বেতন বৈষম্য by আনোয়ার হোসেন

একই কাজ করেও ধনী দেশগুলোর একজন কর্মী যদি মাসে এক লাখ টাকা বেতন পান, সেখানে একজন ভারতীয় পান সর্বসাকল্যে দশ হাজার টাকা। বাংলাদেশে আমরা দেখি, এখানে জাতিসংঘ ও 'উন্নত দেশগুলোর' যেসব বিশেষজ্ঞ নিয়ে আসা হয় আমাদের করা ঋণের অর্থ কিংবা আমাদের জন্য অনুদানের অর্থে, সেখানেও তাদের বেতন-ভাতা দিতে হয় 'ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ডে'। তবে দুটি বিষয় এক করে দেখা ঠিক হবে না।


প্রথম বিষয়টি অবশ্যই সম্পদ বৈষম্যের কারণে ঘটে থাকে। যে দেশের অর্থনীতি যত শক্তিশালী সেখানে বেতন-ভাতা তত বেশি হয়ে থাকে। পণ্যের দামেও তার প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশের একজন নাগরিক যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে গাড়ি চালিয়ে যা আয় করে, সে পরিমাণ আয় দেশে থেকে সর্বোচ্চ সরকারি পদে কাজ করেও আয় করা যায় না। আর দ্বিতীয়টি বৈষম্যের কারণ উন্নত দেশগুলোর সৃষ্ট বৈষম্য। আমাদের দেশের অনেক প্রকল্পে তারা অতি সাধারণ মানের 'বিশেষজ্ঞ' প্রেরণ করে এবং এ জন্য বিপুল অর্থ দিতে হয়। এতে রাজি না হলে গোটা প্রকল্পেই তাদের সহায়তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওরলি আশেনফেল্টারের গবেষণায় উঠে এসেছে বৈষম্যের নানা তথ্য। একই ধরনের ক্ষেত্রে সমপ্রযুক্তি ব্যবহার করে একই কাজ করলেও এই তফাত থাকছে বলে গবেষণায় দাবি করেছেন তিনি। গবেষণাটি করতে বিশ্বের ৬০টি দেশের ম্যাকডোনাল্ডসের বিপণিগুলো এবং তাদের পণ্য বিগ ম্যাককে বেছে নিয়েছিলেন ওরলি।
তার দাবি, ভারতে ম্যাকডোনাল্ডসের বিপণিগুলোতে একজন কর্মী ঘণ্টায় মাত্র ০.৪৬ ডলার (প্রায় ভারতীয় ২৬ রুপি, বাংলাদেশের মুদ্রায় ৪০ টাকার মতো) আয় করেন। সেখানে আমেরিকায় ওই একই কাজ করে একজন ঘণ্টায় আয় করেন ৭.৩৩ ডলার (প্রায় ৪২০ ভারতীয় রুপি), যা ভারতীয় কর্মীর আয়ের প্রায় ১৬ গুণ। ওই পরিমাণ অর্থ দিয়ে মার্কিন মুলুকের কর্মী দুটি বিগ ম্যাক (বার্গার) কেনার ক্ষমতা রাখেন। প্রতিটির দাম ৩.০৪ ডলার (প্রায় ১৭৩ ভারতীয় রুপি)। সেখানে ভারতীয় কর্মীদের একটি বিগ ম্যাক কিনতে অতিরিক্ত দুই থেকে তিন ঘণ্টা কাজ করতে হয়। ভারতের বাজারে এক একটি বিগ ম্যাকের দাম ১.২৯ ডলার (প্রায় ৭৩.৫০ ভারতীয় রুপি)।
শুধু ভারতই নয়। চীন, লাতিন আমেরিকা, পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও একই ছবি ধরা পড়েছে। সেখানকার কর্মীদের আয়ের অঙ্কও আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ, জাপান বা কানাডার মতো দেশের তুলনায় অনেকটাই কম। সাধারণত বেতন হারের পার্থক্যের অনুপাত ছিল ১০ :১। কিন্তু সেখানেই বিগত দশকে, বিশেষত ২০০০-০৭ পর্যন্ত, উন্নয়নশীল দেশগুলোর কর্মীদের বেতন বৃদ্ধির হার ছিল ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু ২০০৮-এর মন্দার পর থেকেই ফের তা কমেছে। অনেক ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধি থমকে গেছে বলেও গবেষণায় জানিয়েছেন ওরলি।
বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যাই রয়েছে চীন ও ভারতে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে চীনে বছরে প্রকৃত বেতন হারের (মূল্যবৃদ্ধি বাদ দিয়ে) গড় বৃদ্ধির হার মাত্র ৯% এবং ভারতে ৮%। প্রসঙ্গত, কোনো ক্ষেত্রে নূ্যনতম বেতনকে নির্দিষ্ট পণ্যের দর দিয়ে ভাগ করে প্রকৃত বেতন হার নির্ধারণ করা হয়। এর থেকেই হিসাব করা হয়, একজন কর্মী এক ঘণ্টা কাজ করে কতটা পণ্য কিনতে পারেন। বিশ্বজুড়েই এই প্রক্রিয়ায় কর্মীদের জীবনযাপনের মান এবং উৎপাদনশীলতা নির্ণয় করা হয়।
উন্নত দেশগুলোতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এমনটি ঘটে কম ক্ষেত্রেই। পরিস্থিতি অসহনীয় হলে শ্রমিকরা কখনও কখনও আন্দোলনে নামে। সরকারি কর্মচারীরাও আন্দোলন করে। কিন্তু বেসরকারি খাতের কর্মীদের জন্য পরিস্থিতি মোটেই সুখকর থাকে না।
উন্নত দেশগুলোর মতো বেতন-ভাতা আমাদের দেশে কবে মিলবে?
 

No comments

Powered by Blogger.