এগিয়ে যাও আরিফা by এমএম কবীর মামুন

কয়েকদিন আগে জাতীয় দৈনিকগুলোতে ছোট করে হলেও একটি খবর ছিল চোখে পড়ার মতো। আর তা হলো_ গ্রাম মাদকমুক্ত করতে গিয়ে বাড়িছাড়া স্কুলছাত্রী। অতীতে অনেক মানুষই সমাজের অপতৎপরতা-অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে।


এমনকি জীবন দিয়ে আমাদের শিখিয়ে গেছেন সমাজকে নতুন করে সাজানো কতটা জরুরি। কিন্তু আমরা কি বুঝতে পারি এই প্রয়োজনীয়তার কথা অথবা যে মানুষটি অকাতরে নিজের প্রাণ দিয়ে গেল তার প্রাণ দেওয়ার মাহাত্ম্য।
রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার পাচন্দর ইউনিয়নের নোনাপুকুর গ্রামের স্কুলছাত্রী আরিফা খাতুনের গ্রামকে মাদকমুক্ত করতে গিয়ে বাড়িছাড়া হওয়ার খবর কয়েকদিন ধরেই আমাকে তাড়া করে ফিরছে। কারণ ওই কাজের সঙ্গে আমার ইমোশন অনেকটা জড়িয়ে রয়েছে। ২০০৮ সালে আমি রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলায় থাকতাম। কাজ করতাম একটি বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনে। ২০০৮ সালের শেষের দিকে, সম্ভবত ডিসেম্বর মাসে সেই সংগঠনের হয়ে আমি নিজে নোনাপুকুর গ্রামের স্কুল-কলেজপড়ূয়া কিছু ছাত্রছাত্রী নিয়ে গড়ে তুলেছিলাম 'নোনাপুকুর গণগবেষক দল' নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সামাজিক নানা সমস্যা স্থানীয় মানুষরাই মোকাবেলা করতে সক্ষম_ এই ধারণা থেকেই সংগঠনটি গড়ে উঠেছিল। তারপর অনেকদিন হয়ে গেল জীবিকার সন্ধানে আমি চলে এসেছি তানোর ছেড়ে। আজ হঠাৎ সেই গণগবেষক দলের সদস্যদের মাদকমুক্ত গ্রামের স্বপ্নে গড়ে তোলা আন্দোলন এবং দলের একজন নেতা আরিফা খাতুনের বাড়িছাড়া হওয়ার খবর পেয়ে মনটা নাড়া দিয়ে উঠল।
নতুনের জন্য, ভালোর জন্য যারা সংগ্রাম করে তাদের এ ধরনের বিপত্তির মুখে পড়তে হবে, এটিই স্বাভাবিক ঘটনা। বাংলাদেশে মাদক ব্যবসায়ের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের শিকড় ক্ষমতার অনেক গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত। যখনই যারা তাদের সামনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে চায়, তাদের হত্যা পর্যন্ত করতে তারা দ্বিধাবোধ করে না। অতিসম্প্রতি চট্টগ্রামে আলোচিত হিমু হত্যার কথা আমরা শুনেছি। কী অমানবিক ছিল সেই হত্যার ঘটনা। হিমু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাদক এবং দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন গড়ে তোলে। তার গড়ে তোলা আন্দোলনকে শেষ করে দেওয়ার জন্য হিমুকে কুকুর দিয়ে খাইয়ে মেরে ফেলা হলো। এ রকম আরও বহু উদাহরণ রয়েছে সারাদেশে।
রাজশাহীর তানোর উপজেলার পাচন্দর ও বাধাইড় ইউনিয়নের নোনাপুকুরসহ অনেক গ্রামই মাদক ব্যবসায়ীদের অভয়ারণ্য। অনেকটা প্রকাশ্যেই মাদকের ব্যবসা চলে সেখানে। স্থানীয়ভাবেই মদ তৈরি হয় এসব গ্রামে এবং স্থানীয়ভাবেই এগুলোর রমরমা ব্যবসা হয়। তাই গ্রামগুলোতে মাদক ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি মাদকসেবীদের উৎপাতও চরম আর নোনাপুকুরের আমিনুলের মতো বহু লোক প্রতিটি গ্রামেই আছে। এদের নেটওয়ার্কও খুবই শক্তিশালী। থানা এদের ধরবে না অথবা ধরলেও কয়েকদিন অথবা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এরা মুক্তি পেয়ে যাবে। এখানকার মাদক ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য এতটাই। গ্রামকে মাদকমুক্ত করার সংগ্রামে নেমে আরিফা নিজেই এখন গ্রামছাড়া। গ্রীষ্মের ছুটির পর তার স্কুল খুললেও সে যেতে পারছে না স্কুলে। বিঘি্নত হচ্ছে তার শিক্ষা কার্যক্রম। সে এখন রাজশাহীতে মহিলা অধিদফতরের সেফহোমে আছে। আরিফার জন্য স্থানীয় সুশীল সমাজের সদস্যরা মানববন্ধন করেছেন। কিন্তু আরিফা কতদিন থাকবে সেফহোমে? সে কি আদৌ বাড়ি ফিরতে পারবে? গ্রামে ফিরলেও আমিনুলরা কি আরিফাকে আগের মতো জীবনযাপন করতে দেবে? আরও বহু অমীমাংসিত প্রশ্নের মতো এ সব প্রশ্ন থেকেই যাবে। কিন্তু আরিফার গবেষক দল যে সংগ্রাম শুরু করেছে তা একদিন বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে আলোর বার্তা পেঁৗছে দেবে। যুব সমাজকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে যে মাদক সেই মাদক থেকে সমাজকে মুক্ত করার যে বার্তা তা দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে একদিন পেঁৗছে যাবে। জয়তু আরিফা! তুমি এগিয়ে যাও, দেশের মানুষ তোমার সঙ্গে আছে এবং থাকবে।
krmamun334@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.