কেন্দ্রীয় ব্যাংক-মূলধারা বজায় রেখেই গণমানুষের পাশে by তৌফিক আহমদ চৌধূরী

তিন বছরে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। এ অর্জনের পেছনে মূল চালিকাশক্তি বাংলাদেশ ব্যাংক। এ রকম একটি ব্যাংকিং পরিবেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই এগিয়ে আসতে হয়। এটাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উন্নয়নমূলক উদ্যোগ


বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান আজ ভারতের মর্যাদাপূর্ণ 'ইন্দিরা গান্ধী স্বর্ণ স্মারক ২০১১' গ্রহণ করবেন। মানবিক উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে তাৎপর্যপূর্ণ অবদানের জন্য কলকাতাস্থ এশিয়াটিক সোসাইটি এ পুরস্কার প্রদান করেছে।
ব্যাংক অব ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্ট বা বিআইএস বলেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল কাজ মুদ্রা ব্যবস্থাপনা ও ব্যাংকিং তদারকি। কিন্তু গত দুই দশকে উন্নত দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রমে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম প্রতীয়মান হয়। এসব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রথম কাজটি (মুদ্রা ব্যবস্থাপনা) চলমান রেখে দ্বিতীয় কাজটি (ব্যাংকিং তদারকি) অন্যান্য স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পন্ন করছে। ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম এবং ব্যাংক অব ইংল্যান্ড এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তার প্রথাগত কাজের বাইরে আরও কিছু অতিরিক্ত কাজ করতে হয়।
রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সাবেক গভর্নর, প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. চক্রবর্তী রঙ্গরাজন বলেছেন, উন্নয়নশীল/অনুন্নত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূলধারার অতিরিক্ত একটি কাজ করে_ উন্নয়নমূলক কাজ। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থার কথাই ধরা যেতে পারে। স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও দেশের জনসংখ্যার বড় অংশ আর্থিক সেবা থেকে বঞ্চিত। কৃষি উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি হলেও আনুষ্ঠানিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে মোট ঋণের মাত্র ৭-৮ শতাংশ পেয়ে থাকে। ক্ষুদ্র ব্যবসা/শিল্প খাত প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সত্ত্বেও ব্যাংকিং খাত থেকে সামান্যই সহযোগিতা পাচ্ছে। এসব খাতের বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকগুলো তাদের অর্থায়নে কাঙ্ক্ষিতভাবে এগিয়ে আসছে না। এহেন অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই তার মূলধারার কাজ মুদ্রা ব্যবস্থাপনা ও ব্যাংকিং তদারকির পাশাপাশি এদের অর্থায়নের ব্যবস্থা করার জন্য এগিয়ে আসতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান ২০০৯ সালের মে মাসে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর কৃষিঋণ, এসএমই ঋণ, মহিলা উদ্যোক্তা উন্নয়ন, পরিবেশবান্ধব অর্থায়ন ও নীতিমালা গ্রহণ ইত্যাদি ব্যাপারে গুরুত্ব প্রদান করেছেন। এসব ব্যাপারে আগের অনেক গভর্নরও কমবেশি জোর দিয়েছিলেন। তবে বর্তমান উন্নয়নমূলক উদ্যোগগুলোর তাত্তি্বক ভিত্তি হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের এযাবৎকালের সবচেয়ে আকর্ষণীয় কর্মকাণ্ড 'অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়ন', যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ঋরহধহপরধষ ওহপষঁংরড়হ. মূলত দু'ধরনের আর্থিক সেবা_ আমানত ও ঋণ সেবা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পরিমাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক গত দু'তিন বছরে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর করার জন্য অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাসহ কৃষি ও এসএমই খাতে মোট ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে যুগোপযোগী কৃষি ও এসএমই নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করছে। এসএমই খাতের অর্থায়নে গতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে আলাদা বিভাগ তৈরি করা হয়েছে। এসএমই খাতের জন্য পুনঃঅর্থায়ন কর্মসূচি ছাড়াও প্রথমবারের মতো শুধু বর্গাচাষিদের জন্য ৫০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর সবচেয়ে প্রশংসিত ও আলোচিত পদক্ষেপ হলো ১০ টাকার কৃষক অ্যাকাউন্ট। কৃষকদের জন্য সরকার প্রদত্ত সার, বীজ, জ্বালানি ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ সহায়তা সরাসরি কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরের সুবিধার্থে বাংলাদেশ ব্যাংক সব রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের গ্রামীণ শাখায় ১০ টাকায় কৃষক অ্যাকাউন্ট খোলার নির্দেশ দিয়েছে। এ পর্যন্ত ১ কোটির বেশি কৃষক নতুন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। কৃষকরা যেন স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়, হয়রানিমুক্তভাবে এবং সময়মতো ঋণ পেতে পারেন সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক 'হেল্পডেস্ক' স্থাপনসহ মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করেছে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের অন্যতম সহায়ক উপকরণ হচ্ছে আর্থিক জ্ঞান/শিক্ষা (ভরহধহপরধষ ষরঃবৎধপু), যার অর্থ আর্থিক বাজারের বিভিন্ন পণ্য পছন্দ করার ক্ষেত্রে সেগুলোর ইতিবাচক দিক ও ঝুঁকি সম্পর্কে জনগণকে সম্যক ধারণা প্রদান। আর্থিক শিক্ষার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০ সালের মার্চ মাসে 'উন্নয়নের অভিযাত্রা' শীর্ষক টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত রোড শোর আয়োজন করেছিল। এ ব্যতিক্রমী রোড শোর উদ্দেশ্য ছিল কৃষিঋণ, এসএমই ঋণ, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ও ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণ বিষয়ে জনগণকে অবহিত, উদ্বুদ্ধ এবং সম্পৃক্ত করা।
তিন বছরে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। এ অর্জনের পেছনে মূল চালিকাশক্তি বাংলাদেশ ব্যাংক। এ রকম একটি ব্যাংকিং পরিবেশে (যেখানে সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকেরই নিজস্ব উদ্যোগ কম) কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই এগিয়ে আসতে হয়। এটাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উন্নয়নমূলক উদ্যোগ।
অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু কৃষি বা ক্ষুদ্রঋণ নয়, গ্রিন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং ইত্যাদি সেবাও প্রদান করে যাচ্ছে। এমনকি ব্যাংকগুলোর করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতাকেও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের আঙ্গিকে বিচার করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর ওইসব কর্মকাণ্ড বা ব্যয়কে করপোরেট সামাজিক ব্যয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যা পিছিয়ে পড়া সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর উন্নয়নে বা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে ব্যয় হয়ে থাকে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতাকে তাদের করপোরেট নীতিমালার অংশ হিসেবে বিবেচনা করার নির্দেশনা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগের জন্যই ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১০ সালে ব্যাংকগুলো করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার জন্য ব্যয় বাড়িয়েছে ৪ গুণের অধিক। ২০১১ সালে এরূপ ব্যয় আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
'অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়ন' বিষয়টিকে তাত্তি্বক ভিত্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্যই বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি কৌশলগত পরিকল্পনায় (২০১০-১১) অন্তর্ভুক্ত করেছে। আগেই বলা হয়েছে, উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড তাই বলে মূলধারার কর্মকাণ্ডকে পাশ কাটিয়ে করা সম্ভব নয় বা উচিতও নয়। গত ৩-৪ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল কার্যক্রম (মুদ্রানীতি ও ব্যাংক তদারক) পরীক্ষা করলে দেখা যাবে, এগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি সুসংহত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি কর্মকাণ্ড সুসংহত হওয়ার জন্যই বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সার্বিক আর্থিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইতিমধ্যে বাসেল-২ সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে এবং ধীরে ধীরে এটিকে অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্যও প্রসারিত করছে। সার্বিকভাবে খেলাপি ঋণ ধীরে ধীরে কমে গত দু'তিন বছর ধরে ১-২ শতাংশে অবস্থান করছে, যা সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশ ব্যাংকের শক্ত তদারকি ব্যবস্থার প্রতিই ইঙ্গিত করে। তবে সার্বিক ব্যাংক ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য শুধু বেসরকারি ব্যাংক নয়, সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকেও বাংলাদেশ ব্যাংকের যথাযথ তদারকির আওতায় আনা উচিত। অবশ্য এজন্য প্রয়োজন বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকর স্বাধীনতা।
'ঋরহধহপরধষ ঝবপঃড়ৎ উবাবষড়ঢ়সবহঃ ধহফ ঃযব গরষষবহহরঁস উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষং' শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে (ওয়ার্কিং পেপার নং-৮৯, ২০০৬) উল্লেখ করা হয়েছে, অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়ন বা ধপপবংং ঃড় ভরহধহপব শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলোর আর্থিক ব্যবস্থার উন্নতি সাধনই করে না, সে সঙ্গে জাতিসংঘ প্রবর্তিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, যেমন_ দারিদ্র্য দূরীকরণ, অপুষ্টি নিবারণ, সুস্বাস্থ্য, শিক্ষা ও লিঙ্গ বৈষম্য কমানো ইত্যাদি অর্জনেও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম হবে না। যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়ন নীতি একটি গ্রহণযোগ্য তাত্তি্বক ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, সে জন্য এটা অন্যান্য দেশের জন্য 'অনুকরণীয় মডেল' বলে বিবেচিত হতে পারে।

ড. তৌফিক আহমদ চৌধূরী :মহাপরিচালক বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট

No comments

Powered by Blogger.