রোহিঙ্গাদের রক্ষায় বিশ্ব নিরব কেন? by এএম জিয়া হাবীব আহসান

প্রতিবেশী মিয়ানমারের সীমান্ত শহর মংডু ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে নৌকায় নৌকায় অসংখ্য অসহায় নারী শিশুরা ভাসছে। রক্তাক্ত জখম কিংবা গুলিবিদ্ধ, আহত ও ক্ষুধার্থ মানুষের আহাজারিতে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ভারী হয়ে উঠেছে।

একদিকে নাসাকা বাহিনীর ধাওয়া অন্য দিকে বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড ও কোস্ট গার্ডের পুশব্যাক প্রচেষ্টা, নাফ নদীর মাঝ পথে বয়ে যাচ্ছে এক করুণ মানবিক বিপর্যয়। মিয়ানমারের সরকারের নির্মুল নীতির শিকার রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের হাজার হাজার ভিকটিম বিশ্ববিবেকের কাছে প্রশ্ন করছে আমরা কি মানব সন্তান নই? মানবাধিকারের এ চরম লংঘনের শিকার এ মানুষগুলোকে বাঁচাবে কে? তারাও মানুষ, আমাদের ভাই, বোন, সন্তান কিংবা মা, বাবার মতো।

বাংলাদেশ এমনিতেই জনসংখ্যার ভারে ন্যূব্জ। তার ওপর প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর) এর ত্রাণ ও সাহায্য পেয়ে থাকলেও এ সমস্যা এ দেশের জন্য নানাভাবে বিরূপ প্রভাব রাখছে।

মিয়ানমারের অনীহা ও তাদের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় এসব রিফিউজিদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। ১৯৭৮ এর দিকে ২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলামান এদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। ১৭টি ক্যাম্পে তাদের রাখা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ-মিয়ানমার চুক্তির মাধ্যমে তাদের সিংহভাগ ফেরত পাঠানো হয়। ১৯৯১ এবং ১৯৯৯ সালেও আরো রিফিউজি প্রবাহ দেখা যায়।

এ নৃশংসতা ও বর্বরতা আবারো শুরু হলো গত কিছুদিন ধরে। একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা উস্কে দেয় হয়। ফলে জীবন দিতে হচ্ছে নিরপরাধ বহু মানব সন্তানকে। আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৫ এ বলা হয়েছে রাষ্ট্র তার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ চার্টারকে সম্মান দেখাবে। ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২-এ বলা হয়েছে, যেকোনো ব্যক্তির জীবন ও স্বাধীনতার অধিকারকে বঞ্চিত করা যাবে না যা আইনগত কোনো পদ্ধতি বা উপায় ব্যতীত।

এখানে Person (ব্যক্তি) এব Citizen (নাগরিক) শব্দগুলোর ব্যবহার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কে বাংলাদেশের নাগরিক, কে নাগরিক নয় তা বিবেচ্য নয়। বাংলাদেশ মূলত একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আমাদের একটি ট্রেডিশন (ঐতিহ্য) আছে। আমরা বিশ্ববাসীর মৌলিক মানবাধিকারকে সমুন্নত রাখার পক্ষে কথা বলি। যদিও বাংলাদেশসহ এ উপমহাদেশের দেশগুলো ১৯৫১ সালের কনভেনশনের কোন পক্ষ ছিল না তবুও বাংলাদেশ রিফিউজিদের কোনো প্রকার সেল্টার দেয় না একথা ঠিক নয়। উপমহাদেশের অন্যান্য দেশ যেমন ভারত মুক্তিযুদ্ধে আমাদের এবং স্বাধীনতার পর ভারত বাংলাদেশের চাকমাদের, পাকিস্তান আফগান শরনার্থীদের এবং নেপাল ভুটানও আফগান শরণার্থীদের গ্রহণ করেছে। রিফিউজি ইস্যুর মূলত মারাত্নক অর্থনৈতিক ও অন্যান্য প্রভাব  থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ অতীতে রিফিউজিদের সহায়তা দেয়। এছাড়া বাংলাদেশে বিভিন্ন দেশের প্রায় ২০ জন লোক Asylum গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশ এশিয়ান-আফ্রিকান কনভেশন এর দ্বারা গৃহীত মূলনীতি সমূহকে গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ সংগত কারণে রোহিঙ্গাদের পুশ ব্যাক করলেও এখানে একটি মানবিক বিষয় এসে যায়। তা হলো এ অসহায় মানুষ ও নারী শিশুদের মানবিক বিপর্যয় থেকে রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার অনুচ্ছেদ ১৪(১) অনুযায়ী প্রত্যেকেরই নিগ্রহ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অন্য দেশে আশ্রয় প্রার্থনা ও তা পাওয়ার অধিকার রয়েছে।

যেহেতু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যা সমস্যা প্রকট সেহেতু এক্ষেত্রে বিশ্বসমাজের দায়িত্ব রয়েছে প্রচুর। আন্তর্জাতিক শরণার্থী রক্ষণা-বেক্ষণে ইউএনএইচসিআর এর বিকল্প পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি। রোহিঙ্গাদের সকল প্রকার বৈষম্য থেকে রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে বিশ্ববিবেক-কে। কেননা তারা জাতিগত বিদ্ধেষের সুস্পষ্ট শিকার। মিয়ানমার তাদের অস্থিত্ব মেনে নিতে নারাজ, তারা সেখানে পদে পদে বঞ্চিত, অবহেলিত, নির্যাতিত, পদদলিত। হত-দরিদ্র অসহায় এসব বনি আদমের ওপর আরাকানে, বর্মী- সেনাবাহিনীর স্বাধীনতা পরবর্তী সশস্ত্র অপারেশন চালানো হয় প্রায় ১৪টি। গণতন্ত্রের মানসকন্যা নোবেল বিজয়ী অংসান সূচি’র দেশে এ ধরণের নৃশংসতা লজ্জাজনক যা পুরো মানবজাতির জন্য কলঙ্কজনক। মংডুতে মসজিদ ভেঙে ফায়ার ব্রিগেড বানানোর দৃশ্য দেখলেই বুঝা যায় তারা সেখানে কতো নিগৃহীত। চলতি সনের ২ মার্চ শুক্রবার ও শনিবার দু’দিন দিনব্যাপী মানবপাচার প্রতিরোধ বিষয়ক এক সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করতে ১৩ সদস্যের একটি মানবাধিকার টিম মিয়ানমারের সীমান্তশহর মংডু সফর করে। এ সময় সেখানে রোহিঙ্গাদের সামাজিক অবস্থান দেখা গেছে অনেকটা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে। নিগৃহীত এ জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার পরিস্থিতি বিশ্বব্যাপী জানে না।

আরাকানে রোহিঙ্গা জনগোষ্টির নৃতাত্বিক ও ঐতিহাসিক পরিচয় দেখলে দেখা যাবে এদেশের মানুষের সাথে তাদের দীর্ঘদিনের হৃদ্যতা ও ভালোবাসার সম্পর্ক বিদ্যমান। এদেশের মানুষ বৃটিশ আমল থেকে ব্যবসা বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কারণে সেখানে বসবাস করতো।

মুরুব্বীদের থেকে শুনেছি ১৯৫৮ সালেও একবার রোহিঙ্গারা আরাকান থেকে নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। ‘আকিয়াবের’ মগ-রা এ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। আমাদের সীমান্তের দু’পারে বসবাসকারীদের মাঝে তাদের আত্মীয়তা রয়েছে। ফলে সেখানের কান্নার আওয়াজ এখানের বাতাসকেও ভারী করে। নাফ নদীর তীরে তীরে হাবুডুবু খাচ্ছে হাজার হাজার নির্যাতিত অসহায় রোহিঙ্গা মানবসন্তান। তারা এখন বন্ধুহীন। কে দাঁড়াবে তাদের পাশে? আমরা বলছি বাড়ি ফিরে যাও। কিন্তু তার পক্ষে সম্ভব হলে সে যেত। জীবন এবং স্বাধীনতা হারাবার ভয়ে দেশত্যাগী পলাতক এসব নারী-পুরুষ এবং শিশুদের রক্ষা করবে কে? জাতিসংঘের (UNHCR) দায়িত্ব হচ্ছে তাদের দৈহিক নির্যাতন থেকে রক্ষা করা, তাদের মৌলিক মানবাধিকার সংরক্ষণ ও তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি থেকে রক্ষা করা। তাদের খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিধান করা। নিগ্রহ, বৈষম্য, অসহিষ্ণুতা ও জাতিগত প্রতিহিংসার দাবানল থেকে তাদের রক্ষা করা।

তাদের সাম্প্রতিক দুর্দশা আমাদের সময়ের বড় ধরণের শোকাবহ ঘটনাগুলোর একটি। মানবাধিকার লংঘনের এ ব্যাপারটি আমাদের প্রত্যেকের জন্য উদ্বেগজনক। তাদের প্রতি বিশ্ববাসীর দায়িত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দেশ বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের দায়িত্ব এক্ষেত্রে বেশি। জাতিগত নিধনের শিকার এ মানবগোষ্টিকে রক্ষা করা সময়ের দাবী। নাসাকার গুলিতে নারী ও শিশু নিহতের ঘটনা, নাফ নদীতে নৌকায় ১৫ দিন বয়সের শিশু ফেলে দেয়ার ঘটনা, আহতদের চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু, তীব্র খাদ্যাভাব, নৌকায় হাজার হাজার নারী শিশুর মৃত্যুর প্রহর গুনার ঘটনা মানবিক বিপর্যয়ের সংবাদ বিশ্ব বিবেক কে কি নাড়া দেবে না? আসুন আমরা মানবতার প্রতি নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসি।

এএম জিয়া হাবীব আহসান: আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী।

No comments

Powered by Blogger.