বাজেট-বিষ তবে সুলভই থাকবে! by আমিনুল ইসলাম সুজন

বিড়ি কোম্পানিগুলো শ্রমিকের কর্মসংস্থানের বিষয় তুলে কর বৃদ্ধির বিরোধিতা করে থাকে। অথচ বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ হলে ১৮.৭ শতাংশ চাকরি বৃদ্ধি পাবে। তামাক কোম্পানিগুলো মিথ্যাচার করছে।


তারা বলছে, বিড়ি শিল্পে অনেক শ্রমিক কাজ করে। অথচ বিড়ি শিল্পে যে ব্যাপক শ্রম শোষণ হয় তা তারা বলে না



বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০০৪ সালের গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ৩০ বছরের বেশি বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতি বছর ১২ লাখ মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত প্রধান ৮টি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এর মধ্যে ৫৭ হাজার মৃত্যুবরণ এবং ৩ লাখ ৮২ হাজার লোক পঙ্গুত্ব বরণ করছে। তামাক সেবনজনিত কারণে মৃত্যুসংখ্যা যেমন বাড়ছে, তামাক সেবনজনিত আর্থিক ক্ষতির পরিমাণও বেড়েছে।
শুধু বিড়ি ধূমপায়ীরাই প্রতিদিন প্রায় ৮ কোটি টাকা খরচ করছে। সাধারণত বিড়ি নিম্নবিত্তদের নেশায় ব্যবহৃত হয়। দেশে বিড়ি ধূমপায়ীরা যে অর্থ প্রতিদিন এর জন্য ব্যয় করছে সে অর্থ দিয়ে ওইসব পরিবারের পুষ্টি ঘাটতির বড় অংশ দূর করা সম্ভব। মূলত দরিদ্র মানুষের মধ্যে ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডবিল্গউবিবি) ট্রাস্ট পরিচালিত 'হাংরি ফর টোব্যাকো' নামক এক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের মানুষ যদি তামাকের জন্য ব্যয় করা অর্থের ৬৯ শতাংশ খাদ্যের জন্য ব্যয় করে তবে দেশে অপুষ্টিজনিত মৃত্যু অর্ধেক কমিয়ে আনা সম্ভব। আমরা জানি, অপুষ্টিজনিত রোগে যারা মারা যায় তাদের অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের শিশু।
শুধু বিড়ি সেবন নয়; বিড়ি কারখানাগুলোও জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ, অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ২০০৮ সালের সরকারি হিসাবে বলা হয়, দেশে বিড়ি শ্রমিকের সংখ্যা ২ লাখ ৬৬ হাজার ৮১৮ জন। দূষিত পরিবেশে বিড়ি কারখানায় কাজ করা শ্রমিকরা অনেক কম মজুরিতে কাজ করায় একদিকে কখনও দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পায় না, অন্যদিকে অকালে অসুস্থ ও মৃত্যুবরণ করে। বিড়ি কোম্পানিগুলো শ্রমিকের কর্মসংস্থানের বিষয় তুলে কর বৃদ্ধির বিরোধিতা করে থাকে। অথচ বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ হলে ১৮.৭ শতাংশ চাকরি বৃদ্ধি পাবে। তামাক কোম্পানিগুলো মিথ্যাচার করছে। তারা বলছে, বিড়ি শিল্পে অনেক শ্রমিক কাজ করে। অথচ বিড়ি শিল্পে যে ব্যাপক শ্রম শোষণ হয় তা তারা বলে না।
বিড়ি কারখানায় প্রতিদিন ১০ থেকে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার বিড়ি বানানোর কাজ পায় একজন শ্রমিক। কিন্তু একজন শ্রমিকের পক্ষে এত বিড়ি বানানো সম্ভব নয়। সে তার স্ত্রীকে দিয়ে কাগজে আঠা লাগিয়ে বিড়ির রোল বানানোর কাজ করায়, তার সন্তানকে দিয়ে বিড়ি রোলের মধ্যে তামাকের গুঁড়া ভরানোর কাজ করায়। কারণ রোল বানানোর জন্য নরম হাত ভালো। না হলে কাগজের রোল নষ্ট হয়ে যাবে। অন্যদিকে বিড়ির রোলে তামাকের গুঁড়া ভরার জন্য ছোট ছোট আঙুলের ব্যবহার হলে কাজ দ্রুত হয়। কিন্তু এ মারাত্মক পরিবেশে কাজ করেও বিড়ি শ্রমিকের স্ত্রী বা সন্তান কোনো পারিশ্রমিক পায় না। স্ত্রী ভাবে, সে তার স্বামীর কাজে সহযোগিতা করছে, শিশুসন্তান ভাবে, তারা গরিব, তাই সে তার বাবার কাজে সহযোগিতা করছে। মারাত্মক রকম ক্ষতিকর পরিবেশে বিড়ি কারখানার শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করে চলেছে।
মানুষের জীবন অপেক্ষা কোনো কিছুই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১১ এবং অনুচ্ছেদ ১৮ (১)-এ মানুষের মৌলিক মানবাধিকার এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য হানিকর মদ ও ভেষজের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের কথা বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফসিটিসি) আর্টিকেল ৬নং ধারায় তামাক ব্যবহার হ্রাসে কর বৃদ্ধির বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তামাক নিয়ন্ত্রণের যে কয়টি পদ্ধতির কথা বলেছে, তার মধ্যে কর বৃদ্ধি অন্যতম।
তামাক হচ্ছে সর্বগ্রাসী একটি পণ্য। তামাক চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সেবন সব পর্যায়েই জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ, অর্থনীতির ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এজন্য উন্নত দেশগুলো তামাকের ওপর উচ্চহারে কর আরোপ, সিগারেটের প্যাকেটে ছবি ও সতর্কবাণীসহ কঠোর আইন প্রণয়ন করায় তামাক সেবনের হার কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশ রক্ষার স্বার্থেও উন্নত দেশগুলো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করায় তামাক চাষ কমে যাচ্ছে। যে কারণে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তামাক কোম্পানিগুলোর আগ্রাসন বেড়ে গেছে।
বিড়ির কথা বিশেষভাবে এ জন্য বলছি, বাংলাদেশে যত কম মূল্যে বিড়ি পাওয়া যায়, পৃথিবীর কোনো দেশে এত কম মূল্যে তামাকজাত দ্রব্য পাওয়া যায় না। তাই বিড়ির ওপর উচ্চহারে কর বাড়াতে হবে। মানুষকে সুস্থ রাখতে চাইলে বিড়ির ওপর কর বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি অন্যান্য তামাকজাত দ্রব্যের ওপরও উচ্চহারে কর বৃদ্ধি করে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নকে গুরুত্ব দিতে হবে।

আমিনুল ইসলাম সুজন : গবেষক
aisujon@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.