আমার ভাষা আমার একুশ-গণমাধ্যমে বাংলা ভাষা: স্বাধীনতার সীমানা by সৌরভ সিকদার

ভাষা যে আমাদের প্রত্যহিক জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। মানবসভ্যতার উন্নয়ন ও অগ্রগতির মূলে রয়েছে এই ভাষা। ভাষা হচ্ছে মানুষে মানুষে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। গণমাধ্যম হলো একসঙ্গে বহু মানুষ তথা গণমানুষের কাছে তথ্য-সংবাদ-বাণী-ছবি প্রভৃতি পৌঁছানোর মাধ্যম।
গণমাধ্যম বলতে প্রধানত টিভি, বেতার, সংবাদপত্রকে বোঝানো হয়ে থাকে। বর্তমান বিশ্বে গণমাধ্যম এখন সবচেয়ে প্রভাবশালী মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। একুশ শতকে এসে পৃথিবীজুড়ে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের ওপর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে এই গণমাধ্যম, শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষের ওপর। এ কারণে গণমাধ্যমের ভাষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। বর্তমান আকাশ সংস্কৃতি ও মুক্তবাজার অর্থনীতির জোয়ারে তৃতীয় বিশ্বের গণমাধ্যমের ভাষাও বদলে যেতে শুরু করেছে। নানা ভাষিক মিশ্রণ, বর্জন ও সংযোজনের মধ্য দিয়ে নিয়ত এর রূপ বদলাচ্ছে। বহুজাতিক কোম্পানির বিজ্ঞাপননির্ভর আমাদের গণমাধ্যমগুলো একালে পণ্যের প্রসারের পাশাপাশি দেশি ভাষাকে অনেকটা হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে—এ কথাও সত্য।
সংবাদপত্রের মূল লক্ষ্য পাঠককে সংবাদ বা তথ্য জানানো, সেই সঙ্গে বিনোদনও যোগ হয়েছে একালে। মাতৃভাষার প্রসার এবং শুদ্ধ রূপ প্রচারে তাই সংবাদপত্রের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। দু-একটি পত্রিকার কথা বাদ দিলে আমাদের অধিকাংশ সংবাদপত্র প্রয়াত অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ভাষায়, ‘বাংলা পত্রিকাগুলো নির্বিচারে বাংলা ও বিদেশি শব্দের মিশ্রণ ঘটায়। বাংলাকে দ্বিতীয় স্থানে সরিয়ে রাখে এবং এক অমার্জিত-অসংস্কৃত ভাষাজগত সৃষ্টি করে।’ আমাদের তড়িত্ গণমাধ্যমের জন্যও এ কথা আজ অধিক সত্য।
ভাষার ব্যাকরণ বলতে আমরা যে নিয়ম বা সূত্রাবলি বুঝি, তার বাইরেও আরেক ব্যাকরণ আছে। একে বলা হয় ভাষার ‘সাংস্কৃতিক ব্যাকরণ’। এটি কোনো লিখিত দলিল বা গ্রন্থ নয়। কোনো প্রতিষ্ঠান বা নির্দিষ্ট কোনো ভাষাভাষী মানুষ তার যে সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক প্রতিবেশে বাস করে, সে বিষয়ে নিজস্ব ধারণা বা ভাষাবোধ থেকে সে প্রয়োগ করে তার ভাষা এবং এভাবেই অন্যের সঙ্গে সে যুক্ত হতে চায়। গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করে। তার ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই বটে, কিন্তু তার কী ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার করা উচিত, কী ভাষা ব্যবহার করবে—এ বিষয়ে সমাজ-দেশের সেই ‘সাংস্কৃতিক ব্যাকরণ’ জ্ঞান খুবই জরুরি। আমাদের টেলিভিশনের নাটক মান বাংলার পরিবর্তে যদি ক্রমাগত আটপৌরে বা নাগরিক কথ্য বাংলা প্রয়োগ করে এবং এফএম রেডিও জকির কণ্ঠে ইংরেজি-বাংলা মিশ্রিত খিচুড়ি ভাষা প্রয়োগ হতে থাকে, তাহলে কোনো আইনবলে তা আটকানো যেমন কঠিন, তেমনি মান বাংলা ভাষার ওপর এর অনিবার্য প্রভাব বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ক্রমশ যে বিপন্ন করে তোলে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। যেমনটি হয়েছিল হাইতি, ফ্রেন্স গায়ানা ও জ্যামাইকায়। হাইতিতে নব্বই শতাংশ মানুষ প্রয়োগ করে ফরাসি এবং তাদের আদি ভাষার খিচুড়ি (creole) ফ্রেন্স গায়ানায় তিরানব্বই শতাংশ ও জ্যামাইকায় বাইশ লাখ মানুষের মধ্যে (১৯৯০) বিশ লাখ মানুষ বলে ইংরেজির খিচুড়ি। কাজেই গণমাধ্যমের এই অভাবনীয় প্রভাবের যুগে ভাষার বিষয়ে তারা কতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত তাদেরই নেওয়া জরুরি। সম্প্রতি আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর এক জরিপ করে দেখেছি, এদের মধ্যে দশ থেকে ত্রিশ শতাংশ শিক্ষার্থী গণমাধ্যম বিশেষ করে টিভি-বেতারের ভাষা দ্বারা প্রভাবিত। যে কারণে টিভি নাটকে এবং এফএম অনুষ্ঠানে ব্যবহূত বাংলা ভাষার শব্দ ও বাক্ভঙ্গি তারা প্রয়োগ করছে। যে ভাষার মানুষ প্রাণ দিয়েছে মাতৃভাষা রক্ষার জন্য, যাদের একুশে ফেব্রুয়ারির মতো ঐতিহ্য রয়েছে, সেই ভাষার পরিণতি কি হাইতি-গায়ানা হবে ভবিষ্যতে?
এ কথাও ঠিক, ভাষার অর্থনৈতিক ও সামাজিক মূল্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাকে টিকে থাকতে হবে। সেই সঙ্গে রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানকেও সজাগ থাকতে হবে—মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাসহ সর্বস্তরে মাতৃভাষার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তিতে। সেই সঙ্গে রাষ্ট্র এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকেও সজাগ থাকতে হবে এর বিকৃতির সম্ভাবনা বর্জন থেকে। বাংলাদেশে বাংলা ভাষার প্রতিপক্ষ মাল্টিন্যাশনাল এবং বিশ্বায়নের স্রোতে আসা ইংরেজি। কিন্তু ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাংলাকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে টিকে থাকার জন্য ইংরেজি ও হিন্দি—এ দুটি প্রতিপক্ষের সঙ্গে। এই মুহূর্তে আমাদের গণমাধ্যমে দুটি প্রধান বিষয় বাংলা ভাষার ভবিষ্যেক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। যেহেতু গণমাধ্যম খুব দ্রুত মানুষকে প্রভাবিত করে। আর অসচেতন মানুষ ধরেই নেয় যে এটাই আদর্শ, এটাই যুগের চল বা ফ্যাশন। এই অগ্রহণযোগ্য আদর্শ এবং তথাকথিত ‘বাংলিশ’ ফ্যাশন সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের সমাজে। রবীন্দ্রনাথ প্রায় এক শ বছর আগে লিখেছিলেন, ‘ইংরেজি আমাদের পক্ষের কাজের ভাষা, কিন্তু ভাবের ভাষা নয়।’ ভাবের ভাষা কাজের ভাষা থেকে বেশি প্রয়োজন। কারণ ‘আমাদের দেহ সাড়ে তিন হাতের মধ্যে বদ্ধ কিন্তু তাই বলিয়া ঠিক সাড়ে তিন হাত পরিমাণ গৃহ নির্মাণ করিলে চলে না। স্বাধীন চলাফেরার জন্য অনেকখানি স্থান রাখা প্রয়োজন’ (শিক্ষায় ফেরফের প্রবন্ধ)। কাজেই ইংরেজি ভাষা বা আঞ্চলিক ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার বাংলা ভাষার জন্য সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে বাংলাকে ইংরেজির মতো বলা, বাংলার ঘাড়ে অপ্রয়োজনীয় ইংরেজি শব্দ চাপিয়ে দেওয়া এবং মান কথ্য ভাষার ফাঁকফোকর দিয়ে আঞ্চলিক বা আটপৌরে ভাষার ক্রিয়াপদ বা শব্দগুচ্ছ ঢুকে পড়া।
গণমাধ্যম ও বাংলা ভাষা বিষয়ে মিডিয়া বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘সংবাদপত্র, টিভি, রেডিও, চলচ্চিত্রসহ গণমাধ্যমের সব শাখায় বাংলা ভাষার ব্যবহার সম্পর্কে সবাইকে আরও যত্নবান হতে হবে। আলাদা মনোযোগ দিতে হবে। আমরা অনেকে ধরে নিয়েছি, বাংলা যেহেতু আমাদের মাতৃভাষা, সে কারণে এটা স্বাভাবিকভাবেই আয়ত্ত করে ফেলেছি। কিন্তু বাস্তবতা তা নয়। শুদ্ধ বাংলা ভাষা ব্যবহার, শুদ্ধ বানান ইত্যাদি আয়ত্ত করতে হয়। ছোটবেলায় স্কুলে আমাদের ভাষা শিক্ষাটা যথাযথ ও পরিকল্পিতভাবে না হওয়ায় একজন মানুষের সারা জীবনে মাতৃভাষা ব্যবহারে দুর্বলতা থেকেই যায়। তারই প্রকাশ আমরা দেখি গণমাধ্যমে। এখন সংবাদপত্রের প্রভাব ভাষার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি; কারণ এটি স্থায়ী মাধ্যম—বারবার পড়া ও দেখার সুযোগ থাকে। কাজেই সবগুলো সংবাদপত্রের উচিত একজন ভাষাবিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া। দক্ষ কপি এডিটরও নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। বর্তমান কাঠামোতে সে রকম দক্ষ লোকজন আছে বলে মনে হয় না। এটি শুধু সংবাদপত্র নয়, অন্যান্য গণমাধ্যমের জন্যও প্রযোজ্য। সংবাদপত্রে তবু কিছু দেখার লোক আছে, কিন্তু টিভি-বেতারে নেই বললেই চলে। দ্বিতীয়ত, টিভির কিছু নাটকে যেভাবে ঘরোয়া আটপৌরে ভাষায় সব চরিত্র কথা বলে, সেটাও বাংলা ভাষার জন্য ক্ষতিকর। এ ক্ষেত্রে টিভি নাটকের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা নিজেরাই একটা নীতিমালা প্রণয়ন করলে ভালো হয়। অনেকে নাটকে এটাকে শিল্পীর স্বাধীনতা বলে, কিন্তু সেই স্বাধীনতার একটা সীমা আছে। এফএম রেডিওর বাংলা-ইংরেজি মেশানো খিচুড়ি ভাষা অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। ইচ্ছে করলে তারা ইংরেজি ভাষায় পৃথক অনুষ্ঠানও করতে পারে।’
বর্তমানে গণমাধ্যমে প্রচারিত অনুষ্ঠান বা সংবাদের ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে মিশ্ররীতি ব্যবহারের ফলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ভাষিক জ্ঞান সুষ্ঠুভাবে গড়ে উঠছে না। লক্ষণীয় যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা প্রমিত বাংলা ভাষা প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে দর্শক ক্রমশ মাতৃভাষার প্রতি আগ্রহ ও শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলছে। অথচ শুদ্ধ ও প্রমিত বাংলা ভাষার প্রসার ঘটাতে টেলিভিশন তথা গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা গণমাধ্যমকে সেভাবে দেখতে চাই।
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.