নারী হোস্টেল-মাথার ওপর চাই নিরাপদ ছাদ

আমাদের আধা-উন্নত নাগরিক ব্যবস্থার সদরে কর্মজীবী ও শিক্ষাপ্রত্যাশী নারীর বিড়ম্বনা কমবেশি আলোচিত; কিন্তু অন্দরেও তারা কতটা অস্বস্তিতে, তাদের হোস্টেল জীবন নিয়ে সমকালের শুক্রবারের প্রতিবেদনটিতে স্পষ্ট। নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা ও সামাজিক বৈষম্য আমরা নির্মূল করতে পারিনি বটে; এ নিয়ে উদ্বেগ ও উদ্যোগহীনতার অভিযোগ তোলা কঠিন।


কিন্তু অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাবলম্বন প্রত্যাশী নারীরা রাজধানী শহরে এসে কীভাবে ছাদ-বাণিজ্যের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে, সেদিকে কেউ কি নজর দিয়েছে? প্রধানত শিক্ষা, অংশত জীবিকার প্রয়োজনে প্রতিবছর সারাদেশ থেকে যেসব নতুন মুখ দেড় কোটি মানুষের এই নগরীতে নড়বড়ে পা ফেলে, তাদের মাথা গোঁজার আচ্ছাদন ততোধিক টালমাটাল। হাতেগোনা কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যগুলোর ছাত্রী হোস্টেল নেই বললেই চলে। যত্রতত্র গড়ে ওঠা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা যদি ব্যাঙের ছাতার সঙ্গে হয়, ছাত্রী হোস্টেল যেন ডুমুরের ফুল। কয়টা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানই বা তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করতে পেরেছে? এ সুযোগই সাড়ম্বরে গ্রহণ করেছে এক শ্রেণীর নারী হোস্টেল ব্যবসায়ী। আকর্ষণীয় নাম ও বিজ্ঞাপনের আড়ালে অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার যে চিত্র সমকালের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে, তার সত্যতা কেবল ভুক্তভোগীরা জানেন না। মর্জিমাফিক ভাড়া, দফায় দফায় বৃদ্ধি, নিরাপত্তাহীনতা প্রভৃতি অসুবিধাও ওপেন সিক্রেট। কিন্তু প্রতিকারের ব্যবস্থা নেই। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচক উন্নয়নে অবদান রাখা নারী হোস্টেলবাসীর জীবনযাত্রার সূচকে যেন অবনতিই নিয়তি। আমরা মনে করি, পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। রাজধানীতে প্রতিষ্ঠিত তিনটি মাত্র সরকারি মহিলা হোস্টেল যে প্রয়োজনের তুলনায় নেহাত অপ্রতুল তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা জানি, রাজধানীমুখী বিপুলসংখ্যক একক নারীর বাসস্থানের ব্যবস্থা করা তৃতীয় বিশ্বের একটি সরকারের পক্ষে কঠিনও বটে। সারাদেশে আরও ২৪টি কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল নির্মাণের যে পরিকল্পনার কথা মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী গত বছর ডিসেম্বরে সংসদকে জানিয়েছেন, জনস্রোতের অভিমুখ বিবেচনায় তার সিংহভাগ রাজধানীতে বাস্তবায়িত হতে পারে। কিন্তু তাতে করেও পরিস্থিতির কতটা উন্নতি হবে, আমাদের সন্দেহ রয়েছে। সরকারের বরং উচিত হবে, ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা নারী হোস্টেলগুলোকেই সুর্নিদিষ্ট নীতিমালা ও নজরদারির আওতায় আনা। নারী হোস্টেল নিয়ে নীতিমালা নেই_ এ তথ্য মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দৈন্য ও উদাসীনতাই প্রমাণ করে। মন্ত্রণালয় অবিলম্বে উদ্যোগী হবে বলে প্রত্যাশা। তার আগ পর্যন্ত হোস্টেল মালিকরা যাতে মর্জিমাফিক ভাড়া নির্ধারণ ও বৃদ্ধি করতে না পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। অতি মুনাফার সুযোগ হোস্টেলবহুল এলাকাগুলোর সাধারণ বাসা ভাড়ার ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। হোস্টেলবাসী যাতে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা পায়, সে ব্যাপারেও কর্তৃপক্ষের নজরদারি জরুরি। মফস্বল থেকে আসা নারী শিক্ষার্থী ও কর্মজীবীর অসহায়ত্বকে পুঁজি করে কাউকে আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে দেওয়া যায় না। হোস্টেল ব্যবসায়ীরা যাতে নারীর প্রতি দায়িত্বশীল ও সহানুভূতিশীল হয়, সে ব্যাপারেও প্রশিক্ষণ ও প্রচারমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। রাজধানীতে গড়ে ওঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নারী শিক্ষার্থীর বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে চাপ দিতে হবে। এ কাজে সরকারের পাশাপাশি নারী অধিকার ও উন্নয়নে তৎপর বেসরকারি সংগঠনগুলোও এগিয়ে আসতে পারে। বস্তুত আজকের দীপাবলিদের লক্ষ্য পূরণের পথ মসৃণ করতে সম্মিলিত প্রচেষ্টার বিকল্প নেই। আমাদের ভগি্ন ও জায়ার মাথার ওপর সুশৃঙ্খল ছাদ নির্মাণে আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে।
 

No comments

Powered by Blogger.