বর্মায় যা হচ্ছে, বাংলাদেশকে যা করতে হবে by খোমেনী ইহসান

ব্যাপারটা অত্যন্ত পষ্ট। বর্মা, হালের সামরিক শাসকদের রাখা নামে মিয়ানমার, এই সামরিক শাসকশ্রেণীর’ই একটি গোষ্ঠি দেশটির বর্তমান কথিত ‘গণতন্ত্রকামী’ রাজনৈতিক গোষ্ঠি, এরা সবাই মিলেই রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীনে রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠিগুলোর ওপর যেমন বৌদ্ধ ধর্মালম্বী কারেন, কাচিন, শান এবং ইসলাম ধর্মালম্বী বার্মিজ মুসলমান ও চীনা মুসলমানদের (যারা রোহিঙ্গা নয়) ওপর জাতিগত নিধন অভিযান চালাচ্ছে (যারে ইংরেজি জবানে বলে এথনিক ক্লিনজিং)।

সর্বশেষ এই সহিংসতায় যে রাষ্ট্র বর্মা সরাসরি জড়িত, তা স্থানীয় সূত্রের বরাতে বার্তা২৪ ডটনেটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আমরা দেখেছি। কিন্তু এই নানা জাতির জান-মালের ওপর হামলে পড়ারও অনেক আগে নিধন অভিযানের শুরু হয়েছিল নাম ও নিশানা মুছে ফেলার মধ্য দিয়ে। যেমন সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমি যেই আরাকান অঞ্চলে, সেই আরাকানের নাম পাল্টে  ফেলা হয়েছে। ওই জায়গার নাম রাখা হয়েছে ‘রাখাইন’, সংখ্যাগুরু রাখাইনদের নামে। প্রদেশটির রাজধানী আকিয়াব-এর নাম মুছে ফেলা হয়েছে, নাম রাখা হয়েছে সিতউয়ি। ‘রোহিঙ্গা’ শব্দের অর্থ হল নৌকার মানুষ, যারা সমুদ্রজলে নৌকা ভাসিয়ে মৎসসম্পদ আহরণ করে জীবিকার্জন করে। এ রোহিঙ্গাদের নিশানাও মুছে ফেলা হয়েছে, তাদের নতুন নাম দিয়েছে বর্মা  সরকার, ‘অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী’। রোহিঙ্গাদের তো নয়’ই, ওখানকার অন্য অধিবাসী যেমন জাতিগত বার্মিজ ও চীনাদের’ও (ধর্মে মুসলিম) পূর্ণ নাগরিকত্ব নাই। আছে স্রেফ ‘অধিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি। এবার যেই বার্মিজ মুসলমানদের মধ্যে তাবলীগের উদ্দেশে যাত্রায় বাসে থাকা ১০ জনকে হত্যা করার মাধ্যমেই সহিংসতার উদ্বোধন করে মিয়ানমার।

তো আরাকানের নাম মুছে, ওই নয়া রাখাইন রাজ্যের যাদের নাগরিক হিসেবে বর্মা স্বীকৃতি দিয়েছে তারা হলো রাখাইন। এই রাখাইনরা হলো সাবেক মগ জাতি। যার মাধ্যমে পুরা ইতিহাসকে মুছে ফেলা হয়েছে। একদা মগরা বর্মী রাজা ও পর্তুগিজদের লগে মিলে আরাকানের ভূমিপুত্র রোহিঙ্গা ও বার্মিজ মুসলিমদের ওপর এথনিক ক্লিনজিং চালিয়েছিল, বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলে লুটতরাজ চালিয়েছিল, মোগল জমানার শেষের দিকে ও বৃটিশ ঔপনিবেশিকতার সময়ে। তো, অপরাধী মগদের নাম বদল করে দিয়ে বর্মা প্রমাণ করতে চাইছে যে তার দেশের কোথাও মগরা নাই, যারা রোহিঙ্গা ও অন্যান্য জাতির ওপর তিন শতক ধরে এথনিক ক্লিনজিং চালানোর কাজে লিপ্ত ছিল। আর রোহিঙ্গা বলেও তো কিছু নাই। মানুষের জাতিগত পরিচয় উধাও করে ও জায়গার নাম বদলে দিলেও যে সত্য ধামাচাপা পরে না তা অত্যন্ত সত্য। কারণ মানুষ তো রয়ে গেছে। যারা জাতিগত রোহিঙ্গা। যারা আরাকানের আদিবাসী। যারা অন্য কোথাও থেকে আরাকানে যায়নি। বরং আরাকানেই তাদের চিরকালীন অধিবাস। এখন এই মানুষের তো একটা বিহিত করতে হবে বর্মার। যাদের নাম পরিচয়-মুছে দিলেও তো অস্তিত্ব রয়ে গেছে। এর একটা সমাধান বের করেছে বর্মা কর্তৃপক্ষ। যারা রোহিঙ্গা তাদেরকে বর্মা কর্তৃপক্ষ একটা পরিচয় দিল বটে! ‘অবৈধ বাংলাদেশী অধিবাসী’। সাবেক সামরিক শাসক ও বর্তমানে বর্মার রাষ্ট্রপতি থেইন সেইনে’র সরকারের কর্তাব্যক্তিরা অনানুষ্ঠানিকভাবে এদের এই নামেই ডাকেন। আর রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমসহ বেসরকারি সংবাদমাধ্যমগুলো এবং অং সান সুকি’র এনএলডি’র লোকেরা তাদের ডাকে ‘বাঙালি টেরোরিস্ট’! তারা হলো বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী? কাজেই তাদের জন্য নতুন পরিচয়পত্র করা হয়েছে। যে পরিচয়পত্র নিয়ে তারা ‘রাখাইন’ প্রদেশের মধ্যেই বন্দি থাকতে পারবে। এর বাইরে যেতে পারবে না এবং তারা কেউ বিয়েশাদি করতে পারবে না। বিবাহিত হলে দুই জনের বেশি সন্তান নিতে পারবে না। তারা ঘর থেকে বের হয়ে কোথাও গেলে পেছনে পেছনে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা ও মগরা নজরদারি করবে।

এখন, বর্মী বংশোদ্ভূত এক সেনানায়কের কন্যা অং সান সুকি’দের নেতৃত্বে যে ‘গণতান্ত্রিক মিয়ানমার উদ্ভাসিত হতে যাচ্ছে’ তার জন্য প্রয়োজনীয় আদমশুমারি হবে ২০১৪ সনে। যাতে সহায়তা করবে জাতিসংঘ। যেই জরিপে রোহিঙ্গা বলে কোনো জাতির অস্তিত্ব না থাকলে বর্মায় রোহিঙ্গাদের না থাকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও আদায় হয়ে যাবে বলে মনে করছে বর্মা সরকার।

এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য তারা সুনিপুণ কৌশল বেছে নিয়েছে বলে এখন দেখতে পাচ্ছি তারে এভাবে সংক্ষিপ্তসার করা যায়: ১. আরাকানে যে সব রোহিঙ্গা রয়েছে তাদের যত জনকে সম্ভব হত্যা করা হবে। ২. ব্যাপকতর হত্যা-ধর্ষণের মুখে ভীত সন্ত্রস্ত রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে বর্মা ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে শরণার্থী হিসেবে গেলে তাদের আর কখনোই ফেরত নেয়া হবে না। ৩. যারা পালিয়ে যাবে না তাদের ধরে ধরে বর্মী বন্দিশালায় (সরকারি নাম ‘সুরক্ষিত এলাকা’ নিয়ে যাওয়া হবে যাদের স্ট্যাটাস হবে তারা অনুপ্রবেশকারী বাঙালি টেররিস্ট।

এই কৌশল বাস্তবায়ন হলেই আরাকানে রোহিঙ্গাদের পরিচয় চিরতরে মুছে ফেলা সম্ভব হবে। এখন আমরা দুনিয়াবাসী যদি কোন সঠিক উদ্যোগ না নেই, তাহলে সত্যিই দুনিয়া থেকে রোহিঙ্গা জাতির অস্তিত্ব মুছে যাবে।

সবাইকে বলি, রোহিঙ্গাদের দুনিয়া থেকে মুছে ফেলার সাথে শুধু বর্মী কর্তৃপক্ষই জড়িত হয়নি। বলা যায় দুনিয়ার সব কর্তৃপক্ষই জড়িত হয়ে গেছে। ১. জাতিসংঘ বর্মাকে এথনিক ক্লিনজিং বন্ধ করতে না বলে বাংলাদেশকে বলছে রোহিঙ্গা শরণার্থী নিতে, যার মাধ্যমে জাতিসংঘ এথনিক ক্লিনজিংয়ের মত প্রধান সঙ্কটকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ২. যদিও বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নেয়ার সত্যিকারের বিপদকে মাথায় রেখে সীমান্তে কড়া পাহাড়া বসিয়েছে, কিন্তু এই ইস্যুতে মিয়ানমারের কার্যকলাপের নূন্যতম প্রতিবাদ না করে রোহিঙ্গা বিরোধী বর্ম অভিযানে সহায়তা করছে। ৩. দুনিয়া জুড়ে অ-মডারেট মুসলমান হত্যার জন্য ওয়ার অন টেররের পক্ষের শক্তি ইউএসএ, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইনডিয়া ও মুসলিম দেশগুলো রোহিঙ্গা এথনিক ক্লিনজিং ইস্যুতে নীরব সমর্থন যোগাচ্ছে।

এখন সব মিলে যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে রোহিঙ্গাদের নিধন অনিবার্য পরিণতি হয়ে দাড়িয়েছে। এ অবস্থা থেকে রোহিঙ্গাদের রেহাই দেওয়ার কোনো উপায় আছে কি?

আপাতত যদি আমরা চিন্তা করি, মনে হবে, কোনো উপায় নাই। দুনিয়ার সব কর্তৃপক্ষ যখন কারো প্রতি বৈরি হয়ে যায়, সেই জাতির বেঁচে থাকাটা মোটেই নিশ্চিত না। বরং গণহত্যার শিকার হওয়াটাই নিশ্চিত এবং ভূমিপুত্রদের চিরতরে ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়াটাও  অনিবার্য হয়ে ওঠে। বিশেষ করে বিগত তিন শত বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে এথনিক ক্লিনজিংয়ের শিকার হতে হতে মাত্র কয়েক লাখ লোকের ছড়ানো ছিটানো জাতিতে পরিণত হওয়া রোহিঙ্গাদের আরাকান নিবাসী অংশটির জন্য ব্যাপারটি আরো বেশি পষ্ট।
কিন্তু আমরা যারা দুনিয়ার আশাবাদী মানুষ, যারা মনে করি দুনিয়ার পক্ষগুলোর অশুভ আঁতাত উপেক্ষা করেও মানুষের প্রাণ ও সম্ভ্রম বাঁচানো অসম্ভব কিছু না-তারা কিন্তু পারি রোহিঙ্গাদের এথনিক ক্লিনজিং থেকে রেহাই দিতে।

এজন্য আমাদের দুটি কাজ করতে হবে: ১. আরাকানেই রোহিঙ্গাদের নিরাপদ অধিবাস নিশ্চিত করতে হবে এবং ২.রোহিঙ্গা এথনিক ক্লিনজিংয়ে জড়িতদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এই জন্য আমাদেরকে দুনিয়া জুড়ে আওয়াজ তুলতে হবে যেন এই দুটি কাজ বাস্তবায়িত হওয়া অনিবার্য হয়।

খোমেনী ইহসান: সাংবাদিক
                      ইমেইল: khomenee.ehsan@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.