চরাচর-দেওয়ানবাড়ির সংগীতচর্চা by স্বপন কুমার দাস

ঢাকার দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদী। এ নদীর ওপারে বর্ধিষ্ণু কেরানীগঞ্জ উপজেলা। এ উপজেলারই একটি শান্ত সৌম গ্রাম বামনসুর। এ গ্রামটির নাম দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে একটি বাড়ির কল্যাণে। বাড়িটির নাম দেওয়ানবাড়ি। বাংলাদেশে লোকগানের প্রসারে এ বাড়ির অবদান অনস্বীকার্য।


এ বাড়ির সন্তান মরহুম মালেক দেওয়ান এবং খালেক দেওয়ানের নাম শোনেননি লোকসংগীতের এমন শ্রোতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। মালেক দেওয়ান ও খালেক দেওয়ানের সন্তানরা আজও লোকগানের চর্চা অব্যাহত রেখেছেন।
দেওয়ান ঘরানার আদিপুরুষ আলেক চান দেওয়ান জীবনজিজ্ঞাসার উত্তর খোঁজার জন্য বহু বছর দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ান। গুরুর নির্দেশে শেষমেশ নিজ বাস্তুভিটায় চলে আসেন। বাড়ি নির্মাণ করে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি সংগীতচর্চায় মগ্ন থাকেন। সংগীতের মাধ্যমেই তিনি ঈশ্বরের আরাধনা করতেন। অবসর সময়ে তিনি মানবসেবা করতেন। মাঝেমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে আধ্যাত্মবাদী মরমি গান শুনিয়ে আল্লাহ-ভক্ত মানুষের মন জয় করে নিয়েছিলেন। তাঁর গানের বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনিই গান রচনা করে সুর দিয়ে লোকসম্মুখে তা পরিবেশন করতেন।
পরবর্তীকালে তাঁর সুযোগ্য দুই ছেলে মালেক দেওয়ান (১২৯৯-১৩৯৯ বাংলা) ও খালেক দেওয়ান (১৩১৬-১৪১০ বাংলা) সংগীতের এ ধারাকে এগিয়ে নেন। তাঁরা অসংখ্য লোকগান রচনা করে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁদের রচিত লোকগানের মধ্যে যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে তা হচ্ছে, দেহতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, নবীতত্ত্ব, মেরাজতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, ভজন ইত্যাদি। তা ছাড়া ভাটিয়ালী, পল্লীগীতি, দেশাত্মবোধক গান রচনা করেও তাঁরা সুনাম কুড়িয়েছেন। বাবার মতোই তাঁদের গানের বৈশিষ্ট্য ছিল, নিজেরাই গান রচনা করে সুর দিয়ে জনসম্মুখে পরিবেশন করা। অনেক সময় দেখা গেছে, পালাগানের আসরে তাঁরা প্রতিপক্ষের গানের উত্তর দিতে তাৎক্ষণিক গান রচনা করে সুর দিয়ে সংগীত পরিবেশন করতেন। দেওয়ান ঘরানার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, প্রথম জীবনে তাঁরা সংগীত পরিবেশন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। জীবনের শেষের দিকে সুফি সাধনায় কালাতিপাত করেন। দেওয়ানবাড়িতে রয়েছে চমৎকার একটি দরবার ঘর। এখানে ধর্মচর্চার পাশাপাশি চলে মারফতি-মুর্শিদি গান। আর রয়েছে মালেক দেওয়ান ও খালেক দেওয়ানের সুরম্য বাড়ি ও মাজার।
দেওয়ানবাড়ির বর্তমানে গদিনশিন পীর সাধন দেওয়ান, তিনি শিক্ষিত ও সজ্জন ব্যক্তি। তিনিও প্রথম জীবনে পালাগানের আসরে সংগীত পরিবেশন করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। তাঁর নিজের রচিত বহু লোকগান আছে। তিনি এখন সাধন-ভজনে সময় ব্যয় করেন। ভালো কবিরাজ হিসেবেও তাঁর খ্যাতি আছে। তাঁর দুই ছেলেও সংগীতকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। দেওয়ান ঘরানার অন্য ছেলেরাও এ ধারায় বিশেষ নাম করেছেন। বিশেষ করে আরিফ দেওয়ান বর্তমান সময়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী বাউলশিল্পী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। এভাবেই দেওয়ানবাড়ির খ্যাতি আজ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
স্বপন কুমার দাস

No comments

Powered by Blogger.