স্মরণ-সৈয়দ মুজতবা আলী—চৈতন্যের আলোয় by আসমা আব্বাসী

‘হাতকড়া না হাতকরা’ কোনটি নাম হলে ঠিক হতো—তাই নিয়ে মহাবিতর্ক তিন সহোদরে। তিন ভাই সৈয়দ মোস্তফা আলী, সৈয়দ মর্তুজা আলী, সৈয়দ মুজতবা আলী যেন হরিহর আত্মা। গভীর মায়া একজনের জন্য আরেকজনের, গল্পগুজব করেন সমবয়সী বন্ধুর মতো, আবার মান্য করেন মুরব্বি হিসেবে।


বড় ভাইয়ের সামনে কখনো সিগারেট ধরান না মেজ মামু মর্তুজা আলী, তেমনিভাবে হুরু মামু মুজতবা আলীও পাইপ হাতে আসেন না বড় ভাইদের সামনে।
‘আপনারে বড় বলে বড় সেই হয়
লোকে যারে বড় বলে বড় সেই নয়।’
বলতে বলতে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তেন তিন ভাই। তাঁদের মৌলভীবাজারের বাড়ির টিনের চালে শিশির ঝরে পড়ার টুপটুপ শব্দ শুনতে শুনতে। বাগান থেকে ভেসে আসছে ভেজা শিউলির সুবাস, রান্নাঘরে তাঁদের মা আমাতুল মান্নানের পিঠা ভাজার খুশবু। ভীষণ রসবোধ তিনজনারই, বিশেষ করে হুরু মামু সৈয়দ মুজতবা আলীর। তাই তিনি সহাস্যে বলে ওঠেন, ‘বড় ভাইসাব লম্বা-চওড়ায় তো আমাকেই দেখায় বড়, তাই লোকে মনে করে আমিই বুঝি আপনাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। তাই তো কবিতাটা একটু সংশোধন করে দিলাম।’
‘ঠিক আছে, ভাই সিতু [হুরু মামুর ডাকনাম]’, বড় মামু, মেজ মামু একবাক্যে সম্মতি দেন।
আমার তিন মামুই সমুদ্রহূদয় ভালোবাসা দিয়ে পাঁচ বোন সৈয়দা হাবিবুন্নেসা, সৈয়দা হিফজুন্নেসা, সৈয়দা নজিবুন্নেসা, সৈয়দা জেবুন্নেসা ও সৈয়দা লুত্ফুন্নেসার ছেলেমেয়েদের স্নেহমমতার বারি সিঞ্চন করে সজীব করে রেখেছিলেন, সঙ্গে ছিল নিজ সন্তানেরা। বছরে একবার ঢাকার জয়দেবপুর অথবা শ্রীপুরে বনভোজন হতো, বলা যায় পারিবারিক সম্মিলন। সবচেয়ে কনিষ্ঠ যে শিশু তাকে নতুন করে পরিচয় করানো হতো মহাসমাদরে। মামুরা বলতেন, ‘দেখো দেখো, সৈয়দ সিকান্দার আলীর বংশপরম্পরা কত বিস্তৃত হচ্ছে। বলা যায় না, গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম ওঠার পথে চলেছি বুঝি আমরা।’ সেই বনভোজনে সিলেটের ইষ্টিগুষ্টি, সঙ্গে আছেন ভিনদেশের বধূ বা জামাই। যাঁরা ননসিলেটি কিংবা হাফসিলেটি হয়ে গেছেন বৈবাহিক সম্পর্কে, সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা আয়ত্ত করতে না পারলেও সাতকরা, গরুর গোশতের সালুন, চুঙ্গা পিঠা, চই পিঠা, বিরণ চালের আঠালো পোলাওসহ ক্ষীরসা, চালের রুটিসহ রুইমাছ ভাজা তাঁদের কাছে দারুণ উপাদেয়।
হুরু মামু ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ থেকে দেশান্তর। প্রথমে শান্তিনিকেতনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য, পরে কাবুল কান্দাহার পাঞ্জাব কটক গৌহাটি প্যারিস রোম সবই যেন তাঁর ঠিকানা। নিজগৃহে পরবাসী, বাড়ির টান থাকলেও মন পড়ে থাকে বোলপুরের আড্ডায় বা কলকাতার পাঁচ নম্বর পার্ল রোডের মজলিশে। আবু সয়ীদ আইয়ুব, গৌরী আইয়ুবের পাশের ফ্ল্যাটে তখনকার বিখ্যাত এমপি ডক্টর গনি ও বেগম গনির স্নেহমাখা বাড়ি তাঁর বাসস্থান। আমরাও বেড়াতে গেলে গৌরী চাচি ও গনি চাচির স্নেহে ধন্য হই। আইয়ুব চাচা ও গনি চাচার সুমধুর সান্নিধ্য তো উপরি পাওনা। কখনো আসেন কথাসাহিত্যিক মনোজ বসু, যাঁর লেখা পড়ে মুগ্ধতার আবেশ ছড়ানো অগণিত ভক্ত মনে। পশুপতি খান, মামা আছেন মামুর সঙ্গে ছায়ার মতো, খুঁটিনাটি চাওয়া না চাওয়া সবই পলকে বুঝে নেন।
মামু ঢাকায় কখনো মিন্টো রোডে মেজ মামুর বাড়িতে, কখনো ব্যাংক হাউসে আমার ভাই সুলেমান চৌধুরীর ফ্ল্যাটে, মামি যখন রাজশাহী থেকে বদলি হয়ে ঢাকায় এলেন কামরুন্নেসা গার্লস স্কুলের হেডমিস্ট্রেস হয়ে তখন সেগুনবাগিচায় বিরাট একটি বাড়ির দোতলায়। হুরু মামু এত মজলিশি লোক, ঘণ্টার পর ঘণ্টা খোশগল্প করে চলেছেন, বক্তার হুঁশ নেই, শ্রোতারাও বেহুঁশ। গোসলের সময় বয়ে যায়, খাওয়ার সময় গড়িয়ে যায়, থামাবে কে? আপাতদৃষ্টিতে গুরুগম্ভীর, অন্তরে মমতা ও রসের ফল্গুধারা। মামি বাড়ি করলেন ধানমন্ডিতে লেকের পাশে। শিশুপুত্র ফিরোজ ও কবিরকে খাওয়ানোর সময় মামি ঘুরছেন ভাতের থালা হাতে এ-ঘর থেকে ও-ঘর। ফিরোজ ট্রাইসাইকেল নিয়ে ভ্রাম্যমাণ পরিব্রাজক, কবির ফুটবল খেলতে গিয়ে পানির মাটির কলসি ভেঙে চুরমার করে হাসছে, হাসছেন স্নেহময়ী মা, স্কুলে আমাদের প্রতাপশালী হেডমিস্ট্রেস, এখানে বাচ্চাদের দুরন্তপনায় যেন ভীরু হরিণী।
একবার মামুকে দেখতে গেলাম বিখ্যাত পূর্বাণী হোটেলের সুস্বাদু প্যাস্ট্রি নিয়ে। খেয়ে মহাখুশি। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কত দাম নিল, হে আব্বাসী?’ দাম শুনে স্মিত হেসে বললেন, ‘এর নাম পূর্বাণী না হয়ে কুরবানি হওয়া দরকার।’
আমার হুরু মামুর অন্তরে ছিল ধর্মের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, সারাটি জীবন দেখেছেন তাঁর পরিবারের ধর্মপ্রীতি ও সংস্কৃতিপ্রীতির মেলবন্ধন। নিজে ঈদের জামাত ছাড়া জায়নামাজে দাঁড়াতেন কি না জানি না, তবে এটুকু জানি, তাঁর বড় সাধ ছিল নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর একটি গ্রন্থ রচনা করবেন। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ‘সবুর করো, আরেকটু ভালো করে পড়াশোনা করে নিই। নবীর জীবন তো মহাসমুদ্র, জ্ঞানের কালিকলম জোগাড় করছি আমি।’
সাধ থাকে কত, পূরণ করার দায় বিধাতার। স্বপ্ন নিয়ে মানুষ বাঁচে, আবার অধরা স্বপ্ন নিয়েই চলে যেতে হয়। সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখ করিমগঞ্জের এক সোনালি প্রভাতে জন্মেছিলেন তিনি। ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখে ঢাকায় ধানমন্ডির বাসভবনে তাঁর প্রাণপাখি মাটির পিঞ্জিরা ছেড়ে উড়াল দিল নীলাকাশে।

No comments

Powered by Blogger.