গণমাধ্যম-কেন সার্ক সংবাদ সংস্থা চাই by অজিত কুমার সরকার

ভুটানের রাজধানী থিম্পু থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ঘেরা ছোট্ট শহর পারো। ২৯ মে থেকে এখানে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘সার্ক দেশের সংবাদ সংস্থাগুলোর মধ্যে সংবাদ বিনিময়ে সহযোগিতা বৃদ্ধি’বিষয়ক তিন দিনের সেমিনার। হিমালয় থেকে আসা বরফ গলা পানির নিরন্তর প্রবাহে সৃষ্টি হওয়া খরস্রোতা ছোট নদীতীরে অবস্থিত তাশি নামগিয়েল রিসোর্টের কনফারেন্স হলে সকাল ১০টায় সেমিনার শুরু হয়।


এতে অংশ নেন সার্কের পাঁচ দেশের জাতীয় সংবাদ সংস্থা, গণমাধ্যম, তথ্য মন্ত্রণালয়, সার্ক সেক্রেটারিয়েট ও সার্ক ইনফরমেশন সেন্টারের (এসআইসি) প্রতিনিধিরা। আয়োজক ছিল যৌথভাবে এসআইসি, ভুটানের তথ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, ডিপার্টমেন্ট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড মিডিয়া এবং রয়্যাল গভর্নমেন্ট অব ভুটান। সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয় মূলত ১৯৯৮ সালের এপ্রিলে ঢাকায় তথ্য ও গণমাধ্যম-সম্পর্কিত সার্ক তথ্যমন্ত্রীদের সভায় স্বাক্ষরিত ‘ঢাকা ইশতেহারে’ বর্ণিত ১৮ দফা কর্মপরিকল্পনার আলোকে। কর্মপরিকল্পনার ৩ নম্বরে ‘সার্ক দেশের সংবাদ সংস্থাগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। ১৮ দফা কর্মপরিকল্পনা একই বছরের ২৯-৩১ এপ্রিল কলম্বোতে অনুষ্ঠিত সার্ক শীর্ষ বৈঠকে অনুমোদন পায়।
তিন দিনের সেমিনারে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, সার্ক সেক্রেটারিয়েট ও এসআইসির প্রতিনিধিরা সার্ক দেশের জন্য নিউজ এজেন্সি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি ‘সার্ক নিউজ এজেন্সি’ ফোরাম গঠনসহ নয় দফা সুপারিশ প্রণয়নে সম্মত হন। সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার কাজটি সহজ হয় বাংলাদেশ ও ভুটানের পক্ষ থেকে প্রায় অভিন্ন প্রস্তাব উপস্থাপনের কারণে। প্রথম দিনে সেমিনারের শুরুতে স্বাগতিক দেশ ভুটানের প্রতিনিধি—রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস হাউসের মিডিয়া কনসালট্যান্ট গোপিলালা আচারিয়া—‘সার্ক দেশের সংবাদ সংস্থার মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি: পরিপ্রেক্ষিত, চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ’বিষয়ক একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করেন। এরপর বাংলাদেশের পক্ষে আমি, ভারতের পক্ষে অল ইন্ডিয়া রেডিওর নিউজ এডিটর নামপি মৃনময় ও অন্যান্য প্রতিনিধি নিজ নিজ দেশের পক্ষে ‘কানট্রি পেপার’ উপস্থাপন করেন।
বাংলাদেশ ও ভুটানের প্রতিনিধি সার্কভুক্ত দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কিত তথ্যগুলো একটি জায়গা থেকে পাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য একটি সার্ক নিউজ এজেন্সি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেন। সেমিনারে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিদের আলোচনা মূলত এ বিষয়েই কেন্দ্রীভূত থাকে। সার্ক সেক্রেটারিয়েটের পরিচালক ধন বাহাদুর অলি বাংলাদেশ ও ভুটানের প্রতিনিধির প্রস্তাবিত সার্ক নিউজ এজেন্সি প্রতিষ্ঠাসংক্রান্ত বাংলাদেশের প্রস্তাবটি যৌক্তিকতাসহ আরও বিস্তারিত তুল্রেধরার আহ্বান জানান। জবাবে আমার প্রস্তাবটি এভাবে তুলে ধরি: সার্ক নিউজ এজেন্সি চালু করার লক্ষ্যে সার্কভুক্ত দেশের জাতীয় সংবাদ সংস্থা থেকে একজন করে সিনিয়র সাংবাদিককে নিয়ে আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। সার্ক দেশের সংবাদ সংস্থাটির প্রস্তাবিত নাম হতে পারে সার্ক নিউজ এজেন্সি (এসএনএ)। এটি অনেকটা অর্গানাইজেশন অব এশিয়া-প্যাসিফিক নিউজ এজেন্সিজ (ওয়ানা) বা ওয়ানা নিউজ পুল ধরনের হতে পারে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৪৪টি দেশের সংবাদ সংস্থা ওয়ানার সদস্য। সার্ক দেশসমূহের সরকারগুলো যেহেতু সার্ক নিউজ এজেন্সি পরিচালনার অর্থ জোগান দেবে, সে জন্য প্রথম পর্যায়ে সার্ক দেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জাতীয় সংবাদ সংস্থা, রেডিও, টেলিভিশন এসএসএনের সদস্য হবে এবং এর ওয়েব পোর্টালের জন্য সংবাদ পরিবেশন করবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে বেসরকারি সংবাদ সংস্থা ও রেডিও-টেলিভিশনকে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
সার্ক নিউজ এজেন্সি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, রিজিওনাল কানেকটিভিটি (আঞ্চলিক যোগাযোগ), বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইশতেহারের বাস্তবায়ন কার্যক্রম, সাউথ এশিয়া গ্রোথ কোয়াড্রাংগল, বিভিন্ন প্রকল্প, একই সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে সংবাদ খুব কমই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সার্ক নিউজ এজেন্সি এসব বিষয় সামনে নিয়ে আসতে পারে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়ন ও প্রসারের সুযোগ কাজে লাগিয়ে সার্ক নিউজ এজেন্সির মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের সার্ভিস যেমন ভিডিও ডকুমেন্টারি ও মোবাইল ফোনে সংবাদ প্রচার করাও সম্ভব হবে।
ভুটানের গোপিলালা আচারিয়া সার্কভুক্ত দেশে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ আদান-প্রদানের জন্য একটি কেন্দ্রীভূত নিউজ পুল চালু করার প্রস্তাব করেন। তিনি তাঁর প্রস্তাবের সমর্থনে ১৯৯৫ সালে চালু হওয়া অ্যাসোসিয়েশন অব দ্য বলকান নিউজ এজেন্সিজ—সাউথ ইস্ট ইউরোপ (এবিএনএ) প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করেন। তিনি নিউজ পুল চালুর লক্ষ্যে এবিএনএর আদলে সার্কভুক্ত দেশের ন্যাশনাল নিউজ এজেন্সিগুলোকে সম্পৃক্ত করে অ্যাসোসিয়েশন অব সার্ক নিউজ এজেন্সি (এএসএনএ) বা আসনা প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। নিউজ পুল কেন প্রয়োজন—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, নেপালি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে ভুটানের গণমাধ্যমের কোনো সংবাদ বিনিময়ের ব্যবস্থা নেই। ফলে দুই বছর আগে নেপালে বিধ্বস্ত হওয়া বিমানে ১৮ জন ভুটানি নাগরিকের জীবনহানির সংবাদটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য স্থানীয় গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের নেপালের বন্ধু সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। তিনি অর্থসংকটের কারণে ২০০০ সালে সার্কের সহযোগী হিসেবে ইসলামাবাদে প্রতিষ্ঠিত সাউথ এশিয়া ফ্রি মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশন (এসএএফএম) বা সাফমার ভুটান চ্যাপ্টার প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে বলে জানান।
সার্বিক বিচারে পারোর সেমিনারটি দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোতে সংবাদ বিনিময়ের জন্য একটি কেন্দ্রীয় নিউজ এজেন্সি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বন্ধুত্বের বন্ধন আরও দৃঢ় হবে।
অজিত কুমার সরকার: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.