২৪ কোটি, এলিট পেইন্টের ২৫ কোটি ৪৪ লাখ, কবির স্টিল মিলসের সাত কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৩৯ কোটি, কনকর্ড রিয়েল এস্টেটের কাছ থেকে সাত কোটি, কনকর্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আট কোটি, স্বদেশ প্রপার্টিজের ৯ কোটি, পিংক সিটির ছয় কোটি ৪১ লাখ, আশিয়ান সিটির এক কোটি, সাগুফতা হাউজিংয়ের দুই কোটি ৫০ লাখ, হোসাফ গ্রুপের ১৫ কোটি, পারটেঙ্ গ্রুপের ১৫ কোটি এবং ইসলাম গ্রুপের কাছ থেকে ৩৫ কোটি টাকা ভয়-ভীতি ও চাপের মুখে আদায় করা হয়।
যেসব ব্যবসায়ী ও ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়েছে :
ব্যবসায়ী আবদুল আউয়াল মিন্টুর কাছ থেকে দুই কোটি ২০ লাখ, ব্যবসায়ী নূর আলীর কাছ থেকে ৪০ কোটি, ব্যবসায়ী রেজাউল করিমের কাছ থেকে ১৭ কোটি, আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে ১৪ কোটি, শওকত আলী চৌধুরীর কাছ থেকে ছয় কোটি, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের কাছ থেকে ১৫ কোটি, বিএনপির সাবেক এমপি সালিমুল হক কামালের কাছ থেকে ২০ কোটি, ওয়াকিল আহমেদের কাছ থেকে ১৬ কোটি, তারেক রহমানের বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের কাছ থেকে ২০ কোটি ৪১ লাখ, ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান পরিচালক পারভীন হক সিকদারের কাছ থেকে তিন কোটি টাকা আদায় করা হয়। এর বাইরে আরো কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিভিন্ন পরিমাণে অর্থ আদায় করা হয়েছিল।
গণতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যবসায়ীরা এই টাকা ফেরত পাবেন- এমনটিই আশা করেছিলেন। অথচ সরকারের সাড়ে তিন বছর চলে গেলেও কোনো সরকার এর কোনো সুরাহা করেনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভুক্তভোগী একাধিক ব্যবসায়ী বাংলানিউজকে বলেন, 'বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমরা আশা করেছিলাম তারা হয়তো সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই অনৈতিক কাজের একটি ফয়সালা করবে। কিন্তু সাড়ে তিন বছর চলে গেল, কিছুই হলো না। এতে আমরা ব্যবসায়ীরা অনেকটা হতাশ।'
আগামী নির্বাচনে সরকারের এই আচরণের প্রভাব পড়বে বলেও মত দেন তাঁরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী বাংলানিউজকে জানান, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনেক কাজকে স্বীকৃতি দেয়নি। আবার আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারই অবৈধ হয়ে গেছে। তাই সরকারের উচিত হবে, ব্যবসায়ীদের দিকে তাকিয়ে এর একটি সুন্দর সুরাহা করা।

No comments

Powered by Blogger.